মতামত

এক আহাজারি থেকে আরেক আহাজারি

টেলিভিশন সাংবাদিকতার শুরুতেই জলে শত মরদেহ ভাসতে দেখেছি। চাঁদপুরের মোহনায় শরীয়তপুরগামী লঞ্চ ডুবে গিয়েছিল ২০০০ সালে। ঈদুল ফিতরের পরদিন। দমকল বাহিনীর সূত্রে খবরটি পাই। বেলা ১১টার দিকে ট্রলারে রওয়ানা হয়ে দুপুরে পৌঁছি।

Advertisement

ততোক্ষণে লাশ উদ্ধারকাজ শুরু হয়ে গেছে। চাঁদপুর ঘাটে শুইয়ে রাখা হয়েছে সারিসারি লাশ। লঞ্চ উদ্ধারকাজ চলছিল। লঞ্চডুবির ঘটনা সেবারই প্রথম কভার করি। তারপর ২০০১ সালে ষাটনলে ডুবে গেল এমভি সালাউদ্দিন। পাঁচদিন মেঘনার বুকে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজায় ছিলাম। দেখেছি ছয়শ লাশ।

এর ১৫ দিন পরই বলেশ্বরে ডুবে আরেকটি লঞ্চ। সেখানেও দেড়শ লাশ। চাঁদপুরে ডুবে এমভি নাসরিন। আরিচার যমুনায় নদী পারাপার লঞ্চ ডুবিও কভার করেছি। এই যে এতো লঞ্চ দুর্ঘটনা কভার করার ফিরিস্তি দিলাম, তার মূল কথা হচ্ছে প্রতি দুর্ঘটনায় স্বজনদের আহাজারি দেখতে হয়েছে যেমন, তেমনি দেখতে হয়েছে নৌযান তদারকি সংস্থাগুলোর লম্ফঝম্ফ। তদন্ত কমিটির তর্জন গর্জন।

লঞ্চডুবি মানেই মন্ত্রী-সচিব সঙ্গীদের নিয়ে ঘটনাস্থলে হাজির হবেন। সেখানে চলবে অনু চড়ুইভাতি। লঞ্চ উদ্ধার, শবদেহ হস্তান্তর শেষ যেখানে, সেখানেই তদন্তের ইতি। প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ফাইল ঘোরাফেরা করলেও, তার কোনো ফলন নদীপথে গিয়ে পৌঁছে না।

Advertisement

ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ লঞ্চ, এক ইঞ্জিনের লঞ্চের দুই ইঞ্জিন লঞ্চের আকার নিয়ে চলাচল, নকশার ত্রুটি নিয়েই নৌযান চলছে। সঙ্গে আছে বাল্কহেড নামে ভয়ঙ্কর যান। বাল্কহেডের জন্য লঞ্চ ইস্টিমার দিনে রাতে চলাচলে সমস্যা হয়। সারেংরা এনিয়ে অভিযোগ করে আসছে বহুদিন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এখনো নদীপথে বাল্কহেড চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে পারেনি। চলাচলে শৃঙ্খলা নেই লঞ্চেরও। অধিকাংশেরই কুয়াশাভেদকারী বাতি নেই। বাতি ছাড়াও চলাচল করে বেশকিছু লঞ্চ।

বিশাল জলরাশির নদীরও মাঝে নির্দিষ্ট করা আছে পথ। সেই পথ সংকীর্ণ নাব্য সংকটের কারণে। সেই সংকীর্ণ পথেই লঞ্চগুলো বেপরোয়া ভাবে একে অপরকে ডিঙিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করে। লুকিয়ে নয় প্রকাশ্যেই। দুর্ঘটনার ঘটছে নিয়মিত। কিন্তু নিয়ন্ত্রক ও তদারক সংস্থা হয়তো কুয়াশা বা অমাবস্যায় কিছুই দেখতে পায় না।

আমরা এতো দিন লঞ্চ দুর্ঘটনায় যাত্রীদের নিমজ্জন দেখেছি। ভেসে উঠতে দেখেছি মরদেহ। কিন্তু জলের ওপর ভেসে চলা জলযানে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু দেখলাম প্রথম। জলযানে রান্নাঘর, ইঞ্জিন আছে। সেখানে যে কোনো অসাবধানতায় বা দুর্ঘটনাবশত আগুন লাগতেই পারে। কিন্তু আগুন লাগলে সেটা দ্রুত নিভিয়ে ফেলারও আয়োজন জলযানে থাকতে হবে শতভাগ।

প্রশিক্ষণের দরকার লঞ্চের কর্মীদের। বরগুনাগামী জলযানটিতে এসব কোন আয়োজনই ছিল না। উল্টো অভিযোগ এসেছে ঝালকাঠিতে সুগন্ধা নদীর যেখানে আগুনের সূত্রপাত, সেখানেই যদি কূলে ভেড়ানো হতো, তাহলে হয়তো দুর্ঘটনা এতো ভয়াবহ হয়ে উঠতো না। প্রাণহানিও কম হতো। কিন্তু সারেং লঞ্চ চালিয়েই গেছেন।

Advertisement

তীর দূরে থাক, ঘাট সামনে পেয়েও থামাননি। ফলে আগুন বেড়েছে। একটি সময় মনে হয়েছে লঞ্চের কর্মীরা হাল ছেড়ে দিয়েছে, যা হবার তাই হবে এই ভেবে। কিন্তু যাত্রীরা জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন। যারা সাঁতার জানতেন তারা, এবং জানেন না এমন যাত্রীও দগ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ এখনও নিখোঁজ।

এবারও তদন্ত কমিটি হয়েছে। দুর্ঘটনা এলাকা, পুড়ে যাওয়া লঞ্চে একাধিকবার পরিদর্শন হবে। সেই সঙ্গে বলে দেয়া যায়-স্বাভাবিক ভাবে ত্রুটিযুক্ত লঞ্চও চলাচল করবে নৌপথে। কোথাও কোন মেরামত বা সংশোধন দেখা যাবে না। আমরা শুধু এক আহাজারি থেকে আরেক আহাজারি বা স্বজন হারানোর ঘাটে পৌঁছাবো।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।

এইচআর/এমএস