আন্তর্জাতিক

মহামারিতে বদলে গেছে কেনাকাটার ধরন

করোনা মহামারির আগেও খুচরা ব্যবসায়ে সংকট ছিল। তবে মহামারির আবির্ভাবের পর এই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। প্রায় দুই বছর ধরে বিশ্বে তাণ্ডব চালাচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। মহামারির কারণে বিভিন্ন স্থানে কেনাকাটায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা কীভাবে কেনাকাটা করব তা সব সময়ের জন্যই বদলে গেছে।

Advertisement

আমরা কী কিনব, এর থেকেও বড় কথা কীভাবে কিনব তা পুরোপুরিই পাল্টে গেছে। ক্লিক করলেই এখন মুহুর্তের মধ্যেই বড় বড় জিনিসগুলো বাড়িতেই হাজির হয়ে যাচ্ছে। কোথাও গিয়ে কেনাকাটা করার ঝামেলা নেই। বাড়িতে বসে কাজ করার কারণে বাড়ির অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা বদলে পরিপাটি করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে এসব জিনিসপত্রের কেনাকাটা বর্তমানে একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।

ভোক্তাদের পছন্দের দিন শেষ এরকম একটা বার্তাই দিচ্ছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, গাড়ি বা সোফা নামিয়ে বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত ডেলিভারির সময়টা এখন বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। দোকানে গিয়ে সেলফে সাজিয়ে রাখা জিনিস থেকে বেছে বেছে কোনো পণ্য এখন আর ক্রেতাদের কেনার সুযোগ থাকছে না।

স্বাস্থ্য অথবা পরিবেশগত কারণে জীবনযাত্রার পরিবর্তনে দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সকলের সহায়ক হয়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন সেবা। বিনিয়োগকারীরা কেনাকাটা করা জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে কোটি কোটি ডলার ঢালছে। ব্যবহৃত পোশাক এবং আসবাবপত্র পুনরায় কেনাবেচার বিষয়টিও এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বড় রাস্তার পাশের সস্তা ভাড়ায় চলা স্বতন্ত্র বা স্বাধীন দোকানপাট ক্রেতার আকৃষ্ট করতে শুরু করেছে। যেসব ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন ঘটেছে তা সংক্ষেপে দেখা যাক-

Advertisement

খুচরা কেনাকাটা:করোনা মহামারি ইউরোপের খুচরা বাজারে ২১ কোটি ২০ লাখ পাউন্ডের উত্থান ঘটিয়েছে। লকডাউনের কঠিন সময়ে বড় সুপারমার্কেটগুলোকে জীবনের এই মধ্যবর্তী সময়ের সংকট থেকে বাঁচিয়েছে। গেটির এবং গোরিলাস অ্যান্ড জিফি নামের দুটি প্রতিষ্ঠান আধাঘণ্টার কম সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।

খাদ্য ও ভোক্তা পণ্য নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান আইজিডি। তারা বলছে, দ্রুততম সময়ে গড়ে ওঠা এই বাণিজ্য সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ‘সঠিকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে’। ধারণা করা হয় যে, যুক্তরাজ্যের প্রায় শতকরা ১৩ ভাগ দোকানদার এদের সেবা নিচ্ছে। এ বছরে বিক্রির পরিমাণ ১৪০ কোটি পাউন্ড। আর একইভাবে চলতে থাকলে পাঁচ বছরের মধ্যে তা দ্বিগুণ হবে।

শপফ্লোর ইনসাইটের বিশ্লেষক ব্রিয়ান রবার্টস বলেন, স্বাস্থ ঝুঁকি এমন একটি বাজার সৃষ্টি করেছে যেখানে মাত্র ১৫ মিনিটেই পণ্য সরবরাহের জন্য মানুষ ২০ পাউন্ড দিতে আগ্রহী। তিনি আরও বলেন, এই মডেল টেকসই হবে কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে।

মহামারির সময়ে অনলাইন সেবা লক্ষাধিক নতুন ক্রেতা তৈরি করেছে। এখনকার দিনে কেনাকাটার সুযোগ ব্যাপক হারে বাড়লেও সাপ্লাই চেইনের সমস্যা রয়েই গেছে।

Advertisement

ক্র্যানফিল্ড স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের সাপ্লাই চেইন স্ট্র্যাটিজির অধ্যাপক রিচার্ড উইল্ডিং বলেন, আগে আমাদের পণ্য বাছাই করার যে সুযোগ ছিল তা এখন বদলে গেছে। আগে সুপার মার্কেটে প্রায় ৬০ ধরনের পাস্তা পাওয়া যেত। কিন্তু মহামারির এই সময়ে উৎপাদনকারীরাই এখন সব ঠিক করে দিচ্ছে যে ক্রেতা কোন ২০ ধরনের পাস্তা খাবে। আর বাছাই করার সুযোগ থাকছে এর মধ্য থেকেই। নতুন ও আকর্ষণীয় জিনিস বাজারে হাজির করা ভোক্তাদের চাহিদা বৃদ্ধি করে। কিন্তু কোম্পানিগুলো এক্ষেত্রে বলছে, উচ্চ মূল্যসম্পন্ন জিনিসগুলোর দিকে আমাদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

