একটি দেশের রাজধানী যেমন হওয়া উচিত ঢাকা তার ধারেকাছেও নেই। এখানে নাগরিক সুবিধা বলতে তেমন কিছু নেই। বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন দুর্গতি নিয়ে নাগরিকরা এই শহরে বসবাস করছেন। যানজট, বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, বর্জ্যদূষণ, খাল দখল, নদী দখল, সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির দুর্ভোগসহ এমন কোনো সমস্যা নেই, যা এই নগরীতে নেই।
Advertisement
রাজধানীর সড়কে যানজট সমস্যার যেন কোনো সমাধান নেই, বরং দিন দিন তা প্রকট আকার ধারণ করছে! একদিকে রাস্তাগুলো সংকুচিত হচ্ছে; অন্যদিকে বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি অটোরিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, রিকশা, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, মালবাহী ভ্যান, কাভার্ডভ্যান, ঠেলাগাড়ি ও ট্রাকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা কম থাকায় সাধারণ মানুষের চলাচলে ভোগান্তি আরও বেশি। এখানে সকাল হোক বা রাত, গণপরিবহনে বিশেষ করে বাসে উঠতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নামতে হয়।
প্রয়োজনে পাওয়া যায় না সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্যাক্সি, রিকশা। বৃষ্টি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সমাবেশ বা বড় কোনো পরীক্ষা থাকলে রাজধানীতে যাত্রীদের অবস্থা হয় আরও করুণ।
যানজটসহ চলাচলে নানা প্রতিবন্ধকতার শহর ঢাকায় যখন এ অবস্থা তখন কিছুটা স্বস্তির বার্তা দেয় রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো। পাঁচ বছর আগে কর্মব্যস্ত শহরে নগরবাসীর যাতায়াত ব্যবস্থাকে নিরাপদ, স্বস্তিদায়ক করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাজারে আসে অ্যাপভিত্তিক দেশের প্রথম রাইড শেয়ারিং কোম্পানি উবার। একে একে পাঠাও, ওভাইসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান এসেছে। তবে অধরাই রয়ে গেছে যাত্রীদের আরামদায়ক যাতায়াতের স্বপ্ন।
Advertisement
অল্প সময়ের মধ্যেই রাইড শেয়ারিং ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্ত ভাড়া, ডিজিটাল পেমেন্টে রাজি না হওয়া ও যাত্রী হয়রানি ইস্যুতে চালক, যাত্রী ও প্রতিষ্ঠান একে অপরকে দুষছেন। এভাবেই যুব কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাময় খাত রাইড শেয়ারিং বাংলাদেশে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
নানা সমস্যা আর অভিযোগে জর্জরিত খাতটি করোনা মহামারিতে আরও সমস্যায় পড়েছে। করোনার কারণে দীর্ঘদিন রাইড শেয়ারিং বন্ধ থাকায় টিকে থাকতে লড়াই করছে এ খাতের পরিষেবা প্রতিষ্ঠানগুলো। আয়ের একটি বড় অংশ কমিশন হিসেবে প্রতিষ্ঠানকে দিতে হয় বলে চালকরা অ্যাপ ব্যবহার করতে চান না। চুক্তিভিত্তিক ছাড়া যেতে চান না অধিকাংশ চালক। এছাড়া ডিজিটাল পেমেন্ট না নেওয়া, রাইড অর্ডার বাতিলসহ নানা অভিযোগ রয়েছে চালকদের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেগাসিটিগুলোতে যানজট এড়াতে দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও অলস পড়ে থাকা গাড়ি দিয়ে বাড়তি আয় করা রাইড শেয়ারিংয়ের উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলাদেশে লাখো বেকার যুবক রাইড শেয়ারিংকে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে নিয়েছেন। তবে সরকারের নজরদারি না থাকায় সম্ভাবনার এ খাতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
ট্রাফিক পুলিশের এক হিসাবে দেখা গেছে, রাজধানীতে রাইড শেয়ারিং করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন চার লাখেরও বেশি চালক।
Advertisement
ফাইল ছবি
২০১৬ সালের শেষে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাও। একই সময় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উবার বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে এ দুটো কোম্পানি সিংহভাগ বাজার দখল করে রেখেছে। এছাড়া ওভাই, পিকমি, ডিজিটাল রাইড, সহজসহ ১০টির মতো রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান আছে বাংলাদেশে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী রিতু বলেন, নিরাপত্তার কারণে গাড়িতে চুক্তিভিত্তিক যেতে চায় না। অন্যদিকে ডিজিটাল পেমেন্ট মেথড ব্যবহার করায় অনেক চালক রাইড বাতিল করে দেন, বলেন নগদ টাকা ছাড়া যাবেন না। এছাড়া গন্তব্য শুনে বাতিল করার বিষয় তো আছেই।
আলমগীর খান নামের এক যাত্রী বলেন, উবার অ্যাপের মাধ্যমে ডাকার পর অনেক চালক বিকাশে পেমেন্ট নেবেন না বলে ট্রিপ বাতিল করেন। অনেকেই বলেন, তাদের বিকাশ অ্যাকাউন্ট নেই।
ঢাকা রাইড শেয়ারিং ড্রাইভার ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, একজন চালক দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। দিনে সর্বোচ্চ এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। কিন্তু এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি টাকা জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণে চলে যায়। অ্যাপভিত্তিক প্ল্যাটফর্মগুলো ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন নেয়।
