সালতামামি

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে সমৃদ্ধির বছর

করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের মতো চলতি বছরও সারাবিশ্ব গেছে অনেকটাই সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশেও ছিল করোনার প্রভাব, তবুও এগিয়ে গেছে দেশের অর্থনীতি। অন্য খাতের তুলনায় করোনা সংকটেও সফলতার সঙ্গে এগিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিখাত। বিদায়ী বছরে এই খাতের সবক্ষেত্রে বেড়েছে উৎপাদন।

Advertisement

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, বৈদেশিক মুদ্রা আয় এবং প্রাণিজ আমিষের শতভাগ চাহিদা পূরণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট জিডিপির ৫ দশমিক ০১ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপির ৩৭ দশমিক ১৯ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান। সরকারের কৃষিবান্ধব বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও মৎস্যচাষি, খামারি এবং উদ্যোক্তাদের চাহিদাভিত্তিক লাগসই কারিগরি পরিষেবার ফলে বাংলাদেশ মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন ২৭ দশমিক ১ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৬ দশমিক ২১ লাখ মেট্রিক টন, মাংসের উৎপাদন ১০ দশমিক ৮০ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে পেয়ে ৮৫ দশমিক ৪১ লাখ মেট্রিক টন, দুধের উৎপাদন ২২ দশমিক ৯০ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ১১৯ দশমিক ৮৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ডিমের উৎপাদন ৪৬৯ দশমিক ৯১ কোটি থেকে বেড়ে ২০৫৭ দশমিক ৬৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। ২০২১ সালসহ গত পাঁচ বছর ধরে পবিত্র ঈদুল আজহায় দেশি গবাদিপশু দিয়ে শতভাগ কোরবানির চাহিদা পূরণ করা হয়েছে।

করোনায় ভ্রাম্যমাণ মাছ, মাংস, দুধ, ডিম বিক্রিকরোনাকালে দেশের মানুষের পুষ্টি নিশ্চিতে করতে ভিন্ন এক উদ্যোগ নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। করোনার সময় উৎপাদিত মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য এবং প্রাণী ও প্রাণিজাত পণ্য বাজারজাতকরণে স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ ও অনলাইন বাজার ব্যবস্থা চালু করা হয়। কোভিডকালে ভ্রাম্যমাণ ও অনলাইন বিক্রয় ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় ৯ হাজার ৫শ কোটি টাকা মূল্যের মাছ, মাংস, দুধ, ডিম এবং অন্যান্য মৎস্য ও প্রাণিজাত দ্রব্য বিক্রি করা হয়েছে।

Advertisement

বেড়েছে ইলিশ উৎপাদনইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। দেশের মোট উৎপাদিত মাছের ১২ ২২ শতাংশ আসে শুধু ইলিশ থেকে। মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ লাখ ২৫ হাজার ৯৬৪টি জেলে পরিবারকে ৯৬ হাজার ৮৫৭ মেট্রিক টন ভিজিএফ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। জাটকা সংরক্ষণ, অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা ও প্রজননক্ষম মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের আহরণ ২ দশমিক ৯৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৬৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে।

চলতি মৌসুমে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত ১৪৬০ কোটি জাটকাচলতি প্রজনন মৌসুমে ৩৯ হাজার ৩১০ কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় ১ হাজার ৪৬০ কোটি বেশি। দেশের ইলিশ সম্পদের উন্নয়নে গত ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর দেশব্যাপী ২২ দিন ইলিশ মাছ আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। এসময়ে মা ইলিশের প্রজনন সফলতার ওপর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর নদীকেন্দ্র থেকে পরিচালিত গবেষণা ফলাফল সম্বলিত প্রতিবেদন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী- চলতি প্রজনন মৌসুমে (৪ থেকে ২৫ অক্টোবর) ৫১ দশমিক ৭৬ শতাংশ মা ইলিশ সম্পূর্ণরূপে ডিম ছেড়েছে। এতে চলতি প্রজনন মৌসুমে ৩৯ হাজার ৩১০ কোটি জাটকা (১০ শতাংশ বাঁচার হার ধরে) ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে।

গতবছর প্রজনন সফলতা ছিল ৫১ দশমিক ২ শতাংশ এবং ৩৭ হাজার ৮৫০ কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে চলতি প্রজনন মৌসুমে অতিরিক্ত ১ হাজার ৪৬০ কোটি জাটকা যুক্ত হয়েছে।

