সত্তর দশকের খ্যাতিমান কবি মাহমুদ কামাল। তাঁর জন্ম কবিধাম খ্যাত টাঙ্গাইলে ১৯৫৭ সালের ২৩ অক্টোবর। তিনি টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদের সভাপতি। একাধারে কবি, অধ্যাপক, সাংবাদিক, গ্রন্থাগার সংগঠক, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। ‘অরণী’ নামের একটি গতিশীল লিটল ম্যাগের সম্পাদক। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘পরকীয়া’। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও সম্পাদনা মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৫টি।
Advertisement
বাংলাদেশ ও ভারতে সমানভাবে সমাদৃত তিনি। বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গের অহল্যা স্মৃতি পুরস্কার, সামসুল হক স্মৃতি পুরস্কার, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর পুরস্কারসহ পেয়েছেন দেশ-বিদেশে পঞ্চাশের বেশি পুরস্কার ও সম্মাননা। সম্প্রতি তিনি কথাসাহিত্যে ‘চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেছেন। তার পুরস্কারপ্রাপ্তি ও লেখালেখি সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাশিল্পী ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—
জাগো নিউজ: জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এলেন। এই দীর্ঘ সময়ে কবিতাচর্চায় নিবিষ্ট চিত্তে নিয়োজিত ছিলেন। আর কবিতার জন্য পেলেন চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার। কেমন লাগছে?মাহমুদ কামাল: প্রতিটি পুরস্কার ও সম্মাননা প্রেরণার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আনন্দও হয়। সেই সাথে লেখা হয় নতুন কবিতা। ইতোপূর্বে পঞ্চাশের অধিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছি। তার প্রায়ই ভালোবাসার নিদর্শন। এখন তো জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কারের জন্য অনেকেই তদবির করেন এবং পেয়েও যান। ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে যতবারই সম্মানিত হয়েছি, সবগুলোই নিরপেক্ষভাবে। আনন্দ এখানেই। চিন্তাসূত্রের সিদ্ধান্তটিও ওইরকমের। এ কারণে আমার আনন্দবোধ খুবই নির্মল। এ পুরস্কার ঘোষণায় আমি আপ্লুত।
জাগো নিউজ: আপনার কবিতা প্রসঙ্গে জানতে চাইবো। তবে, তার আগে আপনার কবি হয়ে ওঠা নিয়ে যদি কিছু বলতেন। কবিতাকে সিরিয়াসলি নিলেন কবে থেকে?মাহমুদ কামাল: এ বিষয়ে বলতে গেলে ফিরিস্তি একটু লম্বাই হবে। ব্যাপারটা এ রকম: দু’একটি কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় এই দেশে। এরকম ধারণা প্রচলিত; কিশোরের গোঁফ যখন উঠতে থাকে তখনই সে কবিতা লিখতে শুরু করে। গোঁফ ওঠা শেষ হলে অধিকাংশেরই কবিতা লেখা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ কবি হয়ে ওঠার সঙ্গে কিশোরের প্রেমের একটি সম্পর্ক রয়েছে। বয়ঃসন্ধির বাঁক বিভাজনের সময় অনেকেই কবি হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। আমি কি প্রেমে পড়েছিলাম? কৈশোরে ছিলাম কবিতার ঘোর বিরোধী। তারও আগে, কখনো লেখক হবো এ স্বপ্ন একেবারেই ছিল না। কিন্তু শিক্ষক পিতা স্কুলের খাতায় আমার নামটি রাখলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। পিতা গল্প-টল্প লিখতেন। তবে বাচ্চাদের। ‘গল্প বলি গল্প শোনো’ এবং ‘কচিকাঁচার আসর’ নামে তাঁর দু’টো গল্পের বই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর দ্রুতপঠন হিসেবে পাঠ্য ছিল। তিনি প্রাইমারি টিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিটিআই) সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। পিতা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের মধ্যে হয়তো লেখক হওয়ার আভাস পেয়েছিলেন। তাই পছন্দের কবি এবং পরবর্তীতে আমার প্রিয় কবিদের একজন আবু হেনা মোস্তফা কামালের নামের সঙ্গে মিল রেখেই তিনি নামটি রেখেছিলেন। ওই নাম থেকে মাহমুদ কামাল হয়ে ওঠার কাহিনি ভিন্ন। আপাতত কবি হওয়ার প্রচেষ্টার গল্পই হোক।
Advertisement
গোঁফ ওঠার সঙ্গে যেমন কবি হওয়ার ভাব জেগে ওঠে, আরও একটি কারণে অনেকেই জীবনের প্রথম ও শেষ লেখাটি লিখে থাকেন। স্থানটি হলো স্কুল বার্ষিকী। পড়ি পঞ্চম শ্রেণিতে। স্কুল থেকে বার্ষিকী বের হবে। কর্তৃপক্ষ সবার কাছে আহ্বান জানিয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে আমরাই বয়োজ্যেষ্ঠ। অতএব স্কুল ম্যাগাজিনে লিখতে হবে। কিন্তু কিভাবে গল্প, কবিতা লিখতে হয় জানি না। বড় বোন খুরশীদা রীণা তখন সাহিত্যচর্চা করতেন। তাঁর লেখা তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের মহিলা পাতায় নিয়মিত ছাপা হতো। লেখিকা হিসেবে শহরে তখন তাঁর পরিচয় হয়ে গেছে। শরণাপন্ন হলাম তাঁরই। অর্থাৎ আমার নামে তিনি যেন একটি লেখা তৈরি করে দেন। তা-ই হলো। লেখাটি ছিল কৌতুক ধরনের; নাম ‘একটু হাসুন’। জীবনের প্রথম যে লেখাটি ছাপা হলো তার রচয়িতা আমি না হলেও লেখক হিসেবে মনোটোনাস এই ছোট্ট শহরে আমার নামটি প্রচারিত হলো। ঘটনাটি ১৯৬৯ সালের।
স্বাধীনতার পর দেশে সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তনের জোয়ার আসে। পরিবর্তিত হই আমরাও। ১৯৭২ সালে যখন আট ক্লাসে পড়ি; তখন বন্ধুরা মিলে ‘এক ঝাঁক পায়রা’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করি। সেখানে একটি গল্প লিখি। এরপর গল্পই লেখা হতে থাকে অজস্র। শুরুতে বলেছি, কবিতার ছিলাম ঘোর বিরোধী। তখন অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিলে আমাদের গল্প ছাপা হতো। প্রায় প্রতি শনিবারেই। মুকুলের মাহফিলে আমার জেলা থেকে যারা লিখতেন, তাদের তালিকা দীর্ঘ। এদের প্রায় সবাই এখন লেখালেখি থেকে যোজন যোজন দূরে। বিশেষ করে ছাত্রী লেখকরা বিয়ের পর ঘর সংসারেই মন দিলেন। বন্ধুরা কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, সেনাবাহিনীর অফিসার কিংবা বিসিএস কর্মকর্তা হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে তারা আর লেখক হলেন না। ওই সময় আমাদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা ছিল, কে কত লিখতে পারে এবং কার কয়টি গল্প মুকুলের মাহাফিলে ছাপা হয়। এ ব্যাপারে আমিই ছিলাম নিরলস। লেখক নাম কিন্তু ওই আবু হেনা মোস্তফা কামাল। ব্র্যাকেটে ডাক নাম ‘বাবুল’ও থাকতো।
