দেশজুড়ে

নিজেই এখন অর্থ সংকটে ২০ জনকে চাকরি দেওয়া আনিছুর

এক সময় উৎপাদনে ছিল নওগাঁর মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে আনিছুর রহমানের ‘মান্দা ক্রাফট’ নামের পাটজাত পণ্য তৈরির কারখানা। ২০ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল এ কারখানায়। সরকারি পাটকলগুলো যখন লোকসান গুনছে, সেই অসময়েও হাতে তৈরি পাটপণ্য তৈরি করে সফলতার মুখ দেখেছিল। তবে করোনা মহামারিতে পুঁজি হারিয়ে উৎপাদনে ধস নেমেছে কারখানাটিতে।

Advertisement

কাঁচমালের বাড়তি মূল্য এবং কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় বর্তমানে চরম অর্থ সংকটে রয়েছে ‘মান্দা ক্রাফট’। অর্থ সংকটে এরই মধ্যে চারটি সেলাইমেশিন বিক্রি করা হয়েছে। পাটজাত দ্রব্য থেকে তৈরি এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে সুদমুক্ত ঋণের দাবি জানিয়েছেন কারাখানার মালিক আনিছুর রহমান।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় আনিছুর রহমান। অভাবের সংসার। লেখাপড়া করার ইচ্ছে থাকলেও তা আর সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরপর লেখাপাড়ার ইতি টেনে ১৩ বছর বয়সে ঢাকায় গিয়ে ব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। সেখানে প্রায় ১৫ বছর কাজ করেন। এরপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করে শাহিনুর বেগমকে।

স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার নবীনগরে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। একটি সেলাই মেশিন দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে নিজেই কাজ শুরু করেন ব্যাগ তৈরির। সেখানেই ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন আবার বিভিন্ন দোকানেও পাইকারি দিতেন। অনেক ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে ব্যাগ তৈরি করে নিতেন। সেসময় ব্যবসা বেশ লাভজনক ছিল। আনিছুর ভাবলেন এবার গ্রামে গিয়ে এ ব্যবসায় আরও মনোযোগ দেবেন এবং কারখানা স্থাপন করবেন।

Advertisement

২০১২ সালে গ্রামে চলে আসেন। একটি তাঁত স্থাপন ও দুইটি সেলাই মেশিন দিয়ে শুরু করেন লাঞ্চ ব্যাগ, ভ্যানিটি ব্যাগ, স্কুলব্যাগ, ম্যানিব্যাগ, লেডিস ব্যাগ ও পার্স তৈরির কাজ। নিজেই জেলার মহাদেবপুর, নজিপুর, নিয়ামতপুর ও রাজশাহী শহরসহ বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করেন। ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী মিলে এসব তৈরি করে আসছিলেন।

আনিছুর রহমানের তৈরি পাটপণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকায় ব্যবসার পরিধিও বাড়তে থাকে। এরপর ২০১৮ সালে আরও পাঁচটি তাঁত স্থাপন এবং চারটি সেলাই মেশিন কেনা হয়। সেলাই মেশিনে ছয়জন নারী, তাঁতে পাঁচজন, সুতা উঠানো চরকায় তিনজন এবং বিক্রয় প্রতিনিধি হিসবে ছয়জন পুরুষ নিয়োগ দেন। শ্রমিকরা মজুরি পেতেন সেলাই মেশিনে ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা, তাঁতে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা, চরকায় ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা এবং সেলসম্যানরা পেতেন ২০০ টাকা করে।

প্রতিনিধিদের দিয়ে পাটপণ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, স্বপ্নপুরী, ভিন্নজগৎ, মহাস্থানগড়, বগুড়া নিউ মার্কেট, রাজশাহী নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করে দিনে প্রায় ২০০০ টাকা লাভ হতো। এই পাটপন্যের ব্যবসা করেই আড়াই কাঠা জমি কেনাসহ সেখানে আধাপাকা ইটের ঘর করেছেন আনিছুর রহমান। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে এবং এক ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন।

