করোনা মহামারির শুরুতে ঘরবন্দি গ্রাহকের দোরগোড়ায় নিরবচ্ছিন্ন পণ্য পৌঁছে প্রশংসা আর মুনাফায় ভাসতে থাকে দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। সে সময় ৩শ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধির দাবি করেছিলেন খাত সংশ্লিষ্টরা। ২০২১ সালের শুরুতে রীতিমতো জোয়ার চলছিল ই-কমার্সে। তবে বছরের মাঝামাঝিতেই সামনে আসতে থাকে সমস্যা। আশার জোয়ারে আসে ভাটা।
Advertisement
বছরের শেষে এসে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে আশা জাগানিয়া খাতটি। সবচেয়ে চমক জাগানো ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি এবং একই মডেলের প্রতিষ্ঠানের মালিক, সিইওরা এখন প্রতারণার মামলায় জেলে। আর বিপুল পরিমাণ অর্থ হারানো গ্রাহক-বিনিয়োগকারীরা অর্থ উদ্ধারে ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে।
এসব প্ল্যাটফর্মে হাজার কোটি টাকা খুইয়ে গ্রাহকরা এখন দিশেহারা। সহসাই সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে না বলেও অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
ইভ্যালি দিয়ে শুরু আলেশায় শেষই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ ছিল। অভিযোগ নিয়ে ভোক্তা অধিকারেও শুনানি হয়েছে। তবে চটকদার বিজ্ঞাপন, বিস্ময়কর মূল্যছাড়, শতভাগেরও বেশি ক্যাশব্যাকের প্রলোভনের ধাঁধায় ডুবে থাকা গ্রাহকরা সব হারানোর চোরাবালিতে পা দেয়।
Advertisement
২০১৮ সালে ব্যবসা শুরু করা ইভ্যালি শেষের দিকে সাইক্লোন নামে অফারে প্রতি শুক্রবার অবিশ্বাস্য কম দামে মোটরসাইকেল বিক্রি শুরু করে। এরপর অনেককে তিন মাসের ব্যবধানে মোটরসাইকেল দেওয়াও হয়। আবার অনেকেই কম মূল্য পরিশোধ করে পেয়ে যান বাজারমূল্যের সমপরিমাণ টাকার চেক।
অল্প টাকায় পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি বা বেশি টাকার চেক পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন এক শ্রেণির গ্রাহক। ক্রমেই জনপ্রিয়তা পায় ইভ্যালি মডেলের ব্যবসা। একে একে বাজারে আসে ই-অরেঞ্জ, কিউকম, আদিয়ান মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ নামের একাধিক ই-কমার্স।
বছরের শুরুতে জমকালো আয়োজনে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে ইভ্যালি/ফাইল ছবি
বোমা ফাটে চলতি বছরের জুলাই মাসে। সে সময় জানা যায়, সরবরাহকারী ও গ্রাহকদের কাছে ৫শ কোটি টাকার দায়ে পড়েছে ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি টাকা। যদিও ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেলের দাবি ছিল, ব্র্যান্ডিংয়ে টাকা খরচ করে এই পরিণতি ইভ্যালির। সহসাই লাভের মুখ দেখবে প্রতিষ্ঠানটি।
Advertisement
নানা রকম কথায় দিন কাটাতে থাকেন তিনি। তবে ইভ্যালি অফিসে পাওনা টাকা ও পণ্য নিতে বাড়ে ভিড়। এতে উল্টে যায় পাশার দান। সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার হন ইভ্যালি সিইও মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী (প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান) শামীমা নাসরিন। বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
ইভ্যালির মতোই অবস্থা হয় ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম সিরাজগঞ্জ শপ, আনন্দের বাজার, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, নিরাপদ ডটকমসহ ডজন খানেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের। এরপর থেকে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের মালিক-সিইও হয় পলাতক, নয় জেলে বন্দি।
ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানে হাজার গ্রাহক, মার্চেন্টের আটকানো প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। এ টাকা আদৌ ফিরবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ভোক্তারা টাকা ফেরত পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাদের আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আদালতের রায়ে কোম্পানির যে বিষয়-সম্পত্তি আছে বা পরিচালকদের যে সম্পত্তি আছে, সেগুলো বিক্রি করে যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের যতটুকু সম্ভব অর্থ ফেরত দেওয়ার যদি সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে ভুক্তভোগীরা কিছু টাকা ফেরত পেতে পারেন। এটা সম্পূর্ণভাবে আদালতের রায়ের উপর নির্ভর করে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, টাকা পাওয়ার আইনি প্রক্রিয়া অনেক জটিল। এতে গ্রাহকের টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ।
