ধর্ম

বরকত কী? মানুষ কেন বরকত কামনা করবে?

বরকত বহুল প্রচলিত একটি আরবি শব্দ। ক্ষেত্র বিশেষ এর অনেক অর্থ হয়। কোরআন-সুন্নাহর অনেক জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। বেশিভাগ সময় মানুষ বিভিন্ন কাজে বরকত কামনা করেন। কিন্তু এ বরকত কী? আর মানুষ কেনই বা সব সময় সব কাজে বরকত কামনা করে?

Advertisement

স্থান-কাল-পাত্রভেদে আরবি শব্দ ‘বরকত’-এর অনেক অর্থ হয়ে থাকে। যার প্রতিটি অর্থই কল্যাণের। আল্লামা রাগিব ইস্পাহানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, বরকত বলা হয় ঐ জিনিসকে যাতে মহান আল্লাহর কল্যাণ নিহিত থাকে। কোরআনুল কারিমে এ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে এভাবে-

১. وَ هٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ مُبٰرَکٌ

‘আর এ কিতাব (কোরআন) কল্যাণময় করে অবতীর্ণ করেছি।’ (সুরা আনআম : আয়াত ৯২)

Advertisement

২. وَ لَوۡ اَنَّ اَهۡلَ الۡقُرٰۤی اٰمَنُوۡا وَ اتَّقَوۡا لَفَتَحۡنَا عَلَیۡهِمۡ بَرَکٰتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ

‘আর যদি জনপদের অধিবাসীবৃন্দ বিশ্বাস করত ও সাবধান হত, তাহলে তাদের জন্য আমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কল্যাণ-দ্বার উন্মুক্ত করে দিতাম।’ (সুরা আরাফ : আয়াত ৯৬)

৩. وَ بٰرَکۡنَا عَلَیۡهِ وَ عَلٰۤی اِسۡحٰقَ ؕ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِهِمَا مُحۡسِنٌ وَّ ظَالِمٌ لِّنَفۡسِهٖ مُبِیۡنٌ

‘তাকে এবং ইসহাককে আমি ‘সমৃদ্ধি’ দান করেছিলাম; তাদের উভয়ের বংশধরদের মধ্যে কিছু সৎকর্মপরায়ণ এবং কিছু নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১১৩)

Advertisement

৪. وَّ جَعَلَنِیۡ مُبٰرَکًا اَیۡنَ مَا کُنۡتُ ۪ وَ اَوۡصٰنِیۡ بِالصَّلٰوۃِ وَ الزَّکٰوۃِ مَا دُمۡتُ حَیًّا

যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আজীবন নামায ও যাকাত আদায় করতে।’ (সুরা মারইয়াম : আয়াত ৩১)

কোরআন-সুন্নাহয় বরকত শব্দটি অনেক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যার প্রতিটিই কল্যাণের, প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির। বরকতের আরও যেসব অর্থ হতে পারে; তাহলো-

> বরকত মানে- ‘আল্লাহর দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখা।’

> বরকত অর্থ- ‘সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি’। অর্থাৎ আল্লাহ বান্দার সব বিষয়ে প্রবৃদ্ধি ও সফলতা দান করেন।

> বরকত অর্থ- ‘মানুষের জন্য কল্যাণকর হওয়া’।

> বরকত মানে- কল্যাণের শিক্ষক।

> বরকত মানে- সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ।’ (ফাতহুল কাদির)

ক্ষেত্রভেদে বরকতের অর্থ কেমন হবে; এক নেককার ব্যক্তির কথায় তা সুন্দরভাবে ফুটে ওঠেছে। তাহলো-

এক নেককার বান্দা দোয়া করছেন- ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আমার রিজিকে বরকত দান করুন।

তখন এক ব্যক্তি তাকে বলল, আপনি কেন এভাবে দোয়া করছেন কেন? বরং আপনি বলুন- হে আল্লাহ! আপনি আমাকে রিজিক দান করুন।

নেককার বান্দা তখন বললেন- ‘আল্লাহ তাআলা তার প্রত্যেক সৃষ্টির রিজিকের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু আমি চাই, রিজিকে বরকত। কারণ বরকত হল, আল্লাহ তাআলার একটি গোপন সৈনিক; যার কাছে ইচ্ছা তিনি তা প্রেরণ করেন। এরপর-

১. এই ‘বরকত’ যদি সম্পদে প্রবেশ করে; তাহলে তা সম্পদ বৃদ্ধি করে দেয়।

২. এই ‘বরকত’ যদি সন্তান-সন্ততির মধ্যে প্রবেশ করে; তাহলে তাদেরকে সংশোধন করে দেয়।

৩. এই ‘বরকত’ যদি শরীরে প্রবেশ করে; তাহলে তা শরীরকে শক্তিশালী করে দেয়।

৪. এই ‘বরকত’ যদি সময়ে প্রবেশ করে; তাহলে সময়কে সমৃদ্ধ করে দেয়।

৫. আর এই ‘বরকত’ যদি হৃদয়ে প্রবেশ করে; তাহলে তাতে এনে দেয় সুখ ও শান্তির ছোঁয়া।’

সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি আমাদের যা কিছু দিয়েছেন তাতে ‘বরকত’ দান করুন।

যখনই মানুষের কাজে বরকত থাকে না তখন মানুষের সব কাজ দুশ্চিন্তায় অতিবাহিত হয়। এ জন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় নিজের জন্য ও অন্যের জন্য বরকতের দোয়া করতেন। হাদিসে এসেছে-

হজরত আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আবদুর রাহমান ইবনু আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু গায়ে (বা পোশাকে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলুদ রং-এর চিহ্ন দেখে প্রশ্ন করেন- কি ব্যাপার! তিনি বললেন, আমি এক নারীকে একটি খেজুর আঁটির অনুরূপ পরিমাণ সোনার বিনিময়ে বিয়ে করেছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- ‘তোমাকে আল্লাহ তাআলা বারকত দিন। আর ওয়ালিমার আয়োজন কর; তা একটি ছাগল দিয়ে হলেও।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, বুখারি ও মুসলিম)

এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয় নাতি হজরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বরকত লাভের দোয়া শিক্ষা দিয়েছিলেন। হজরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বিতর নামাজে পঠিত লম্বা দোয়ার অংশ ছিল-

وَبَارِكْ لِيْ فِيْمَا أَعْطَيْتَ

‘ওয়া বারিক লি ফি-মা আ’তাইতা’

অর্থ : (হে আল্লাহ!) তুমি আমাকে যা দান করেছ, তার মধ্যে বরকত দাও! (তিরমিজি)

হজরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর পুরো দোয়াটি হলো-

اللَّهُمَّ اهْدِنِي فِيمَنْ هَدَيْتَ وَعَافِنِي فِيمَنْ عَافَيْتَ وَتَوَلَّنِي فِيمَنْ تَوَلَّيْتَ وَبَارِكْ لِي فِيمَا أَعْطَيْتَ وَقِنِي شَرَّ مَا قَضَيْتَ فَإِنَّكَ تَقْضِي وَلاَ يُقْضَى عَلَيْكَ وَإِنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! যাদেরকে তুমি হেদায়াত করেছো আমাকেও তাদের সাথে হেদায়াত কর, যাদের প্রতি উদারতা দেখিয়েছ তুমি তাদের সঙ্গে আমার প্রতিও উদারতা দেখাও। তুমি যাদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছ তাদের সঙ্গে আমার অভিভাবকত্বও গ্রহণ কর। তুমি আমাকে যা দান করেছ তার মধ্যে বারকাত দাও। তোমার নির্ধারিত খারাবি হতে আমাকে রক্ষা কর। কেননা তুমিই নির্দেশ দিতে পার, তোমার উপর কারো নির্দেশ চলে না। যাকে তুমি বন্ধু ভেবেছ সে কখনও অপমানিত হয় না। তুমি কল্যাণময়, তুমি সুউচ্চ।’ (তিরমিজি, ইবনে খুজাইমা, আবু দাউদ)

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, সব কাজে সব সময় বরকত কামনা করা। কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জীবন-যাপনে বরকতের আশা করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সব সময় সব কাজে বরকত কামনা করার তাওফিক দান করুন। বরকতময় জীবন যাপনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/জেআইএম