বিশেষ প্রতিবেদন

দুই দশকেও বরিশাল সিটিতে গড়ে ওঠেনি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

প্রতিষ্ঠার দুই দশকেও বরিশাল নগরীতে গড়ে ওঠেনি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চলছে সেই সনাতন পদ্ধতিতেই। নগরীর সড়কের পাশে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, অসংখ্য খোলা ডাস্টবিন। ময়লা ফেলা হচ্ছে দিনভর। বেশিরভাগই গৃহস্থালির ময়লা-আবর্জনা। যানবাহনের চাকায় জড়িয়ে সেই ময়লা ছড়িয়ে পড়ছে নগরীর সড়কে। দুর্গন্ধ থেকে রেহাই পেতে হাঁটতে হয় নাক-মুখ চেপে। খোলা ট্রাকে বহন করা হয় ময়লা। উন্মুক্ত স্থানে ডাম্পিং স্টেশন হওয়ায় বিপর্যস্ত পরিবেশ। বৃষ্টি হলে সৃষ্টি হয় দুর্বিষহ পরিস্থিতি।

Advertisement

এভাবেই চলছে ২০০২ সালে গঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।

বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি) সূত্রে জানা যায়, ৫৮ বর্গকিলোমিটারের বরিশাল সিটিতে প্রায় ছয় লাখ মানুষের বসবাস। নগরীতে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় প্রায় ৩০০ টন বর্জ্য। এর একটি অংশ সড়কে জমা হওয়া। বড় সড়কগুলোতে ঝাড়ু দিয়ে ময়লা বিভিন্ন জায়গায় জমা করেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা। কাজটি চলে রাত ৯টা থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত।

বর্জ্য সংগ্রহের পর ট্রাকে কাউনিয়া পুরানপাড়ার ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে ফেলা হয়। ৩০টি ওয়ার্ডে বিভক্ত এ সিটির বর্জ্য অপসারণে বিসিসির পরিচ্ছন্ন শাখায় স্থায়ী ও অস্থায়ী নিয়োগে রয়েছেন নয় শতাধিক কর্মী। ময়লা পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে সিটি করপোরেশনের ১৮টি ট্রাক ও ২২০টি বক্সভ্যান।

Advertisement

জানা যায়, নগরীর প্রতিদিনকার বর্জ্য খোলা ট্রাকে নিয়ে যাওয়ায় কিছু আবর্জনা বাতাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে সড়কে। পুরানপাড়া ডাম্পিং স্টেশনটি জনবসতিপূর্ণ এলাকায়। উন্মুক্ত ওই ডাম্পিং স্টেশনে বর্জ্য ফেলার কারণে আশপাশের বাসিন্দাদের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। খোলা ডাস্টবিনের আবর্জনা ফেলা, খোলা ট্রাকে পরিবহন ও উন্মুক্ত স্থানে ময়লা ফেলার কারণে নগরীর বায়ুদূষণ হচ্ছে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।

বরিশাল নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নগরীর অধিকাংশ স্থানে ডাস্টবিনের কোনো চিহ্ন নেই। সড়কের পাশে খোলা ডাস্টবিনে (অস্থায়ী) বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। রাস্তার পাশে এভাবে বর্জ্য পড়ে থাকলে চলাচলেও অসুবিধা হয়। রাতে পরিচ্ছন্নকর্মীরা সেই আবর্জনা সংগ্রহ করে বড় সড়কের পাশে জমা করেন। এরপর খোলা ট্রাকে উন্মুক্ত ডাম্পিং স্টেশনে নেওয়ার সময় নগরীতে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ।

কাউনিয়া পুরানপাড়ার উন্মুক্ত ডাম্পিং স্টেশনের আশপাশে বসবাস করা কয়েকজন বাসিন্দা জাগো নিউজকে জানান, নগরীর পুরানপাড়া জনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রায় ছয় একর জায়গাজুড়ে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। ২০০৩ সালে ময়লা ফেলার জন্য এ জমিটি অধিগ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। এরপর ২০০৪ থেকে ৩০টি ওয়ার্ডের ময়লা ফেলা শুরু হয়। সেখানে আধুনিক ব্যবস্থাপনা নেই। উন্মুক্তভাবে ফেলা বর্জ্য পাশের সাপানিয়া খালের পানিতে গিয়ে মিশছে। সেই খালের পানি যাচ্ছে কীর্তনখোলায়। এতে কীর্তনখোলা নদীর পানিও দূষিত হচ্ছে।

পুরানপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. জহির জাগো নিউজকে বলেন, উন্মুক্ত ডাম্পিং স্টেশন চালুর পর এলাকার পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। পুরানপাড়া শুধু নয়, পার্শ্ববর্তী সরদারকান্দা, রাঢ়িমহল, শ্রীপুর কলোনি, মতাশার, কাউনিয়া হাউজিং এবং চরবাড়িয়ার সাপানিয়া ও উলালঘুনি গ্রামের অন্তত ২৫ হাজার পরিবার এই ডাম্পিং স্টেশনের কারণে বিভিন্নভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

Advertisement

আল-আমীন কাজী নামে আরেক বাসিন্দা জানান, আবর্জনার দুর্গন্ধে টিকতে না পেরে নিজেদের বাড়ি রেখে নগরীর অন্যত্র বাসাভাড়া নিয়ে থাকছে ১৫-২০টি পরিবার। যারা থাকছেন উৎকট গন্ধে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টির সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। শীত মৌসুমে ময়লা পোড়ানোর ধোঁয়া ও গন্ধে আশপাশের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে এ ভাগাড় সরিয়ে নেওয়ার বিকল্প নেই। ময়লার ভাগাড় সরিয়ে নিতে এলাকাবাসী মানববন্ধনও করেছেন। কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন সময় লিখিত আবেদনও দেওয়া হয়েছে। কোনো লাভ হয়নি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, নগরীর অলিগলি ও সড়কের অন্তত দেড়শ স্থানে খোলা ডাস্টবিনে (অস্থায়ী) আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বর্জ্যও ফেলা হচ্ছে খোলা ডাস্টবিনে। পরে সেই বর্জ্য খোলা ট্রাকে নেওয়া হচ্ছে উন্মুক্ত ডাম্পিং স্টেশনে। এতে নগরীর পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।

‘পুরানপাড়া উন্মুক্ত ডাম্পিং স্টেশনটির ধারণক্ষমতা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সেখানে আধুনিক ব্যবস্থাপনা নেই। আবর্জনা ফেলার কারণে আশপাশের জমি ও সাপানিয়া খালের পানি নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকশ মিটার দূর থেকেও দুর্গন্ধ নাকে যায়। মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ডাম্পিং স্টেশনের আশপাশের কয়েক হাজার মানুষ।’

তিনি বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরাতে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে আরও আন্তরিক হতে হবে। কার্যকর ও স্বাস্থ্যসম্মত বর্জ্য সংগ্রহ পদ্ধতি, জনসচেতনতা বাড়ানো, ওয়ার্ডভিত্তিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা উন্নত করা, বর্জ্য পৃথকীকরণ ও পুনঃচক্রায়নের মাধ্যমে বর্জ্যের পরিমাণ কমানো, বিভিন্ন শোধন পদ্ধতি ব্যবহার করে ডাম্পিং স্টেশনে যাওয়া বর্জ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক লিংকন বায়েন বলেন, সনাতন পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে হবে। সিটি করপোরেশন এলাকার বিদ্যমান বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় নাগরিকসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক করতে হলে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়াতেই হবে।

তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বর্জ্য থেকে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আবর্জনামুক্ত নগরী গড়ার তাগিদ দিলেও তা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দাগ কেটেছে বলে মনে হয় না। বরং প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ না পাওয়া ও বর্জ্য অপসারণের যন্ত্রপাতির অভাবকেই দুষছে সিটি করপোরেশন।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, নগরীতে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। মেয়র মহোদয়ের চিন্তা-ভাবনায় রয়েছে ময়লা-আবর্জনা যেন নগরবাসীর চোখে না পড়ে। সেই লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নকর্মীরা কাজ করছেন। প্রায় রাতেই নগরীতে ঘুরে ঘুরে মেয়র মহোদয় নিজেই কাজের তদারকি করছেন। একটি সুন্দর ও স্মার্ট নগরী গড়তে মেয়র নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বাসাবাড়ি থেকে সংগ্রহ করা ময়লা-আবর্জনা রাখার জন্য নগরীর ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে দুটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ১৩টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

‘খোলা ট্রাকে ময়লা-আবর্জনা পরিবহনের যে অভিযোগ করা হচ্ছে তা ঠিক নয়। ময়লা পরিবহনের কাজে সিটি করপোরেশনের ১৮টি ট্রাকেই ত্রিপল রাখা আছে। পরিবহনের সময় সেই ত্রিপল দিয়ে ময়লা-আবর্জনা ঢেকে নেওয়া হয়। তবে ময়লা-আবর্জনা ভেজা থকলে ত্রিপল দেওয়া হয় না। এছাড়া নগরীতে খোলা ডাস্টবিনের (অস্থায়ী) পরিবর্তে ঢাকনাযুক্ত ডাস্টবিন স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’

সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক হোসেন বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পুরো ঢেলে সাজানো হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের মতো বর্জ্য পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে শহরতলির লামছড়ি এলাকায় ছয় একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হবে। নগরীর সব ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করে প্ল্যান্টের মাধ্যমে পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য ২০২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়েছে।

এএ/জিকেএস