প্রতারণার অভিযোগে বিভিন্ন জেলায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করছেন গ্রাহকরা। তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও করছেন। তবে এতে ফলাফল শূন্য। প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক-সিইওরা হয় জেলে অথবা দেশ ছেড়েছেন।
টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মার্কেটপ্লেস ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান আছেন জেলে। কারাগারে আছেন কিউকমের সিইও রিপন মিয়া, ধামাকার সিইও সিরাজুল ইসলাম রানাসহ আরও অনেকে।
গ্রাহকের টাকা ও পণ্য না দিতে পেরে ইভ্যালি মডেলের আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্ট ডিসেম্বরে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
গ্রেফতারের পর থেকে কারাগারে আছেন ইভ্যালি সিইও-চেয়ারম্যান/ফাইল ছবি
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর আলম শিকদার জানান, এরই মধ্যে বিনিয়োগ পেয়েছে আলেশা মার্ট। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গাইডলাইন মেনে ধীরে ধীরে সব সমস্যা সমাধানের পথে তারা হাঁটছেন। আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে গ্রাহকের টাকা ফেরতের আশ্বাসও দিয়েছেন এই ব্যবসায়ী।
প্রতারণার এসব ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে। তবে জানা গেছে, ইভ্যালি বাদে অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিভাবক সংগঠন ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল সার্বিক বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তাতে ই-কমার্সে একটা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য পুরো ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৮ সালে ই-ক্যাবের প্রচেষ্টায় ই-কমার্স নীতিমালা হয়। সেখানে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দেওয়া ছিল। সেন্ট্রাল কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন, টেকনিক্যাল কমিটি, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটি করার কথা বলা ছিল। সেগুলো বাস্তবায়নে অনেক দেরি হয়েছে। ফলে মার্কেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক মানুষ টাকা হারিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপঅনলাইন ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন (ইউবিআইডি) নেওয়া বাধ্যতামূলক করছে সরকার। আগামী বছর ইউবিআইডি ছাড়া ই-কমার্স ব্যবসা করার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। এটি চালু হওয়ার পর রেজিস্ট্রেশনবিহীন কোনো কোম্পানি দেশে অনলাইনে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না। বিটিআরসির সহায়তায় রেজিস্ট্রেশনবিহীন কোম্পানিগুলোর ব্যবসা বন্ধ করে দেবে সরকার।
ই-কমার্স খাত নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরটির কার্যক্রম জেলা থেকে বাড়িয়ে উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ই-কমার্স নজরদারিতে নতুন অ্যাপও আনছে।
দেশ ছেড়ে পালানোর পর ভারতে গ্রেফতার হন পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা/ছবি: সংগৃহীত
এছাড়া ই-কমার্সে আটকে থাকা টাকা ফেরতের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোয় আটকে থাকা ২১৪ কোটি টাকা গ্রাহকদের হিসাবে ফেরত দিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
চিঠিতে বলা হয়, যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা চলমান নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসক্রো সার্ভিসে ভোক্তাদের আটকে থাকা অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে অর্থ ছাড়ের নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়।
ই-কমার্স খাতের কারিগরি কমিটির সমন্বয়ক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলছেন, গত ৩০ জুনের পরে ই-কমার্স পেমেন্ট গেটওয়েতে যে টাকাগুলো আটকে ছিল, সেগুলো ফেরত দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংও নিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাদের পেমেন্ট গেটওয়েকে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) প্রতিষ্ঠাতা নাসিমা নিশা জাগো নিউজকে বলেন, সমস্যা সবখানেই থাকে। মানুষের জীবনেও থাকে। ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি দ্রুত সমস্যার সমাধান করবে। ই-কমার্স ঘুরে দাঁড়াবে এবং অনেক সফলতার গল্প আমরা শুনতে পারবো।
এসএম/এমএইচআর/এএ/এমএস