ভ্রমণ

সুন্দরবনের পথে রোমাঞ্চকর যাত্রা

প্রায় দুই মাস আগের কথা। আমি আর এক বড় ভাই আব্দুল্লাহ মামুন ঘোরাঘুরির কথা বলছিলাম। হঠাৎ মাথায় আসে সুন্দরবনের দুবলারচরের কথা। তবে ট্যুরিস্ট হয়ে নয়, জেলেদের বহরেই আমরা যাত্রা করবো। সব ঠিকঠাক, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আমরা সেখানে কীভাবে যাবো, কোথায় থাকবো, কী খাবো এসবের প্লান করতে থাকি।

Advertisement

সাতক্ষীরার এক ভাই আহসান রাজীবকে বিষয়টি জানালাম। তিনি বললেন সব ব্যবস্থা করে রাখবেন। আমাদের দুজনের সঙ্গে যুক্ত হলেন আরও দুজন। এর মধ্যে একজন আমার অফিসের কলিগ কামরুল হাসান ও আমার বন্ধু রুবেল। কিন্তু দিন যত ঘনিয়ে আসছিল; ততই মামুন ভাই ও রুবেলের যাওয়াটা অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছিল। অবশেষে তারা দুজন আর যেতেই পারবেন না বলে জানালেন।

এ অবস্থায় আমি আর কামরুল স্থির করলাম আমরা যাবোই। আহসান ভাই আমাদের জন্য সবকিছু ঠিক করে রেখেছিলেন। প্ল্যান অনুযায়ী আমরা ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকার বাসে উঠে রাতে বাগেরহাট জেলার মোংলায় পৌঁছাবো। রাতেই সেখান থেকে বেলায়েত সরদারের ট্রলারে দুবলায় যাবো। কিন্তু ঘটে বিপত্তি, ওইদিন মোংলা থেকে দুবলায় যাওয়ার ট্রলার ছিল আর মাত্র একটি, সেটি বেলায়েত সরদারের।

ঢাকা থেকে পৌঁছাতে কত সময় লাগবে, তা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। বেলায়েত ভাই ভেবেছিলেন, আমরা দুপুরেই ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি। আহসান ভাইও তাই। যোগাযোগের ভুলত্রুটিতে আমাদের যাত্রায় কিছুটা বিঘ্ন ঘটতে লাগলো। এরপরও আশা ছাড়িনি, কামরুল ভাই অভয় দিলেন, চিন্তা করার কিছু নেই একটা ব্যবস্থা হবেই।

Advertisement

আমাদের বাস সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় সায়েদাবাদ থেকে মোংলার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। যাবে মাওয়া ঘাট হয়ে। এতে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুট থেকেও কিছুটা দ্রুত যাওয়া সম্ভব বলে জেনেছি।

বলে নেওয়া ভালো, বেলায়েত সরদারের বাড়ি মোংলার চিলাবাজারের পাশেই। তিনি মাছের এবং মৌসুমী শুঁটকির ব্যবসা করেন। দুবলার চরের মহাজন বা সাহেবদের মধ্যে তিনিও একজন। একই সঙ্গে সুন্দরবন থেকে জল-বনদস্যু মুক্ত করতে সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিম ভাইকে সহযোগিতায় তিনি সব সময় পাশে ছিলেন। জীবনের ঝুঁকি জেনেও জেলেদের স্বস্তি ফিরিয়ে দিতে জল-বন দস্যুদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তারা। এখনো করছেন।

আমরা মাওয়া পৌঁছানোর পর বেলায়েত ভাইকে জানালাম। তবে তিনি হতাশ করলেন যে, ট্রলার রাত ১১টার ভেতর ছেড়ে যাবে। কিন্তু আমাদের পৌঁছাতে সাড়ে ১২টা বেজে যাবে। এরপরও তিনি আশা দিয়ে বললেন আসতে থাকেন, মাঝে মাঝে আমাদের খবরও নিচ্ছিলেন। বাসে বসে আমরা দুজনই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। যেতে পারবো কি না, আর যেতে পারলেও সুন্দরবনের দুবলার চর যাওয়া হবে কি না, নাকি মোংলা থেকেই ফিরে আসতে হয়। এর ফাঁকে কুয়াকাটা, সাতক্ষীরা খোঁজ নিলাম যাতে আমরা সুন্দরবন যেতে না পারলেও অন্তত সেখানে হলেও ঘুরে আসতে পারি।

এদিকে রাত পৌনে ১১টার দিকে ফোন দিয়ে বেলায়েত ভাইকে জানালাম আমরা মোংলার কাছে এসে পড়েছি। তখন তিনি আমাদের নেমেই খেয়া পার হতে বললেন। আমাদের রিসিভ করতে পশুর নদীর ওই পাড়ে জামাল ও ইউসুফ নামে দুই ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু রাত ১২টার দিকে মোংলা থেকে নেমে খেয়ায় উঠতেই বেলায়েত ভাই ফোন করে জানালেন ট্রলার ছেড়ে গেছে।

Advertisement

শুনেই আমাদের মন ভেঙে যায়। পরে নদী পার হয়ে জামাল ও ইউসুফ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হই। হতাশ মনে তাদের সঙ্গে একটি হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। এরপর অটোতে করে আমরা বেলায়েত ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম।

ইউসুফ ভাই অটো চালাচ্ছিলেন আর জামাল ভাই তার পাশে বসে আছেন। রাস্তার চারদিক নীরব। হালকা কুয়াশাও পড়েছে। কিছুটা শীত অনুভূত হচ্ছে। এদিকে আমাদের মন খারাপ বুঝতে পেরে তারা বিভিন্ন মজার গল্প শুরু করলেন। আমার আর কামরুল ভাইয়ের যেন হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাওয়ার অবস্থা। মাঝপথে বেলায়েত ভাই ফোন দিলেন যে, ট্রলার আবার ঘাটে ফিরে এসেছে। আমরা অবশেষে যেত পারবো। বাঁধ ভাঙা হাসিতে আমাদের আনন্দ ঠেকায় কে?

লম্বা পথ তাই বেলায়েত ভাই মোটরসাইকেলে করে কিছুদূর এগিয়ে এসে আমাদের তুলে নিলেন। রাত ১টার দিকে গিয়ে আমরা ট্রলারে উঠে যেন স্বস্তি পেলাম। এখন আমাদের যাত্রা সুন্দরবনের শেষ অংশ মানে বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি দুবলারচর। সেখানে এখন চলছে শুঁটকির কারবার। আছেন অসংখ্য জেলে, শ্রমিক, মহাজন, সাহেব।

আমরা যে ট্রলারে যাচ্ছি তাতে আছে ঘুমানোর ব্যবস্থা, আছে রান্নাঘর ও শৌচাগার। ট্রলার চালক এবং তার সহযোগী বসা আছে ৪-৭ হাতের মতো একটি জায়গায়। শীত আর বাতাস রোধে দেওয়া আছে দেড় হাত উঁচু প্রাচীর। সেখানে আছেন বেলায়েত ভাইয়ের বাবা-কাকা ও ট্রলারের দায়িত্বে থাকা কয়েকজন। এর সামনে আরও ৩-৬ হাতের একটি জায়গায় আছে। তাতেই আমরা বসার জায়গা করে নিয়েছি। আমাদের সঙ্গে ছিলেন মাছ ও শুঁটকির ছোট ব্যবসায়ী রহুল আমিন ভাই। তিনি বেলায়েত ভাইয়ের কাছের ছোট ভাই। পাশে বসে আছেন একজন ফরেস্টারও। ট্রলারের সামনের অংশে মাছ ও মালামাল পরিবহনের জন্য বিশাল জায়গা। তাতে চরের বিভিন্ন মালামাল নেওয়া হচ্ছিল। সেই মালামালের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছেন বেশ কয়েকজন জেলে।

নদীতে বাতাস বইছে সাথে কনকনে শীত অনুভূত হচ্ছে। আমার কলিগ কামরুল শীতের ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এলেও আমি তার ব্যতিক্রম ছিলাম। তাই তিনি আমাকে শীত ঠেকাতে গরম কাপড় দিয়ে সহযোগিতা করলেন। বাকি সবাই যে যার মতো কম্বল, কাঁথা মুড়িয়ে ছিলেন। আবার একজন তো বাতাস থেকে রেহাই পেতে প্লাস্টিক মুড়িয়ে ছিলেন। পশুর নদী ধরেই আমরা বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গিয়ে দুবলারচরে উঠবো।

ট্রলারের পুরো যাত্রায় আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন রুহুল ভাই। আগে কী করতেন, কোথায় ছিলেন, সুন্দরবনে তার কেন আসা এসব। বেলায়েত ভাই ও সাংবাদিক মোহসীন ভাইয়ের সাহসিকতা নিয়েও গল্প করতে ভোলেননি তিনি। এর মধ্যে নদীতে শুরু হয় জোয়ার। জোয়ারের ঢেউ ডিঙিয়ে ট্রলারের যেতে বেশ সময় লাগবে, একই সঙ্গে তেল খরচও হবে বেশি। সেই পরিমাণ তেল স্টকে ছিল না। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা নদী পাড়ি দেওয়ার পর ভোর সাড়ে ৪টার দিকে ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর একটু গেলে চার নদীর মোহনা এবং তারও পরে দুবলা। নদীর মাঝখানেই আমরা দাঁড়িয়ে চাঁদের আলো উপভোগ করছি আর প্রচণ্ড বাতাসে কিছুটা কাঁপছি।

রুহুল ভাই আরেক ভাইকে বললেন রং চা বানাতে। চা হলো তবে হাতে আসতেই ঠান্ডা হয়ে গেল। তবুও সমস্যা নেই, মাঝ নদীতে চা মিলেছে এটাই তো বেশ। ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত গল্প করলাম। সূর্যের দেখা পেতে আরও দেরি আছে। মোটামুটি সবাই ঘুমে বিভোর। কেউ কেউ নাক ডেকে জানান দিচ্ছেন তিনি ট্রলারে আছেন। এক সময় আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। পরে সকাল সাড়ে ৬টায় আবার ঘুম ভাঙলো। কিন্তু ভাটা না পড়ায় আরও কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হলো। কী আর করা? বসে বসে সূর্যোদয় এবং পাড়ে বন দেখতে লাগলাম।

এদিকে রুহুল ভাই দেখি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন রান্না ঘরে। বানানো শুরু করে দিলেন রং চা। সকালের নাস্তা হবে টোস্ট বিস্কুট আর রং চা। এর মধ্যে কামরুল ভাই আর আমি হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। এদিকে চা বানানো শেষ কিন্তু নেই কোনো কাপ বা গ্লাসের ব্যবস্থা। তো রুহুল ভাইয়ের মাথায় খেলল এক বুদ্ধি। তিনি প্লেটে করেই সবাইকে চা দিলেন। আহা নদীর মাঝে বসে প্লেটভর্তি চা আর টোস্ট বিস্কুট, স্বাদই আলাদা।

জোয়ার থাকতে থাকতেই অবশেষে সকাল সাড়ে ৮টায় ট্রলার চলতে শুরু করল। নদীর এক পাড়ে বন দেখা যায়, আরেক পাড় খালি চোখে দেখা যায় না। চার নদীর মোহনা পার হওয়ার সময় চোখে পড়ে কয়েকটি জেলে বহর। তারা জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। কেউ পাচ্ছেন আবার কেউ পাচ্ছেন না। জেলেদের সঙ্গে একটু হাঁকডাক হলো।

প্রায় তিন ঘণ্টা যাত্রা শেষে চলে এলাম দুবলার চরের কাছে। এসেই দেখি চারদিকটা অসম্ভব সুন্দর। আশপাশে রয়েছে আরও কয়েকটি চর। পরিবেশটা এত শান্ত দেখেই মন জুড়িয়ে গেল। খাল দিয়ে ঢুকে একটি ঘাটে ট্রলার ভিড়বে। কিন্তু ভাটা পড়ায় ঘাট পর্যন্ত যেতে পারলো না ট্রলার। ফলে পানিতে নেমে কাদা মাড়িয়েই পাড়ে উঠতে হবে। এ দেখে বেলায়েত ভাইয়ের বাবা-চাচার মন খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু আমার এবং কামরুল ভাইয়ের বেশ ভালোই লাগছিল।

ইট-কংক্রিটের ঢাকা শহরে এমন পানি-মাটি কোথায় মেলে। এ চিন্তা করে নামার প্রস্তুতি নিলাম। ব্যাগ হাতে নিয়ে আমরা পানিতে নেমে গেলাম। আমার স্বাস্থ্য বেশি হওয়ায় হাঁটু পর্যন্ত মাটিতেই ঢুকে যাচ্ছে। তাই একটু পাড়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছে। অবশেষে আমরা উঠে পড়লাম দুবলারচরের পাড়ে।

চলবে...

এসজে/এসইউ/এএসএম