দেশজুড়ে

উচ্চবিত্তদের মধ্যে সিজারের প্রবণতা বেশি

সিজারে সন্তান হলে মা-শিশু দু’জনই থাকেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এছাড়া সিজারের কারণে মা-শিশু উভয়ের ওপরই পড়ে সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাব। তবুও একশ্রেণির উচ্চবিত্ত নরমাল ডেলিভারির ব্যথা এড়াতে বেছে নেন সিজারিয়ান অপারেশন। ঝিনাইদহের বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এমন তথ্যই জানা গেছে।

Advertisement

জেলা সদর হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গাইনি বিভাগে নরমালে ১ হাজার ২৮৯ শিশুর জন্ম হয়েছে। একই সময়ে সিজারে জন্ম হয়েছে ৬৮৮ শিশুর। গত দুই বছরের তুলনায় সিজারের হার শতকরা ২০ ভাগ কম।

জেলা সদর হাসপাতালে সিজারের হার কমলেও ক্লিনিকে সিজারের হার প্রায় ৮০ শতাংশ। অপ্রয়োজনীয় সিজারের সঙ্গে অপরিণত শিশু জন্মের সম্পর্কও রয়েছে। তবে ঝুঁকি সত্ত্বেও স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে সিজারে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা ব্যাপকহারে বেড়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রসূতি মা গেলেই তার পরিবারকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে অপারেশন করানোর। এমনকি বিভিন্ন ক্লিনিকে বাচ্চার পূর্ণতা পাওয়ার আগেই সিজার করানোর প্রতি বেশি উৎসাহিত করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা বলেন, সিজারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হলে সংশ্লিষ্ট ক্লিনিকের চিকিৎসক ও মালিক পক্ষ বেশি অর্থ পায়। এতে লাভও হয় বেশি। কারণ, হাসপাতালে রোগী যত বেশি দিন থাকবে ততো আয় হবে।

Advertisement

তবে অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে প্রায় ৮০ ভাগ প্রসবই সিজারিয়ানের মাধ্যমে হয়। ক্লিনিকগুলোতে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষ যায় বেশি।

এ অভিযোগ অস্বীকার করে শহরের রাবেয়া প্রাইভেট হাসপাতালের পরিচালক মেহেদী হাসান বাপ্পী জানান, প্রসূতিরা এলে কীভাবে তারা ডেলিভারি করাতে চান সেটা জানার চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের পছন্দ প্রাধান্য দেওয়া হলেও ক্লিনিকে চেষ্টা করি নরমাল ডেলিভারি করাতে। তার দাবি ৬০-৭০ ভাগ ডেলিভারি নরমালে হয়।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের গাইনি বিভাগে চিকিৎসাধীন গৃহবধূ বিলকিস বেগম জানান, পরপর সিজার করে তিনটা বাচ্চা হয়েছে। প্রথম বাচ্চা নরমাল হওয়ার সময় মারা যায়। এরপর ডাক্তারের পরামর্শে সিজারের মাধ্যমে পরের সন্তানগুলো হয়। কিন্তু এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ। কাটা জায়গা ইনফেকশন হয়েছে। তাই এক মাস ধরে হাসপাতালে আছি।

শহরের আদর্শপাড়া এলাকার গৃহবধূ রোমানা খাতুন জানান, রাত ২টা থেকে অল্প অল্প পানি ভাঙছিল। সকালে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়। এরপর ডাক্তার বলেন বাচ্চার মাথা ওপরে আছে। তখন সিজার করাই। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল নরমাল ডেলিভারি করানোর।

Advertisement

ঝিনাইদহ শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্য এক নারী জানান, গর্ভবতী থাকা অবস্থায় যখন পেটে আট মাসের বাচ্চা ছিল তখন একদিন অসুস্থ হলে রাবেয়া হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে সিজারের পরামর্শ দিলে সিজার করাই, জন্ম নেয় দুটো বাচ্চা।

তিনি আরও জানান, জন্মের পর থেকেই সন্তান কাঁদতো না, বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকতো। কিছু খাওয়ালেই বমি করতো। এভাবে কিছুদিন থাকার পর বাড়ি যাই। এর কয়েকদিন পর শিশু হাসপাতালে ভর্তি হই। ডাক্তাররা বলেন শিশু অপরিণত বয়সে জন্ম নেওয়ায় ওজন যেমন কম হয়েছে তেমনি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।

সদর হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সিনিয়র স্টাফ নার্স নুর নাহার জানান, প্রতি মাসে সদর হাসপাতালে গড়ে ৭০০ গর্ভবতী ভর্তি হয়। এর মধ্যে তিনশ রোগীর ডেলিভারি হলে একশ হয় সিজারে। দুইশ হয় নরমালে। তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশ রোগী প্রসব বেদনার ব্যথা সহ্য করতে চায় না। ফলে সিজারের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

ঝিনাইদহ শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আলী হাসান ফরিদ জামিল জাগো নিউজকে জানান, নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে জন্ম হলে শিশুর পূর্ণ বয়স যেমন পায় তেমনি শারীরিক মানসিক বিকাশও ভালো থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেক বেশি হয়। কিন্তু পূর্ণ বয়সের আগে সিজারের মাধ্যমে জন্ম হলে নানা জটিলতায় শিশুর লান্স, হার্ট, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে মায়ের গর্ভে শিশুর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর সিজার হলে শিশুর ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না।

ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট ডা. হারুন-অর-রশিদ জানান, সরকারি বিধিমালা মোতাবেক শতকরা ২০ ভাগ রোগীকে সিজার করানো যাবে। কিন্তু বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব রোগী আসে তাদের অনেকেরই শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ থাকে। তাই মা ও শিশুকে সুস্থ রাখতে সিজার করানো হয়। যদিও মায়েরা কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

তিনি আরও জানান, সাধারণত উচ্চবিত্ত মানুষের মধ্যে সিজার প্রবণতা বেশি। তারা বেশি সময় অপেক্ষা করতে চায় না। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে নরমাল ডেলিভারির ইচ্ছাটা বেশি।

এফএ/জেআইএম