তাহলে কবিতা লেখা শুরু হলো কবে? ১৯৭৪-এ তখন আমি এসএসসির পরিক্ষার্থী, ষষ্ঠ শ্রেণির এক মেয়ের প্রেমে পড়ে যাই। একতরফা। কারণ প্রেম কাকে বলে তা বোঝার বয়স তখনো মেয়েটির হয়নি। যদিও বয়স অনুপাতে ওর শরীর ছিল বাড়ন্ত। ওর কাছে প্রেমের চিঠি লিখতে গিয়ে প্রেমিকার হাতে পৌঁছানোর আগেই বাবার কাছে ধরা পড়ে যাই এবং এই ‘অপরাধে’ হৃদয় ক্ষরণের সাথে দৃশ্যমান হয় শরীরের নানা ক্ষতচিহ্ন। প্রেমিক কিন্তু দশম শ্রেণির। ওই বছরই এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হই। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছি এরকম অনুমোদন তখন আমার কথায় এবং চলাফেরায়। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ভালো লাগে। ক্লাসে অধ্যাপকদের লেকচার না শুনে ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে থাকি। কবিতার ঘোর রিরোধী এই আমি লিখে ফেলি ‘উত্তালের কাছে খোলা চিঠি’ নামের একটি কবিতা। লিখি ‘সবুজ প্রান্তরে অন্য লোক’। শেষের কবিতাটি ছিল স্বরবৃত্তের। তখন ছন্দ কাকে বলে জানতাম না। কবিতা লেখার ঘোর বিরোধী হলেও আধুনিক কবিতা পড়তাম। কিছুই বুঝতাম না। তবুও টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কিংবা বাজারের পয়সা চুরি করে বই কিনতাম। ওই বছরই কবি ফরহাদ মাজহারের প্রথম কবিতার বই ‘খোকন ও তার প্রতিপুরুষ’ বইটি কিনে ফেলি। বইটিতে স্বরবৃত্ত ছন্দের বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। ওই কবিতাগুলো যে স্বরবৃত্তে লেখা তা পরবর্তীতে বুঝলেও তখন কবিতাগুলোর দ্যোতনা মনে গেঁথে যায়। সেই ছন্দ অনুকরণে ‘সবুজ প্রান্তরে অন্য লোক’ লিখে ফেলি কিনা তার মীমাংসা এখনো হয়নি। ছন্দের ওই দ্যোতনা এবং একটি মুখকে হৃদয়ে বসিয়ে দেওয়ার কারণে বোধকরি কবিতা লেখার ঘোর বিরোধী এই আমি নিখুঁত স্বরবৃত্তের ওই কবিতাটি লিখে ফেলি। ষষ্ঠ শ্রেণি তখন সপ্তমে। আমার হৃদয়ও তখন সপ্তমে। কবিতাটি ছাপা হয়ে যায় একটি সংকলনে। সংকলনের একটি কপি মেয়েটির হাতেও পৌঁছে গেল। কিন্তু মেয়েটি তরুণ কবিকে একেবারেই পাত্তা দিলো না। তাহলে কাকে ভালোবাসলাম? কিন্তু লেখা হতে থাকে একটির পর একটি কবিতা। ততদিনে শুধু প্রেমিক নয় কবিতা প্রেমিকও হয়ে উঠেছি। মেয়েটি কবি হয়ে ওঠার জন্য আমার কাছে মন্ত্র হয়েই রইলো। প্রতি বিকেলেই ওর সঙ্গে দেখা হয়। প্রতিরাতেই লেখা হয় নতুন কবিতা। বলা চলে ওই মেয়ের জন্যই এই শহরে আমি কবি হয়ে গেলাম। ছাপাও হতে থাকে ওইসব প্রেমপদ্মের পদ্য।
এখনো প্রেমের কবিতা লিখি। এখনো লিখি, ‘চোখের নেশায় ছায়াবৃক্ষ স্থাপিত হয় ফ্রেমে/বয়স যতোই বাড়ুক রক্ত পথ করে দেয়ে প্রেমে’/কিংবা ‘এইসব হলো অষ্টাদশীর ঘ্রাণ/বেঁচে থাকবার শাল নির্যাস প্রাণ।’ অথবা ‘চারুমুখ’র মতো নির্লজ্জ প্রেমের কবিতা। মেয়েটির যেদিন বিয়ে হয়ে গেল; সেদিন লিখি ‘তুমি এখনও আমার অন্তরেই আছো’ এবং ‘সানাইয়ের সুরে মেয়েটি চলে যাবে দূরে।’ শেষের কবিতাটি তসলিমা নাসরিনের সম্পাদনায় তার ছাত্রী জীবনে প্রকাশিত ‘সেজুঁতি’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কবিতাটির শেষ দু’পঙক্তি এরকম: ‘কোথায় সে যাবে? কোন আঘাটায় যাবে?/যে ছেলে ব্যর্থ হলো তার মতো ভালোবাসা পাবে?’
