মতামত

লন্ডনী বার্তায় বিএনপিতে অব্যাহতি আর বিলুপ্তি

ইয়াহিয়া নয়ন

Advertisement

দলীয় নেতাদের দল থেকে অব্যাহতি আর চলমান শাখা প্রশাখা কমিটি বিলুপ্ত করার নাটকীয় কাণ্ড চলছে বিএনপিতে। লন্ডনী বার্তার এসব কাণ্ডে আতঙ্কে আছেন দলের নেতাকর্মীরা। দলটির সারাদেশের তৃণমূলের মাঝে জন্ম নিচ্ছে ক্ষোভ, বড় নেতারা সবাই চুপ।

হঠাৎ করে খুলনা মহানগর বিএনপির পাঁচটি থানা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর শনিবার রাতে খুলনা নগরের কে ডি ঘোষ রোডে অবস্থিত বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে বিশেষ সাংগঠনিক সভায় ওই কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেওয়া হয়।

এর আগে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষিত হওয়ার পর কমিটির পক্ষ থেকে করা সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিল, আগে মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। পরে থানা ও ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা হবে। কিন্তু তা না করে আগেই থানা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে।

Advertisement

এর আগে খালিশপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এস এম আরিফুর রহমান এবং ২২ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি তরিকুল্লাহ খান ও সাধারণ সম্পাদক জাহিদ কামালসহ ওই ওয়ার্ডের ১৪ জন নেতা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। দুপুরের দিকে খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

কয়েকজন বিএনপি নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর প্রতিবাদস্বরূপ ওই নেতাকর্মীরা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। নেতাকর্মীদের পদত্যাগের ঘোষণা আসার খবরে তাৎক্ষণিকভাবে সন্ধ্যার দিকে বিশেষ সভা ডাকে নতুন আহ্বায়ক কমিটি। চার ঘণ্টা চলা ওই বৈঠক শেষে পাঁচটি থানা কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেওয়া হয়।

২৭ ডিসেম্বর রাত ১১টার দিকে মহানগর বিএনপির পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দলীয় কার্যালয়ে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির প্রথম সাংগঠনিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। সভায় আগামী জানুয়ারি থেকে থানা ও ওয়ার্ড কমিটিগুলো পুনর্গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

নজরুল ইসলাম মঞ্জু ছিলেন খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি। ৯ ডিসেম্বর নতুন ঘোষিত কমিটিতে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে ১২ ডিসেম্বর খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। সর্বশেষ তাকে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি।

Advertisement

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতার অব্যাহতি দেওয়া নিয়ে দলের সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে গত কয়েক মাসে চারজন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এরা হচ্ছেন- বরিশাল বিভাগ বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ার, কুমিল্লা সিটির মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, খুলনা মহানগরীর সাবেক সভাপতি ও দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু এবং সবশেষ নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক থেকে সরানো হয়েছে তৈমুর আলমকে। যদিও তৈমুর আলম বলছেন, সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে তার সঙ্গে দলের হাইকমান্ড আলোচনা করে একজনকে কিছু দিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করেছে।

জানা গেছে, দলের ‘গুরুত্বপূর্ণ ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য’ নেতাদের অব্যাহতি দেওয়ার কারণে সারাদেশে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। অনেকে বলছেন, কয়েক যুগ রাজনীতি করার পর একজন নেতা তৈরি হয়। কিন্তু তুচ্ছ কারণ তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কারণে দলেরই বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এতে ত্যাগী নেতাকর্মীরা নিরুৎসাহিত হন।

পাশাপাশি বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা নেতিবাচক মন্তব্য করতে নারাজ। আবার কেউ কেউ অব্যাহতির বিষয়ে জেনেছেন পত্রিকা পড়ে বা অন্য কোনো ভাবে। দলীয় ফোরামে অব্যাহিত বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে নেতারা জানিয়েছেন।

গত শনিবার দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে খুলনার প্রভাবশালী নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে অব্যাহতি দেয় বিএনপি। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের একক সিদ্ধান্তে তার অব্যাহতির খবরে পুরো দলেই নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে। মঞ্জুকে অব্যাহিত দেওয়ার পর খুলনা বিএনপির প্রায় ৫শ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। এর আগে গত অক্টোবরে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। দলীয় কার্যক্রমে তার যুক্ততা কম থাকার কারণে তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এরপর গত ৩ নভেম্বর বরিশাল নগরীর নতুন কমিটি থেকে যুগ্ম মহাসচিব মজিবুর রহমান সরোয়ারকে বাদ দেওয়া হয়।

জানা গেছে, নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে হঠাৎ করেই। বিষয়টি নিয়ে স্থায়ী কমিটিতে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে কোনো নেতাই স্বনামে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কোনো কোনো সিনিয়র নেতা ‘মন্তব্য করতে রাজি নন’, এ বিষয়টিও স্বনামে উদ্ধৃত হতে সম্মতি দেননি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমি তো এ বিষয় জানি না। না জেনে আন্দাজে বলা ঠিক হবে না।’

দলের প্রভাবশালী এক নেতার দাবি, লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঢাকায় যাদের সঙ্গে কথা বলে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তাদের পক্ষ থেকেও তাকে (তারেক রহমান) মঞ্জুকে অব্যাহতি না দিয়ে ভিন্ন কোনো উপায় গ্রহণ করার বিষয়ে কোনো ব্রিফ করা হয়নি। নেতারা বলছেন, মেয়র মনিরুল হক সাক্কু স্থানীয় ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বরিশালের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত মজিবুর রহমান সরোয়ার।

নজরুল ইসলাম মঞ্জুও খুলনার রাজনীতিতে প্রভাবশালী। বড় কোনো ত্রুটি ছাড়া তাদের বাদ দেওয়ার কারণে সাংগঠনিকভাবে ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিএনপি। এর প্রভাব দলীয়ভাবেই টের পাবে বিএনপি। বিএনপির সিনিয়র একাধিক নেতা জানান, হঠাৎ করেই দলে ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার কারণে প্রথমত সাংগঠনিকভাবে বিএনপির ক্ষতি। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দল পুরো তৃণমূল পর্যন্ত দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে সুবিধা পাবে।

তৃতীয়ত, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে চলমান রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দলের পোড় খাওয়া নেতাদের হঠাৎ অব্যাহতি দেওয়া এবং এর নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এটার দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের। তিনি কোনো ব্যাপারে অসঙ্গতি দেখে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন হয়তো। আমার ব্যক্তিগতভাবে জানা নেই। আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না।’

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম