লাইফস্টাইল

বিবাহবিচ্ছেদের কারণ ও প্রতিকার

জেসমিন সুলতানা

Advertisement

বিয়ে একটি সামাজিক বন্ধন, একটি বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে নারী পুরুষ দুজন দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন করে। কখনো পারিবারিক সম্মতিতে, আবার কখনো নিজেদের পছন্দে। দেশ, কাল-পাত্র-ধর্ম, বর্ণভেদে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা অনেকটাই ভিন্ন হয়ে থাকে।

বিয়ে জীবনের জন্য কতোইনা গুরুত্বপূর্ণ যার মাধ্যমে নারী পুরুষ একত্রে বৈধভাবে মিলিত হয়। রচনা করে স্বপ্নের সুখী নীড়। গড়ে তোলে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন।

সবাই চায় তার বিবাহিত জীবন সুখী হোক, জীবন মরণে দু’জন মিলে কাটিয়ে দিক সফল জীবন। গড়ে তুলুক স্বপ্নীল একটি সুখের ঘর, তাদের নিয়ে রচিত হোক ভালবাসার প্রেমময়, আবেগবহুল কাহিনি।

Advertisement

বিধিবাম হলে বিয়ের পর নারী-পুরুষ যেমন সংসার শুরু করে, তেমনই শুরুর পর পরও অনেক সময় দেখা দেয় বিচ্ছেদের ঘণ্টাধ্বনি। কেন বিবাহবিচ্ছেদ, কেনই বা সংসার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না? আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে আমার দেখা কারণগুলো তুলে ধরছি একেবারে নিরেট অভিজ্ঞতার আলোকে।

>> শারীরিক অক্ষমতা, যৌন ব্যাধি, যৌনবিকারগ্রস্ত স্বামী বিবাহবিচ্ছেদের একটি অন্যতম কারণ, এটি লজ্জা কিংবা গোপন করার বিষয় নয়।

>> যৌতুক আমাদের দেশের জন্য এক সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ অনুসারে বরপক্ষ বা কনেপক্ষ যেকোন পক্ষের নিকট যৌতুক দাবীই অপরাধ হিসেবে গন্য।

যৌতুকের জন্য স্বামী, স্বামীর পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয় নারী, কখনো মৃত্যুর মাধ্যমেও যৌতুকের বলী হতে হয় তাকে। যৌতুক দাবী কিংবা নির্যাতনের কোন বয়স বা সময় নেই। ৩৫ বছরের সংসারও ছেড়ে আসতে দেখা যায় নারীকে বিয়ে বিচ্ছেদের মাধ্যমে।

Advertisement

>> বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে ১৮ বছরের মেয়ে, ২১ বছরের ছেলের বিয়েকে বাল্যবিয়ে হিসেবে গন্য করা হয়েছে। গত দু'বছরে করোনা সময়ে বাল্য বিবাহ বেড়েছে ভয়াবহভাবে। স্কুল বন্ধ, বাবা মা ১৮ বছর উঠতি বয়সী মেয়েকে দিয়েছেন বিয়ে, অনেকটা ঝঞ্ঝাটমুক্ত হওয়ার জন্য।

আবার ছোট ছেলে-মেয়েদের অনেকেই নিজে পছন্দ করে পালিয়ে গিয়ে কিংবা বাবা মায়ের সম্মতিতে বিয়ে করে। নাবালিকা কন্যা বিয়ের পর তার লালিত স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে যখন মিল খুঁজে পায়না, যখন তার স্বপ্ন ও প্রত্যাশা ভেঙ্গে যায়, তখনই বেছে নেয় বিবাহবিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্ত।

>> অনেক সময় দেখা যায় স্বামী গোপনে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ, সংসারের প্রতি দায়িত্বহীনতা, উদাসীনতা স্ত্রীকে কাঁদায়। সংসার-সন্তান থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় স্বামীর বহু বিবাহ মেনে নেওয়া অনেক স্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হয়না। ফলে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।

>> বর্তমানে ডিজিটাল যুগের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন। এক্ষেত্রে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো ইত্যাদি সহজলভ্য হওয়ায় সবাই অতিসহজেই পেয়ে যাচ্ছেন নতুন সঙ্গী।