Advertisement
সম্প্রতি ‘বালক বয়সে’ শিরোনামে আমার একটি কবিতার বই বের করেছেন পলল প্রকাশনীর খান মাহবুব। সত্যিকার অর্থে বালক বয়সের লেখা কবিতাগুলোই সেখানে স্থান পেয়েছে। তার মধ্যে, ‘উত্তালের কাছে খোলা চিঠি’; ‘সবুজ প্রান্তরে অন্যলোক’ এবং ‘সানাইয়ের সুরে মেয়েটি চলে যাবে দূরে’ কবিতা তিনটি আছে।
এরপর সেই মেয়েটির সঙ্গে আর দেখা হয়নি। শুনেছি ওর একটি ফুটফুটে নাতি হয়েছে। খুবই মর্মান্তিক সংবাদ। বোধহয় বুড়িয়ে গেছে মেয়েটি। কিন্তু ও তো এখনো আমার কাছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীই রয়ে গেছে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী বলেই এখনো প্রেমের কবিতা লিখতে পারি। কাব্য বিচারে যদি সামান্য কবি হয়ে উঠি তবে বলবো এই অসামান্য অবদান ওই সপ্তমেরই। ও কখনো আমার কাছে বুড়ি হবে না। কবিত্ব শক্তি নয়, প্রেমই ছিল কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা। আমার কবি হয়ে ওঠা গল্প তাই এ রকমই সাদামাটা।
জাগো নিউজ: আপনার কবিতায় জীবন ছবির চিত্র পাওয়া যায়। এর পেছনে কী কী অনুষঙ্গ ভূমিকা পালন করেছে। মাহমুদ কামাল: ছাত্রজীবনে বাম সংগঠন করেছি। আবার লায়ন্স ক্লাবের অঙ্গ সংগঠন লিও ক্লাবও করেছি। একবারেই পরস্পরবিরোধী সংগঠন। দুটোরই নেপথ্যে ছিল মানুষের কল্যাণ। লিও ক্লাব বুর্জোয়া সংগঠন হলেও তখন আমাদের চোখে মুখে ছিল মানুষের হয়ে কাজ করা। ছাত্রত্ব শেষ হলে মোহভঙ্গ হয়ে যাওয়ার কারণে কোনোটাতেই নিজেকে আর জড়াইনি। যদি কিছুটা মানুষ হয়ে থাকি তবে সংগঠন দুটো আমাকে সাহায্য করেছে বলে মনে করি। সাংগঠনিক নেতৃত্ব সম্পর্কে কিছুটা বুঝতে পেরেছি লিও ক্লাব থেকে। কবিতায় আশ্রয় নিয়ে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে কবিতা লিখলেও এরকম বাক্যও লিখি ‘বৃত্তের ভেতর বাড়ি ঘুরে ফিরে অবশেষে/মিথ্যেকে সাজিয়ে গুছিয়ে কবিতা বানাই।’
জাগো নিউজ: প্রেমকে আপনি কিভাবে দেখেন? মানুষে মানুষে যে প্রেম, নর-নারীর যে প্রেম—এ প্রশ্ন এ কারণে যে, আপনার কবিতায় প্রেমের যে বিচিত্র রূপ, তা থেকে এটিকে ঠিক নিরূপন করা মুশকিল। কোথাও দ্ব্যর্থতাপূর্ণ, কোথাও অবদমিত, কোথাও ধোঁয়াশাময়।মাহমুদ কামাল: প্রেমের কারণেই তো কবিতায় সমর্পিত। তরুণবেলার গল্প তো হলো।। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টেছে। প্রেম শুধু নর-নারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ওই যে বললেন, ‘মানুষে মানুষে’—মানুষকে ভালোবাসাও তো প্রেম। মহৎকে ভালো না বেসে পারা যায় না। আবার পরকীয়াও তো প্রেম। পরকীয়া নামে আমার গোটা এক কাব্য রয়েছে। ছাত্রজীবনে লেখা। এ প্রসঙ্গে সত্য ভাষণটি হলো ওই কাব্যের একটি শব্দও নিজেকে নিয়ে নয়। পরকীয়া তো চিরকালীন একটি বিষয়। বিষয়টিকে প্রেমময় এবং কাব্যময় করার জন্যই কবিতাগুলো লিখেছিলাম। হয়তো কাব্যটি দ্ব্যর্থতাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
জাগো নিউজ: বাংলা কবিতার তিরিশ পরবর্তী কোন কোন কবি আপনাকে বিশেষভাবে টানেন এবং এদের কারও দ্বারা আপনার লেখা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে কি না।