শতভাগ দেশীয় পশু দিয়ে কোরবানিএবছর ঈদুল আজহায় সারাদেশে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু কোরবানি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গত কয়েক বছরের মতো এবারও দেশি পশুতে চাহিদা পূরণ হওয়ায় দেশের বাইরে থেকে গরু আসেনি। ফলে দেশীয় পশু দিয়েই হয়েছে কোরবানি।

Advertisement

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং অন্যান্য ৪ হাজার ৭৬৫ পশুসহ মোট ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু ছিল। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি। এর মধ্যে প্রায় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি পশু কোরবানি করা হয়েছিল।

চিড়িয়াখানা আধুনিকায়নের উদ্যোগজাতীয় চিড়িয়াখানাকে ডিজিটালাইজড ও বিশ্বমানের করে বদলে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্পূর্ণ বিদেশি মাস্টারপ্ল্যানে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার চিড়িয়াখানার আদলে গড়ে তোলা হবে চিড়িয়াখানা। এই প্ল্যান পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে জাতীয় চিড়িয়াখানা প্রকৃতই হয়ে উঠবে বিনোদনের অন্যতম আকর্ষণ।

চিড়িয়াখানার মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে কাজ করছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড হ্যারিসন অ্যান্ড ফ্রেন্ডস লিমিটেড। এই কোম্পানির টিম লিডার বার্নার্ড হ্যারিসন নিজেই মূল দায়িত্বে রয়েছেন। ইন্দোনেশিয়ার বালিতে বসবাসরত বার্নার্ড হ্যারিসন আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে কাজটি পেয়েছেন।

এছাড়া সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের টেকসই আহরণ নিশ্চিতকল্পে সরকারের পরামর্শ ও নির্দেশনায় গবেষণা ও জরিপ জাহাজ ‘আর ভি মীন সন্ধানী’ বঙ্গোপসাগরে মৎস্য সম্পদের জরিপ ও গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে। গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প চলমান। মৎস্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ‘সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০’ প্রণয়ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমানে এ লাইভ জিন ব্যাংকে দেশের বিলুপ্তপ্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। রুই মাছের চতুর্থ প্রজন্ম উদ্ভাবন করা হয়েছে, যা মূল জাতের চেয়ে ২০ শতাংশের অধিক বর্ধনশীল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে উদ্ভাবিত হওয়ায় এটিকে ‘সুবর্ণ রুই’ নামকরণ করা হয়েছে।

গবাদিপশুর উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সারাদেশে ৮ হাজার ৪৬৪টি কৃত্রিম প্রজনন উপকেন্দ্র/পয়েন্ট স্থাপন করেছে।

বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্ত্বেও সরকারের কার্যকর উদ্যোগের ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৬,৫৯১ দশমিক ৬৯ মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৪০৮৮ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা আয় হয়েছে।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৭৭১ জন মৎস্যচাষি/খামারি/সুফলভোগীকে ৮১৮ দশমিক ৮৩ কোটি টাকা নগদ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এসময়ে বিতরণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৭২ জনকে ৮৪ কোটি টাকার উৎপাদন উপকরণ। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩ হাজার ৮১ জন খামারিকে ১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা ৪ শতাংশ সুদে ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে কোভিড-১৯ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেওয়া হয়। সচেতনতামূলক প্রচারণার অংশ হিসেবে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের সহযোগিতায় ‘নিয়মিত মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম খাই- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াই’ শীর্ষক এসএমএস পাঠানো হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং আওতাধীন দপ্তর/সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। রুই জাতীয় মাছের বৃহত্তম প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে।

বিদায়ী বছরের অর্জন বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, বিদায়ী বছরে করোনা সংকটেও উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রেখেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত, একই সঙ্গে রপ্তানিও বেড়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য মন্ত্রণালয় অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। তার একটি পদক্ষেপ হচ্ছে- নগদ সহায়তা ও উপকরণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। চলতি প্রজনন মৌসুমে ৫১ দশমিক ৭৬ শতাংশ মা ইলিশ সম্পূর্ণরূপে ডিম ছেড়েছে। এতে চলতি প্রজনন মৌসুমে পরিবারে যুক্ত হয়েছে ৩৯ হাজার ৩১০ কোটি জাটকা ইলিশ।

আইএইচআর/এমআরআর/এএ/জেআইএম