তিনি বলেন, বিনা অজুহাতে অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাস শেষে ধারদেনা করে গাড়ির কাজ (সার্ভিসিং) করতে হয়। বছর শেষে তুলতে হচ্ছে লোন। এতে আমরা দিন দিন দেউলিয়া হচ্ছি।
ব্যাংক হয়ে চালকদের পকেটে ঢাকা আসতে দেরি ও কোম্পানিগুলোর ভাড়া অনিয়মের কারণে অনেক চালক বাধ্য হয়ে খ্যাপ বা চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালান বলে অভিযোগ তার।
বেলাল আহমেদ আরও বলেন, মনে করুন যাত্রী নিয়ে ৮ কিলোমিটার দূরত্বে কোথাও গেলাম। গাড়ি অনুযায়ী সেটার বেইজ ফেয়ার হবে ৫০ টাকা। প্রতি কিলোমিটার ভাড়া হবে ২০ টাকা। আট কিলোমিটারে ১৬০ টাকা। প্রতি মিনিট ওয়েটিং চার্জ ৩ টাকা। ধরি, সেখানে যেতে আমার ৩০ মিনিট জ্যামে কেটেছে। তাহলে ভাড়া হওয়ার কথা ৫০+১৬০+৯০ অর্থাৎ ৩০০ টাকার মতো। কিন্তু সেখানে আমার ভাড়া আসে ২০০ টাকা বা ১৮০ টাকা। অভিযোগ করেও প্রতিকার পাইনি। আমরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। ২৫ শতাংশ কমিশন দিয়ে ঢাকার মতো যানজটের শহরে রাইড শেয়ার করা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি।
চালকদের সামাজিক স্বীকৃতি প্রদান, কমিশন ১৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা ও পুলিশি হয়রানির অভিযোগ তুলে এরই মধ্যে একবার কর্মবিরতি পালন করেছেন সংগঠনটির সদস্যরা।
এদিকে, গত ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, অ্যাপসে রাইড শেয়ারিং না করে চুক্তিভিত্তিক যাত্রী পরিবহন করলে সংশ্লিষ্ট চালক ও যাত্রীর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বেলাল আহমেদ বলেন, আমরাও অ্যাপে গাড়ি চালাতে চাই। তবে সেক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে কমিশন কমাতে হবে।
করোনার ধাক্কা ও চুক্তিভিত্তিক চালানোর প্রবণতায় অ্যাপ ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা।
ফাইল ছবি
অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল রাইডের অপারেশন ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এখন অল্প করে রাইড হচ্ছে। করোনাকালীন অনেক পিছিয়েছে রাইড শেয়ারিং। নিরাপত্তার কথা না ভেবে যাত্রী, চালকরা খ্যাপে ঝুঁকে গেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশন নেওয়ায় চালকরা খ্যাপে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
তিনি বলেন, করোনাকালে সব যখন বন্ধ ছিল তখন চালকরা রুটি-রুজির জন্য মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে খ্যাপ দিয়েছেন। বিআরটিএ এটা নিষিদ্ধ করে আইনও করেছে। কিন্তু ২৫ শতাংশ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তারা খ্যাপে যাচ্ছেন।
শহীদুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা ১৫ শতাংশ কমিশন নিচ্ছি, তবে চালকদের অনেক অফার দিচ্ছি। এভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকছি। চালকরা কার থেকে বেশি সুবিধা নিতে পারবেন সেই ধরনের প্রতিযোগিতা করছেন। গ্রাহকরা অভিযোগ করছেন যে চালকরা ডিজিটাল পেমেন্টে নিতে চাচ্ছেন না। আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি।
ওভাই সলিউশনের করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের সিনিয়র ম্যানেজার সৈয়দ ফখরুদ্দিন মিল্লাত জানান, মহামারি চলাকালে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বাজারের চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে যুক্তিসঙ্গত নতুন কৌশল নিয়ে সামনের দিকে এগোচ্ছে ওভাই।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অক্ষমতার জন্য রাইড শেয়ারিংয়ের মতো পরীক্ষিত খাত এলোমেলো হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, এটা এখন না রাইড শেয়ার না চুক্তিভিত্তিক, অগোছালো জিনিস হয়ে পড়েছে।। আমি খুব আশাবাদী ছিলাম রাইড শেয়ারিং নিয়ে। ভেবেছিলাম আর গাড়ি ব্যবহার করবো না। বিদেশে আমার অনেক বন্ধু রাইড শেয়ার করে। তবে দেশে এ খাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চালকরা এখন চুক্তিভিত্তিক হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, যখন রাইড শেয়ার চালু হলো, তখন এটাকে নিয়ম-কানুনের মধ্যে রাখতে বিআরটিএকে অনুরোধ জানিয়েছি। দু-একটা প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনা সহজ। একসঙ্গে যদি দুই লাখ গাড়ি বিশৃঙ্খলায় চলে তাহলে তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এ খাতে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা ভর করেছে। উন্নত দেশে কারও হয়তো গাড়ি আছে, সে অফিসে যাওয়ার পথে খালি গাড়িতে দু-একজনকে তুলে নেন বা শেয়ার করেন। বাংলাদেশে রাইড শেয়ারিং বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করেছে। এটাকে প্রকৃতপক্ষে রাইড শেয়ার বলা যায় না। রাইড শেয়ারিং এখানে বাণিজ্যিক রূপ পেয়েছে। এখানে স্পষ্ট বাণিজ্যিক নীতিমালা প্রয়োজন ও হয়রানি থেকে যাত্রীদের মুক্তি দিতে গাইডলাইন করা প্রয়োজন।
এসএম/কেএসআর/এসএইচএস/এমএস