মাহমুদ কামাল: যখন কবিতা পড়ি; তখন পাঠক হিসেবেই পড়ি। তিরিশ পরবর্তী অনেকের কবিতাই আমার প্রিয়। ভালো লাগা কবির তালিকা দীর্ঘ। তাঁদের কবিতা ভালো লাগে বলে নিজে লেখার সময় সাবধান হয়ে যাই। আমি একটি কবিতা অন্তত তিনবার লিখি। নিজের কবিতা পাঠক হিসেব একাধিকবার পড়ে নিজে নিজেই অনুমোদন দেই। যে কারণে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কম। তারপরও কেদার ভাদুড়ী এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কখনো কখনো অসুবিধায় ফেলেছে। বলেছি প্রিয় কবির সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের অরুণকুমার সরকার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, কেদার ভাদুড়ী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবং শহীদ কাদরীর কবিতা এখনো পড়ি। ওমর আলীর প্রথমদিকের কিছু কবিতা আমার প্রিয় তালিকার মধ্যে। ‘প্রিয় কবিতা’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করছি। সেখানে চর্যাপদ থেকে শুরু করে মাসুদার রহমান পর্যন্ত কবির কবিতা আছে। পশ্চিমবঙ্গের অতি তরুণ কবি সুমন পাটারি তার সম্পর্কে কিছুই জানি না, তার কবিতাও আছে।
জাগো নিউজ: আপনি একবার বলেছিলেন কবিকে নিরন্তর প্রচেষ্টায় যেমন হয়ে উঠতে হয়, পাঠকেরও তেমনি হয়ে ওঠার দায় আছে। পাঠককূল নির্দিষ্ট কবির সৃষ্টি অনুধাবনের উপযোগী হয়ে উঠবেন, নাকি কবি বৃহত্তর পাঠকের রুচি বুঝে লিখবেন। আপনি কী করেন?মাহমুদ কামাল: পাঠকের তো শ্রেণি বিভাজন আছে। কবিরও শ্রেণি বিভাজন আছে, চিন্তার পার্থক্য আছে। আছে দৃষ্টিভঙ্গিরও পার্থক্য। এর মধ্যে মিল রেখে কিংবা ছকের মধ্যেই কবির পাঠক গড়ে ওঠে। নিজের লেখা সম্পর্কে আমার নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত নেই। ব্যক্তিজীবনে অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি এবং এখনো ভুগছি। হৃদয়জাত বলেই কখন কোন বাক্যটি লিখে ফেলি, তার নির্দিষ্ট কোনো কার্যকারণ নেই। কাজেই পাঠকের রুচির কথা লেখার সময় কখনোই ভাবি না। কবিতার পাঠক এমনিতেই কম। আর আমার লেখার কোনো পাঠক আছে কিনা তারও কোনো হিসেব নিকেশ নেই।
জাগো নিউজ: বাংলা সাহিত্যের একাডেমিক পড়াশোনা আপনার কাব্যসত্তায় কীভাবে প্রভাব ফেলেছে? কিংবা পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যকে যেভাবে অভিজ্ঞতায় নিয়েছেন, সে ব্যাপারে জানতে চাই।মাহমুদ কামাল: একাডেমিক পড়শোনা তো অবশ্যই কাজে লেগেছে। এখন স্বভাব কবির যুগ নয়, স্বাভাবিক কবির যুগ। সাহিত্য পড়েছি এবং পড়িয়েছি। সবকিছুতেই শুদ্ধতার একটি মূল্য আছে। জানাতে হলে জানতে হবে। পরিশীলতা বলে একটা শব্দ আছে না! একাডেমিক পড়াশোনা পরিশীলিত হতে সাহায্য করে।
জাগো নিউজ: বাংলা কবিতায় ইংরেজি অনুবাদ নিশ্চয়ই জরুরি। এ নিয়ে কেমন কাজ হচ্ছে বলে মনে করেন?মাহমুদ কামাল: নিকট অতীতে তেমন ছিল না। এখন কিছুটা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হলে হয়তো আমাদের লেখা সম্পর্কে পৃথিবীর অধিক মানুষ জানতে পারতেন। ভারতে কিন্তু ইংরেজি অনুবাদ বেশ হচ্ছে।
জাগো নিউজ: কবিতার আবৃত্তি কবিতাকে ম্লান করে বলে মনে করেন?মাহমুদ কামাল: কিছুটা। কবি লেখেন একভাবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবৃত্তি হয় অন্যভাবে। কবিতাকে ম্লান করলেও আবৃত্তির কারণে কবিকেও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে দেখি।
জাগো নিউজ: অনুজ কবিদের কাছে প্রত্যাশা কী?মাহমুদ কামাল: রবীন্দ্রনাথ ‘ঐক্যতান’ কবিতায় নবীনদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘শুধু ভঙ্গী দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ’। তো, আঙ্গিকসর্বস্ব কবিতা যেমন ক্লান্তিকর আবার ছন্দহীনতাও কবিতার মাধুর্য কমিয়ে দেয়। রয়েছে অস্বীকারের প্রবণতা। অবশ্য সব যুগেই কম বেশি তা ছিল। তরুণদের মধ্যে যুক্তিহীন অস্বীকারের প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তরুণবেলা খুব কম সময়ের। উত্তরসূরীরা পা বাড়িয়েই আছে তাদের ধরার জন্য। কাজেই যুক্তিপূর্ণ অস্বীকার কবির মেধা ও মননকে যেমন বাড়িয়ে দেয় পাঠককূলও গ্রহণ করতে পারেন ভালো-মন্দের দিকটি।
এসইউ/জিকেএস