সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের সেরা পারফরমার। ভবিষ্যতের কথা জানি না, এখন পর্যন্ত তিনিই বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা। প্রতিভায় হয়তো তার চেয়ে ভালো কেউ কেউ ছিলেন। কিন্তু পারফরম্যান্স আর পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে সাকিবের ধারে কাছেও কেউ নেই।
Advertisement
এমনিতে অলরাউন্ডার বলতে আমরা বুঝি বোলার যিনি মাঝে মাঝে ব্যাট করেন বা ব্যাটসম্যান যিনি মাঝে মাঝে বোলিংও করেন। কিন্তু সাকিব আল হাসান ফুল প্যাকেজ। কখনো দলের সেরা ব্যাটসম্যান, কখনো সেরা বোলার। কখনো কখনো দুটিই। সাকিব আল হাসান দলে থাকলে বাংলাদেশ আসলে ১২ জন নিয়ে খেলার সুযোগ পায়। সাকিব না থাকলে একজন বাড়তি খেলোয়াড় নিতে হয়।
সাকিব আসলে গরিবের ঘরের রাজা। অনেকে বলেন, যে বনে বাঘ নেই, সেই বনে শিয়াল রাজা। কিন্তু সাকিবের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই এটা প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশের মতো দলের হয়ে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারের মর্যাদা পাওয়া সহজ নয়। তাকে সবসময় খেলতে হয় শক্তিশালী দলের বিপক্ষে। বাংলাদেশের হয়ে বেশিরভাগ সময় তাকে একাই লড়তে হয়। সাকিব সত্যিকারের বাঘ, সত্যিকারের রাজা।
কিন্তু এতকিছুর পরও সাকিবকে নিয়ে আমার আফসোসের শেষ নেই। সাকিব সমকালের সেরা হয়েছেন বটে, কিন্তু তার সামনে সুযোগ ছিল সর্বকালের সেরা হওয়ার। সোবার্স, বোথাম, ইমরান, কপিল, ক্যালিস- সবার নাম বিবেচনায় নিয়েও বলা যায় সাকিব চাইলে সর্বকালের সেরা হতে পারতেন। কিন্তু সাকিব বড্ড অবহেলায় সে সুযোগ হারাচ্ছেন। আসলে সর্বকালের সেরা হওয়ার গৌরবটাই যেন তাকে টানছে না। বরং আড়ালে-আবডালে সাকিব স্বীকার করেছেন, ক্রিকেট এখন আর তার প্রায়োরিটি তালিকায় নেই। নিছক বিজ্ঞাপন-অ্যান্ডোর্সমেন্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেই সাকিব এখনও ক্রিকেট খেলছেন।
Advertisement
আর সর্বকালের সেরা হওয়ার মূল প্ল্যাটফরম যেটা, সেই টেস্ট ক্রিকেট তিনি আর খেলতেই চান না। নানা অজুহাতে ছুটি নিয়ে নেন। এমনকি এবার নিউজিল্যান্ড সফরে দল ঘোষণার পর সাকিব ছুটি চেয়েছেন। বোর্ড সেটা দিতে বাধ্যও হয়েছে। এর আগে শ্রীলঙ্কা সফর থেকে ছুটি নিয়ে আইপিএল খেলতে গেছেন সাকিব। তারও আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ছুটি নিয়ে বিজ্ঞাপন করেছেন, নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন। যদি এমন হতো অতি জরুরি কাজে সাকিব ছুটি নিচ্ছেন, তাহলেও কথা ছিল না। কিন্তু সাকিব আসলে আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি আর টেস্ট খেলতে চান না। এমনকি অধিনায়কত্ব দিয়েও সাকিবকে আটকে রাখা যায়নি।
অনেক দিন ধরেই সাকিবের মূল প্রায়োরিটি অর্থ, ক্রিকেট নয়। তিনি দেশে-বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে ব্যস্ত। স্বর্ণ ব্যবসা, শেয়ারবাজার, রেস্টুরেন্ট, কৃষি ফার্ম, ইভেন্ট ম্যানেজমন্টে ব্যবসা ছড়িয়েছেন; এমনকি ব্যাংকের মালিকানাও নিচ্ছেন। ক্রিকেট শুধু তার অর্থ উপার্জনের মাধ্যম। তাই তো বাংলাদেশের হয়ে খেলার চেয়ে আইপিএল খেলা তার কাছে প্রাধান্য পায়।