গতবছর থেকে করোনাভাইরাসের কারণে লাগাতার লকডাউন শুরু হয়। এতে দোকানপাট বন্ধ ছিল। ফলে কারখানায় পণ্য উৎপাদন কমতে থাকে। এছাড়া সেসময় ফেরি করে বিক্রি করার মতো পরিবেশও ছিল না। দীর্ঘদিন ঘরের মধ্যে তাঁতগুলো বন্ধ থাকায় মাকড়সার জালের স্তূপ জমেছে।

Advertisement

কারখানার মালিক আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসার পরিধি আরও বাড়ানোর জন্য কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৮০ হাজার টাকা এবং দুটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে আরও ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। করোনাভাইরাস শুরু হলে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউনে যানবাহন বন্ধ থাকায় দূরে গিয়ে ফেরি করে বিক্রি করার মতো ব্যবস্থা ছিল না। ব্যবসার পরিমাণ আস্তে আস্তে কমতে থাকলো। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকায় জমা করা এবং ঋণের টাকা খেয়ে-পরে শেষ হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছরের আগস্টে স্ত্রী হঠাৎ করে স্ট্রোক করে মারা যান। এরপর সংসারে অশান্তি শুরু হয়। দুই মাস আগে মেয়ে আঙ্গুরি আক্তারের বিয়ে দেওয়া হয়। ছেলে শাহিন আলম নবম শ্রেণিতে পড়ছে। বাড়িতে আমি ও ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। অভাবের তাড়নায় চারটি সেলাইমেশিন বিক্রি করে দিয়েছি। কিছুদিন আগে মান্দা ইউএনও কার্যালয় থেকে ৩০টি লাঞ্চ ব্যাগের অর্ডার পেয়েছিলাম। নিজেই একটা তাঁতে চট তৈরি করে ব্যাগের কাজ করে দিয়েছি। আয়-রোজগার না থাকায় এখন খাওয়া-পরাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে।’

এ অবস্থায় কারাখানাটিকে টিকিয়ে রাখতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে সুদমুক্ত ঋণের দাবি জানিয়েছেন কারাখানার মালিক আনিছুর রহমান।

নারীশ্রমিক মর্জিনা, আনোয়ারা ও খোরশেদা জাগো নিউজকে বলেন, গ্রামে কারখানাটি করার পর থেকে আমরা এখানেই কাজ শিখি। দিনে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা আয়ও করতাম। স্বামীর পাশাপাশি বাড়তি আয় করে সংসারে উন্নতি করতাম। কিন্তু করোনাভাইরাস আসার পর থেকে কাজ কমতে থাকে। এখন মালিকের কাজ একেবারেই বন্ধ। আমাদের মতো আরও অনেকের কাজ বন্ধ হয়ে আছে। সামান্য কিছু কাজ থাকলে মালিক একাই করেন। এখন মালিকই কষ্টের মধ্যে আছেন।

একই গ্রামে পাটপণ্য বিক্রি করে গত ২০ বছরে ধরে সংসার চালাচ্ছেন শহিদুল ইসলাম। বর্তমানে পাটপণ্য তৈরি না করে তিনটি তাঁত মেশিনে দিয়ে চট তৈরি করছেন। করোনা মহামারিতে তার কারখানায়ও প্রভাব পড়েছে।

শহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, করোনার মধ্যে দুদফায় সাতমাস কারখানাটি বন্ধ ছিল। কাজ করে মহাজনদের দেবো এমন অবস্থা ছিল না। বর্তমানে ব্যবসাকে টিকিরে রাখার স্বার্থে শুধু চট তৈরি করছি।

তিনি বলেন, হস্তশিল্পের কাঁচামাল এবং নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন পুঁজি সংকটে পড়েছি। পাটজাত দ্রব্য থেকে তৈরি ক্ষুদ্র এ কুটিরশিল্পকে টিকিয়ে রাখা এখন কষ্টকর হয়ে উঠেছে। সরকার থেকে সুদমুক্ত ঋণ দিলে বড় পরিসরে এ ব্যবসা শুরু করা যেতো। কিন্তু অর্থাভাবে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

এ বিষয়ে মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু বক্কর সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনায় তাদের ব্যবসায় যে ধস নেমেছে তা তার জানা নেই। তবে তারা যদি কারখানা চালুর উদ্যোগ নেন এবং আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।’

আব্বাস আলী/এসআর/জেআইএম