ফলে পরকীয়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। গড়ে তুলছেন এক্সট্রা-ম্যারিটাল সম্পর্ক। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য। অন্যপুরুষ বা নারীতে আসক্ত পরিবারে সব সময় অশান্তি, নির্যাতন, অবিশ্বাস নিত্যদিনের ঘটনা। একসময় উভয়পক্ষ বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পথ বেছে নেয়।

>> মাদকাসক্তের কারণেও দাম্পত্য জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে। বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আসা অধিকাংশের কাছ থেকে জানা যায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি অমানুষে পরিণত হয়। আর এমন মানুষের সঙ্গে সংসার করা যখন সম্ভব হয়না তখনই ঘটে বিবাহয়ে বিচ্ছেদ।

>> বিবাহবিচ্ছেদের আরও একটি কারণ হলো সন্দেহ, বিপথগামী স্বামী স্ত্রী ও বহুগামিতা। স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনকে সন্দেহ করা একটি মানসিক ব্যধি। সন্দেহ যখন নিঃস্বন্দেহভাবে ধরা দেয়, বাস্তবে রূপ নেয় তখন বিয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় দম্পতিরা।

>> দেশের প্রচলিত আইনে শারীরিক নির্যাতন অপরাধ, শাস্তির বিধান আছে, তবে মানসিক নির্যাতনের কোনো শাস্তি নেই। শারীরিক নির্যাতন দৃশ্যমান কিন্তু মানসিক নির্যাতন অদৃশ্যমান টর্চার সেলের চেয়েও ভয়ংকর।

দেশ কিংবা বিদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত নারীকে যখন সংসার কিংবা সন্তান লালন পালনের অজুহাতে ঘরে বসিয়ে দেয়, শিক্ষিত মেয়েটিকে আত্মনির্ভরশীল হতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় স্বামী বা তার পরিবার।

তখন সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয় ক্ষতিগ্রস্ত নারী। তাছাড়া স্বনির্ভর, আত্মসচেতন নারীরা এখন আর বাইরে কাজ করে এসে পারিবারিক নির্যাতন বা সহিংসতা মেনে নেয় না। ফলশ্রুতিতে বেছে নেয় বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত।

>> এ সমাজে অনেক নারীই নারীর শত্রু। বউ-শাশুড়ির সম্পর্কে চরম বৈপরীত্য সংসারে অশান্তির অন্যতম কারণ, সঙ্গে স্বামীর ভাই-বোন। অনেক সময় পুরুষরা তার বাবা-মা, ভাই-বোনের কথা শুনে কোন কিছু না ভেবেই স্ত্রীর উপর অত্যাচার করেন।

কখনো আবার মিথ্যা অপবাদে জর্জরিত করে ঘর থেকে বের করে দেয় নারীকে। অসহনীয় পর্যায়ে অনেক সময় আত্নহননের পথ বেছে নেয় নারী কিংবা বিচ্ছেদকেই মুক্তি হিসেবে মেনে নেয়।

এর বৈপরীত্যে যে নেই তা নয়, স্ত্রীর অতিরিক্ত লোভ, শ্বশুর-শাশুড়ি কিংবা স্বামীর পরিবারের সদস্যদের প্রতি অশ্রদ্ধা, সংসারের প্রতি উন্নাসিকতা, অতিরিক্ত লোভ, উচ্চাকাঙ্খা অনেক সময় সহ্যতীত হয়ে গেলে বিবাহবিচ্ছেদকে সঠিক পথ হিসেবে বেছে নেয়।

>> অনেক পরিবারে দেখা যায়, বিয়ের পর পরিবারে মুরব্বীদের অনধিকার চর্চা, কূটকচালী শিখানো, কুবুদ্ধি প্রদান, নিজেদের মনগড়ামতে সন্তানদের সংসার নিয়ন্ত্রণ করে। এক্ষেত্রে মা, শাশুড়ি অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। একসময় সম্পর্কের তিক্ততা বিবাহবিচ্ছেদ পথ খুলে দেয়।

>> অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্খা কিংবা লোভী নারী পুরুষ অর্থ,ক্ষমতা,সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লোভে তার চেয়ে তিনগুণ বয়সী নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। একসময় মোহ চলে যায় বা অক্ষম পুরুষ-নারী কিংবা অর্থ চাহিদাপূর্ণ হলে সে আবার নতুনের সন্ধানে বের হয়।

পরিত্যক্ত জনের বিদায় হয় একমাত্র বিয়ে বিচ্ছেদের মাধ্যমে। এ ছাড়াও সন্তানহীন নারীকে বেশিরভাগ সময় বিচ্ছেদের শিকার হতে হয়।

>> ডিজিটাল আধুনিক যুগের ছেলে-মেয়েরা একেবারেই ধৈর্য্যহীন, সামান্য বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে তারা সংসার নির্বাহ করতে চায় না। হুট করেই বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়।

সহ্য করার ক্ষমতা নেই বলে সামান্য কারণে ছেলে মেয়েরা বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয়। তারা বিবেক, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না।

বিবাহবিচ্ছেদ রোধের উপায়?

বিয়ে থেকেই বিচ্ছেদের উৎপত্তি। সব ধর্ম বা বর্ণের লোকের কাছে বিবাহবিচ্ছেদ নিকৃষ্ট কাজ। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তান। তাদের নীরব কান্না শোনার বা দেখার সময় কারো নেই। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে অনেক সময় সন্তান হয়ে যায় মানসিকভাবে ভারসাম্য হীন ও বদরাগী।

মানসিক বিষন্নতা ও অবসাদ তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। বনিবনা হবে না জেনে কেন সন্তান ধারণ করা? সন্তান তার বৃদ্ধির জন্য বাবা মা দুজনকেই চায়। দুজনের নির্মল স্নেহ ভালবাসা পেতে তাদের হৃদয় উন্মুখ থাকে। ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানদের দুঃখ-বেদনা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ জানে না।

যেহেতু তারা সুন্দর, স্বাভাবিক জীবনে বড় হতে পারে না, পরবর্তী জীবনেও তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সন্তান বাবা-মা দুজনকে জড়িয়ে নিয়েই বাঁচতে চায়। বাবা-মা দুজন যখন সন্তান দাবী করে সন্তানের করুণ দৃষ্টি, মানবিকগুণ সম্পন্ন সব মানুষকে বেদনা বিধুর করবেই।

সমস্যা যেমন আছে, উত্তরণেরও অনেক উপায় আছে। দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হলে প্রথমেই দুজন মিলে তার কারণ চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা নিজেদেরই করতে হবে।

ব্যক্তি সচেতনতা, সহনশীলতা, সমঝোতা করে বিশ্বাসের ভীত শক্ত করতে হবে। শান্তি, সুখ ও ভালবাসার নীড় সাজানোর জন্য উভয়কে ছাড় দিতে হয়। পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা, বিশ্বস্ততা, শ্রদ্ধা বোধ থাকা জরুরি।

বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বিবাহবিচ্ছেদ চরম আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই শত শত বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা হচ্ছে। এ সংবাদ পরিবার, সমাজ তথা দেশের মানুষের জন্য সুখকর হতে পারে না।

অনেকেই আইনবিধি নিয়ম-কানুনের ধারে কাছে না গিয়ে নোটিশ গোপন করে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা নিচ্ছেন। অনেকে ম্যাজিষ্ট্রেট কোর্টে, নোটারী পাবলিকের কার্যালয়ে বেআইনি, নিয়মবহির্ভূতভাবে তালাক প্রদান করছে।

বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশে বিয়ে ও তালাক দুটোরই ডিজিটালাইজেশন জরুরি। এতে কারও বিয়ে হলে অনলাইন যেমন জানতে পারবে, বিচ্ছেদ হলেও অনলাইনে বিষয়টি অবহিত করা জরুরি।

বাংলাদেশের প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন ও তালাক রেজিষ্ট্রেশন অনলাইন হওয়া সময়ের দাবী। তাতে করে প্রতারিত হওয়ার মাত্রা কমে যাবে যা নারী পুরুষ দুপক্ষের জন্যই মঙ্গলজনক ও কল্যাণকর।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

জেএমএস/জিকেএস