শুধু অর্থ উপার্জনই নয়, তার গরম দেখানোতেও তার জুরি নেই। মাগুরা থেকে উঠে আসা সাকিব আল হাসান তার সন্তানদের পড়ানোর মতো কোনো স্কুল খুঁজে পান না বাংলাদেশে। পরিবারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেখে নিয়মিত দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলাটা তার জন্য কঠিনই বটে। একেকবার আমেরিকায় যেতে আসতে জ্যাট লেগে কেটে যায় ১৫ দিন। উৎপল শুভ্রকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাকিবের কণ্ঠে সেই আক্ষেপ, পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে রেখে দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলে যে তিনি কত বড় স্যাক্রিফাইস করছেন, সেটা কেউ বুঝতেই পারছেন না।
দিনের পর দিন পরিবারকে ছেড়ে থাকা সাকিবের জন্য অবশ্যই কষ্টের। আমরা চাই না সাকিবের মেয়ে তাকে মামা ডাকুক। কিন্তু এই পরিস্থিতি তো সাকিবই তৈরি করেছেন। কেউ তো তাকে পরিবার আমেরিকা পাঠাতে বাধ্য করেনি, যা অর্থ কামিয়েছেন, তাতে তার কয়েক প্রজন্ম কিছু না করলেও তা ফুরাবে না। তবু সেই সাক্ষাৎকারে সাকিব দাবি করেছেন, তার টাকার চাহিদা এখনও ফুরায়নি।
Advertisement
ক্রিকেট কিন্তু নিছক খেলা নয়। ক্রিকেট আসলে একটা সংস্কৃতি। ক্রিকেটের ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে, পরম্পরা আছে। কিন্তু আমাদের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার যখন ক্রিকেট ইতিহাস সম্পর্কে একদম উদাসীন থাকেন, তখন বুঝি ব্যাটিং-বোলিং পারলেও সাকিব কিকেটকে ধারণ করতে পারেননি। উৎপল শুভ্র জানতে চেয়েছিলেন, ‘ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে আপনার পড়াশোনা কেমন? আপনি কি গ্যারি সোবার্স, ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, ইমরান খানদের মতো গ্রেট অলরাউন্ডারদের সম্পর্কে জানেন? উত্তরে সাকিব বলেছেন, ‘না ভাই। নাম জানি। আর কিছু জানি না।’ সাকিবের উত্তর শুনে আমার মতো ক্রিকেট না বোঝা মানুষও অবাক হয়ে যাই।
উৎপল শুভ্রকে দেয়া সাকিবের সাক্ষাৎকার আমাকে খুব আহত করেছে। চলুন সাক্ষাৎকারের সেই অংশটা একটু দেখে আসি- প্রশ্ন: সাকিব, এই যে বাংলাদেশের ক্রিকেটে আমরা পঞ্চপাণ্ডব বানিয়েছি… না, আমরা বানাইনি, আপনারা খেলেই তা হয়েছেন…। উত্তর: আগে ক্লিয়ার করি, শোনেন, প্রথমে এক পাণ্ডব, তারপর বাকি চার-পাঁচ যা নাম দেন, দেন। প্রশ্ন: প্রথম পাণ্ডব কে? আপনি? উত্তর: আর কারও নাম আছে? প্রশ্ন: বয়স, ম্যাচুউরিটি, অনেক দিন খেলা, ওয়ানডে টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে পারফরম্যান্স সব মিলিয়ে মাশরাফির নামটাও হয়তো আসে। উত্তর: আমার কাছে তা মনে হয় না।
সাকিবের এ সাক্ষাৎকার পড়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের একজন অনুরাগী হিসেবে বেদনায় আমার বুক ভেঙে গেছে। সাকিবের মতো পারফরমারদের একটু অহঙ্কার বা ঔদ্ধত্য মানায়। কিন্তু এটা অহঙ্কার বা ঔদ্ধত্য নয়, এটা স্রেফ ছোটলোকামি। ক্রিকেট একটা টিম গেম। কিন্তু সাকিব বারবার প্রমাণ করেছেন তিনি টিমম্যান নন।
গত বিশ্বকাপের আগে স্টেডিয়ামে এসেও ফটোসেশনে অংশ নেননি সাকিব। এবার তিনি বুঝিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের আর কাউকে তিনি তার সমকক্ষ মনে করেন না। বক্সিং বা টেনিসে আপনি একা জিততে পারবেন। তবে টিম গেমে একা সবকিছু করা যায় না। তাই সাকিব বিশ্বসেরা হলেও বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতেই। সাকিব যা বলেছেন, পরিসংখ্যানের বিবেচনায় সেটা হয়তো সত্যি। সাকিবের ধারেকাছেও কেউ নেই। কিন্তু সেটা আমরা বললে ঠিক আছে। সাকিব নিজে বললে, যত সত্যিই হোক, সেটা ছোটলোকামিই। নিজে যাকে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সে হয়।
লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম