চাঁদপুর সদর উপজেলার খেরুদিয়া বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেন। গর্ভবতী স্ত্রী আসমা বেগমকে গত ১৪ ডিসেম্বর চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান। প্রথমবারের মতো বাবা হতে যাচ্ছেন, তাই অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। স্ত্রীর সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য মানসিকভাবে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। কিন্তু বাঁধ সাধলেন হাসপাতালে এসে। ডাক্তার ও নার্স যাবতীয় চেকআপ করে জানালেন নরমালে সন্তান প্রসবের সব সম্ভাবনা রয়েছে তার। পরে ১৫ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় নরমালে ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন আসমা বেগম। নবজাতকের মুখ দেখে পরিবারে আনন্দের সীমা নেই।
Advertisement
নাতির মুখ দেখে আনন্দিত আয়েশা বেগমের মা রোকেয়া বেগম জাগো নিউজকে জানান, হাসপাতালের তৎপরতা দেখে আমরা অনেক খুশি। হয়তো অন্য কোথাও গেলে সিজার করতো। যদিও আমরা তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, তবে ডাক্তারের পরামর্শে নরমাল ডেলিভারি হওয়ায় অত্যন্ত খুশি।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে প্রতিনিয়তই হচ্ছে নরমাল ডেলিভারি। ফলে সরকারি জেনারেল হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি নবজাতকের মৃত্যুর হারও কমেছে অনেকটা। শুধু শহর নয়, গ্রামেও গর্ভবতী মায়েদের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি চিকিৎসকদের।
চাঁদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, চাঁদপুরে নভেম্বর মাসে মোট ৩২০টি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। বিপরীতে সিজারিয়ান হয়েছে মাত্র ৬৬টি। জেলার সদর হাসপাতালসহ সাত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসব ডেলিভারি সম্পন্ন হয়। যার মধ্যে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে নভেম্বরে ১৯৩ নরমাল ডেলিভারি সম্পন্ন হয়।
Advertisement
এছাড়াও ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আট, হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১, হাজিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৬, কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৯, মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩৪, মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ০ ও শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৯ জন প্রসূতির নরমাল ডেলিভারি হয়েছে।
অপরদিকে সিজারের মাধ্যমে শিশু জন্মের হার চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ৩৯, ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩, মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৭, মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২ ও শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে আরো জানা গেছে, গত ছয় মাসে চাঁদপুরে মোট ১৬৬৯টি নরমাল ডেলিভারি সম্পন্ন হয়েছে। যার মধ্যে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ৮৩০, ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯২, হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২১৮, হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৫২, কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭৭, মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৮৮, মতলব উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৬ ও শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৬টি নরমাল ডেলিভারি সম্পন্ন হয়েছে।
অপরদিকে ১৬৬৯ নরমাল ডেলিভারির বিপরীতে মাত্র ২৮৪টি নবজাতক সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে পৃথিবীর মুখ দেখেছে। যার মধ্যে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ১৭১, ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৯, মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৮, উত্তর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২টি ও শাহরাস্তি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৪টি সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়।
Advertisement
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে গত ছয় মাসের তথ্য অনুসারে প্রতি মাসেই বৃদ্ধি পাচ্ছে নরমাল ডেলিভারির পরিসংখ্যান। বিষয়টিকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাসপাতালে দেওয়া তথ্য সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে জুন মাসে ১০৮টি, জুলাই মাসে ৯৪টি, আগস্ট মাসে ১০৬টি, সেপ্টেম্বর মাসে ১৪৮টি, অক্টোবর মাসে ১৮১টি এবং সর্বশেষ নভেম্বর মাসে ১৯৩টিসহ ৬ মাসে মোট ৮৩০টি নরমাল ডেলিভারি করা হয়েছে।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের গাইনি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডাক্তার আঞ্জুমান আরা বেগম ও ডাক্তার নুসরাত জাহান জাগো নিউজকে জানান, হাসপাতালে একজন মা যখন ভর্তি হন আমরা প্রথমেই তার শারীরিক চেকআপ করে থাকি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হই তার নরমাল ডেলিভারি সম্ভব কিনা। আমরা কাউকেই প্রথমে সিজার করার কথা বলি না। যে রোগীর উচ্চ রক্তচাপ এবং নবজাতকের পজিশনের সমস্যা থাকে তাদেরকে সিজারের পরামর্শ দিয়ে থাকি।
তাছাড়া চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে শুধুমাত্র নরমাল ডেলিভারি জন্য ১২ জন মিডওয়াইফ নার্স রয়েছেন, যারা তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করছেন ও নরমাল ডেলিভারির জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
অপরদিকে বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারি করার মতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সের সংখ্যা একেবারেই কম। এক্ষেত্রে হাসপাতালে থাকা অন্যান্য নার্সরা অনেক সময় গর্ভবতী মায়েদের নরমাল ডেলিভারির দায়িত্ব নিতে সাহস করে না। তাই প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে সিজার অপারেশনের সংখ্যাটা বেশি হয়।
তিনি আরও বলেন, মূলত পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে অনেকে দুইটি বাচ্চার বেশি নেবে না চিন্তা করেও সিজারিয়ান অপারেশনের দিকে ঝুঁকছে। পাশাপাশি অনেকে দীর্ঘদিন সন্তানের জন্য মুখিয়ে থাকার পর যখন কনসিভ করে তখন তারা মূলত আর কোনো রিস্ক নিতে চায় না এবং সরাসরি সিজারের দিকেই আগ্রহী হয়। এক্ষেত্রে তাদের আরো সচেতন হতে হবে।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক একেএম মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে যেকোনো গর্ভবতী মা এলেই আমরা প্রথমে তার নরমাল ডেলিভারির সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ৭ থেকে ১০ জন গর্ভবতী মায়ের নরমাল ডেলিভারি সম্পন্ন হচ্ছে। আমরা মায়েদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট ও পর্যাপ্ত বেড না থাকায় অনেক সময় গর্ভবতী মায়েদের ফ্লোরে চিকিৎসা দিতে হয়।
তিনি বলেন, অতীতে একসময় সিজারিয়ান অপারেশন ছিল না। তখন মায়েরা প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদের সন্তানদের জন্ম দিয়েছেন। এখন অনেক মায়েরা প্রসবকালীন ব্যথাকে ভয় পেয়ে প্রথমেই সিজারিয়ান অপারেশনের কথা চিন্তা করে। কিন্তু সেটা তাদের শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর তারা তা বুঝতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন করতে আরো বেশি প্রচার প্রচারণা প্রয়োজন। যাতে তারা নরমাল ডেলিভারি ভয় না পায়।
তিনি বলেন, প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে মূলত ডাক্তারের চাইতে ওই হাসপাতাল কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত দালালদের কারণেই বেশি সিজার করতে হয়। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর দালাল চক্র এতটাই বিস্তৃত যে প্রতিটি গ্রামে গ্রামে তাদের লোক রয়েছে। তারা গর্ভকালীন মায়েদের ভুল বুঝিয়ে অনেক সময় প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করায় এবং কোনো কিছু বোঝার আগেই সিজারের পরামর্শ দেয়।
চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাক্তার মো. শাহাদাৎ হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, দিন দিন নরমাল ডেলিভারি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়টি অবশ্যই সুন্দর এবং ভালো একটি দিক। তবে এখনো অনেকে বাড়িতে নরমাল ডেলিভারি করে থাকেন যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমি তাদের পরামর্শ দেবো বাড়িতে নয় হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারি করতে পারেন। এক্ষেত্রে মা ও নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটাই কম থাকে।
এফএ/এএসএম