বাড়িতে বসে কাজ করা:করোনা মহামারির এই সময়ে বাড়িতে বসে কাজ করায় আমাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আমাদের জীবনে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয় কোনগুলো হবে যেমন- ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন স্থানে ছুটি কাটানোর পেছনে ব্যয়ের বদলে গৃহসজ্জা বা সংস্কারের প্রতি মনোনিবেশ করার বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সপ্তাহের ৭ দিনই ২৪ ঘণ্টা বাড়িতে থাকায় অনলাইন শপিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে মানুষ। অনলাইনে বিক্রি বৃদ্ধি দ্বিগুণ হতে প্রায় আট বছর সময় নিয়েছে যেখানে মাত্র শতকরা ২০ শতাংশ ব্যয় হতো। কিন্তু করোনা মহামারির ৯ মাসের মধ্যে গত বছরে এই হার ৩৬ শতাংশে পরিণত হয়েছে। এ বছর সব বাধা পেরিয়ে এটি শতকরা ২৬ শতাংশে পৌঁছেছে।

এ সম্পর্কে খুচরা বাজার বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হাইম্যান বলেন, খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে ফ্যাশন, সৌন্দর্য চর্চা ও গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার ক্ষেত্রে সবকিছুই একেবারে বদলে গেছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে সবকিছু এই নতুন রূপেই চিরস্থায়ী হয়ে উঠবে? এ বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত যে, শতকরা কতজন মানুষ বাড়িতে বসে কাজ করবে।

ভোক্তাদের ব্যয়ের ধরন হঠাৎ করেই বদলে গেছে। উদাহরণস্বরূপ ব্রিটেনের লোকজন এখন অবসর যাপনের জন্যে নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করছে। প্রায় ১২ লাখ নতুন বাগানী প্রায় ৫ তোটি ১০ লাখ চারাগাছ এবং অন্যান্য সরঞ্জামের পেছনে ব্যয় করেছে।

কান্টারের জোয়ানা পারমান বলেন, প্রত্যেকের কাজ ঘরে বসে করা যায় এমন নয়। তবে আমরা যেভাবে সামাজিকতা রক্ষা কিংবা কেনাকাটা করছি তাতে সবকিছু আমাদের বাড়ি নির্ভর হয়ে উঠছে। ছুটির দিনগুলোতে আমরা দূরে কেনাকাটা কিংবা খাওয়াদাওয়া করতে কম যাচ্ছি। আমরা আগের তুলনায় স্থানীয় ও বড় দোকানগুলো থেকে অধিক কেনাকাটা করছি।

তিনি আরও বলেন, প্রচুর মানুষ এখন ইন্সটাগ্রামে ছবি পোস্ট করা বা ফোনে বা ভিডিও কলে কথা বলার জন্যে তাদের কেমন দেখা যাচ্ছে কিংবা তাদের ঘরের সাজসজ্জা ক্যামেরাতে কেমন দেখাচ্ছে এরকম ক্ষেত্রে নিজেকে তথা বাড়ির গৃহসজ্জাকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

ফ্যাশন:ব্রিটেনের সবাই করোনা মহামারিতে স্বস্তিদায়ক পোশাকের দিকে মনযোগী হয়ে উঠেছে। এ বছর স্বস্তিদায়ক পোশাকের ৮৮ শতাংশ বিক্রি বেড়েছে। রাস্তার বড় দোকানগুলো বন্ধ থাকায় লোকজন অনলাইনে বসে কেনাকাটা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। খুচরা বাজার অর্থনীতির তথ্য অনুসারে, চলতি বছর ৫ হাজার ২শ কোটি পাউন্ডের অর্ধেক পোশাকই অনলাইনে বিক্রি হয়েছে। অনুমান করা হয়, ২০২৫ পর্যন্ত এই পরিমাণ দুই তৃতীয়াংশে গিয়ে ঠেকবে। ইলেকট্রিক সামগ্রীর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। এই বাজারও এখন অনলাইনে ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

পারমান বলেন, এই মহামারিতে আমাদের পরিষ্কার একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, জাতিগতভাবে আমরা আমাদের আচরণে, অনেকটা বলা যায় রাতারাতি যেকোনো পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে সক্ষম। নীতিগতভাবে সামাজিকতা রক্ষার এমন কিছু না থাকলেও আমরা আবার পেছনের দিকে ফিরে যাচ্ছি। আমাদের অভ্যাসে নানাবিধ পরিবর্তন আনছি। যতদিন এই অভ্যাসগুলো থাকবে, ততদিন আমরাও এর মধ্যেই টিকে থাকব।

কাজের ক্ষেত্রে এই বাজারগুলোর আরও কিছু দিকও বিদ্যমান। ফ্যাশন শিল্প বড় ধরনের দূষক আর এটা প্রতিনিয়ত টেকসই পথ তৈরির দিকে নিজেই নিজেকে চাপের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তাই অধিকাংশ কোম্পানি এখন দ্বিতীয়বার হাতবদল করা পোশাক বিক্রি করছে কিংবা ভাড়া দিচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মার্ক্স অ্যান্ড স্পেন্সার তাদের পোশাক ও কোর্ট ভাড়া দেওয়ার চাহিদা কেমন দেখতে একটি পরীক্ষামূলক জরিপ চালায়। এই জরিপ থেকে উঠে আসে যে, এই ট্রেন্ড আসবাবপত্র ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলন বেশি। বিশেষ করে সোফা, সাইডবোর্ড ও ডেস্কের ক্ষেত্রে অধিক লক্ষ্যনীয়। ফ্যাশন সচেতন অল্প বয়সী তরুণীরাও এই ধরনের পোশাকগুলো কেনার ক্ষেত্রে অধিক ব্যয় করছে।

গাড়ি:দ্বিতীয়বার হাতবদল করা জিনিসের চাহিদা গাড়ির বাজারেও কম নয়। গত এপ্রিল পর্যন্ত গাড়ির মূল্য ছিল ৩১ শতাংশ বেশি। প্রতি বছর যুক্তরাজ্যে প্রায় ২৫ লাখ নতুন গাড়ি নিবন্ধিত হচ্ছে। তবে এর মধ্যে ২০২০ সালেই তা কমে ১৬ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছর একই পরিমাণ কম্পিউটার চিপ উৎপাদনের তথ্যও পাওয়া যায়। এসব কারণেই দ্বিতীয়বার হাতবদল করা জিনিসের চাহিদা বাড়ছে।

অটো ট্রেডারের বাণিজ্য বিষয়ক পরিচালক ইয়ান প্লামার এ সম্পর্কে বলেন, করোনা মহামারি একটি নিশ্চল শিল্পকে গতিশীল করার লক্ষ্যে ইন্টারনেটভিত্তিক ওয়েব ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছে। আগে গাড়ি কেনার অর্থ যোগানের যেসব কাজ ক্রেতারা পায়ে হেঁটে গিয়ে করত, এখন সব অনলাইনে করছে।

সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে বলা যায়, ইলেকট্রিক যানবাহনের বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে। চলতি নভেম্বরে প্রায় ২২ হাজার ইলেকট্রিক যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছে যা ২০২০ সালে নভেম্বরের এর তুলনায় দ্বিগুণ।

প্লামার বলেন, ২০২১ সালে প্রতি ১০ দিনে একটি করে নতুন ইলেকট্রিক যানবাহন বাজারে এসেছে। আগামী বছর আরও গাড়ি আসবে। বাজারে এটা একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। সরবরাহ বেশি, তো বাজার করার পরিমাণও বেশি ফলে উত্তেজনাও বাড়ছে যা আবার আরেক ধাপে তেল সংকটকে বাড়াচ্ছে।

দোকান:করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের আবির্ভাব ছোট বিক্রেতাদের বিপাকে ফেলেছে। বিশেষ করে, যাদের ক্রিসমাসের সময় পণ্য বিক্রি করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেসব ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিক্রি কমে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ের ব্রিটিশ রিটেইল কনসোর্টিয়ামের তথ্য অনুসারে, খালি পড়ে আছে এমন দোকানের সংখ্যা ১৪.৫ শতাংশ।

এই সংকট ভাড়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো- সরকার এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে চায় না। একই তথ্য ধরে বলতে গেলে কিছু অঞ্চলে দোকান খালি হয়ে যাওয়ার পরিমাণ অনেক বেশি। 

তবে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বলতে হয়, সামনের দিকে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন অপেক্ষা করছে। হাইম্যান জানান, গত ২০ বছর ধরে খাদ্য বাদে ৯ কোটি অন্যান্য পণ্য অনলাইনে বিক্রি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দোকানে কোনো জিনিস বিক্রি করলে এর মূল্য অনেক বেড়ে যায়। নির্ধারিত দামে বিক্রি কম হচ্ছে। যখন এসব শেষ হচ্ছে আমরা আবারও অনেক বেশি দোকান রাখা এবং ওয়েবসাইটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই আমাদের কেনাকাটার ধরন বদলে যাচ্ছে।

খায়রুন নাহার/টিটিএন/এমএস