ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে দিনে প্রায় সাত হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। আগে এসব বর্জ্যের একটা বড় অংশ খোলা ট্রাকে অপসারণ করতো সিটি করপোরেশন। তখন বর্জ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তো রাস্তায়। সেই চিত্র অনেকটাই বদলেছে। খোলা ট্রাকে বর্জ্য পরিবহন করা হচ্ছে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে। কম্প্যাক্টর, কনটেইনার ক্যারিয়ার ও ডাম্প ট্রাকের সংখ্যাও বেড়েছে। ফলে রাস্তাঘাটে গৃহস্থালির ময়লা পড়ার প্রবণতা কমছে।
Advertisement
গৃহস্থালি-হাটবাজারের বর্জ্য অপসারণ ও রাস্তা পরিষ্কারের সময়ও পরিবর্তন এনেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। এখন রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণ করছে দুই সিটি করপোরেশন। সড়কে দিনে বর্জ্য পরিবহন বন্ধ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক যন্ত্রপাতিও যোগ হচ্ছে। এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন নাগরিকরা।
ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালে খোলা ট্রাক ও রাতে বর্জ্য অপসারণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তাই এখন খোলা ট্রাকে বর্জ্য অপসারণ করা হয় না। যে কয়েকটি খোলা ট্রাকে বর্জ্য পরিবহন করা হয়, সেগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকে। এছাড়া রাতে নির্ধারিত সময়ই বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেকটাই শৃঙ্খলা ফিরেছে।
তবে খোলা ট্রাকে বর্জ্য পরিবহনের সময় রাস্তায় ময়লা পানি গড়িয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, খোলা ট্রাকে বর্জ্য ঢেকে রাখলেও ময়লা পানি রাস্তায় গড়িয়ে পড়ছে। এতে সড়কে দুর্গন্ধ ছড়ায়, পরিবেশ দূষণ হয়। তাই সিটি করপোরেশনকে পর্যাপ্ত কনটেইনারবাহী গাড়ি কিনতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
Advertisement
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিবহন করার জন্য ভারী যানবাহন (৬ চাকা থেকে ১০ চাকার গাড়ি) রয়েছে ১৪৭টি। এর মধ্যে ২৪টি কম্প্যাক্টর, ৩৪টি কনটেইনার ক্যারিয়ার ও ১৭টি ডাম্প ট্রাক। এগুলোর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বর্জ্য পরিবহন করা হচ্ছে। এভাবে গত অর্থবছরে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডের ৮৪ শতাংশ বর্জ্য অর্থাৎ প্রায় ১১ লাখ টন গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন করে আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে পরিবেশসম্মত উপায়ে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়েছে।
ডিএনসিসি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১১টি পরিবেশবান্ধব কম্প্যাক্টর ও দুটি ব্যাকহো লোডার কেনার ব্যবস্থা হয়েছে। এরই মধ্যে কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বদ্ধ ড্রেন আধুনিক পদ্ধতিতে পরিষ্কারের জন্য দুটি মেকানিক্যাল জেট অ্যান্ড সাকার কেনা হয়েছে। যান্ত্রিকভাবে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার জন্য নয়টি অত্যাধুনিক রোড সুইপার আছে ডিএনসিসির। নতুন তিনটি রোড সুইপার কেনা প্রক্রিয়াধীন। বায়ুদূষণ রোধে দুটি ওয়াটার স্প্রে ক্যানন কেনা হয়েছে। এছাড়া জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় জাইকার ‘ক্লিন ঢাকা মাস্টারপ্ল্যান ২০২০-৩৫’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এর খসড়া প্রস্তুত করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগে।
মহাখালী এলাকার গৃহস্থালি ও হাটবাজারের বর্জ্য সংগ্রহ করে প্রথমে কড়াইল বস্তি এলাকায় নির্দিষ্ট এসটিএসে রাখা হয়। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, এই এসটিএস থেকে দুটি খোলা ট্রাক দিয়ে বর্জ্য আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে নিয়ে যাচ্ছেন চালকরা। বর্জ্য ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকলেও ময়লা পানি রাস্তায় গড়িয়ে পড়ছে। এ ময়লা পানি থেকে বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। একইভাবে কারওয়ান বাজারে কাঁচামালের বর্জ্য চারটি খোলা ট্রাক দিয়ে পরিবহন করা হচ্ছে। তবে মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও, ফার্মগেট এলাকায় এসটিএস থেকে কনটেইনারবাহী ট্রাক বা গাড়ি দিয়ে বর্জ্য অপসারণ করতে দেখা যায়।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়নে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ডিএনসিসি। সম্প্রতি চায়না একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে চুক্তি করা হয়েছে। আমিনবাজার ল্যান্ডফিলে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। তাই এখন থেকে ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
Advertisement
তিনি বলেন, আগে খোলা ট্রাকে বর্জ্য অপসারণ করা হতো। এখন কিছু ওয়ার্ড থেকে খোলা ট্রাকে বর্জ্য অপসারণ করা হলেও ত্রিপল দিয়ে তা ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। এতে রাস্তায় বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে না। তবে খোলা ট্রাক থেকে ময়লা পানি রাস্তায় পড়ে বলে শুনেছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০টি আঞ্চলিক অফিসের অধীনে ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। ডিএসসিসি ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ বর্জ্য পরিবহনের জন্য ডিএসসিসির ছয় থেকে ১০ চাকার ময়লাবাহী গাড়ি রয়েছে ৩১৭টি। এর মধ্যে শতাধিক খোলা ট্রাক।
ডিএসসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডটি অঞ্চল-৩ এর আওতাধীন। গত এপ্রিলে এই ওয়ার্ডের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পলাশীতে একটি বড় এসটিএস উদ্বোধন করেন সংস্থাটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এখন পুরো ওয়ার্ডের বর্জ্য এখানে স্তূপ করে রাখা হয়।
গত বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) রাতে সরেজমিনে দেখা যায়, আলাদা দুটি ট্রাক দিয়ে এই বর্জ্য অপসারণ করেছেন ডিএসসিসির কর্মীরা। এর মধ্যে একটি খোলা ট্রাক। ট্রাকটিতে বর্জ্য স্তূপ করার পর তা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পরিবহনের সময় রাস্তায় কোনো বর্জ্য ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি।
এই খোলা ট্রাকের চালক জহির উদ্দিন বলেন, এই বর্জ্য যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে নেওয়া হবে। ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়ায় রাস্তার বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে না। গত কয়েক বছর ধরে এভাবেই বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে।
ডিএসসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক জাগো নিউজকে বলেন, আগের তুলনায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক শৃঙ্খলা এসেছে। এখন সড়কে বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হয় না। গৃহস্থালি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করার পর তা সরাসরি এসটিএসে রাখা হচ্ছে। রাতে নির্দিষ্ট সময়ে তা আবার ল্যান্ডফিলে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে নাগরিকদের অভিযোগ কমছে।
ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্তকর্তা বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে ডিএসসিসি আধুনিক সব যন্ত্রপাতি কিনছে। নিজস্ব অর্থায়নে ১৫টি ১০ টন ও ১৫টি সাত টন ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৩০টি কম্প্যাক্টর ভেহিকল কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো কেনার পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আরও পরিবর্তন ঘটবে।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিউল্লাহ সিদ্দিক ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ডিএসসিসি এলাকা দিনে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়। খোলা ট্রাকের পাশাপাশি কনটেইনারবাহী ট্রাক দিয়ে এসব বর্জ্য অপসারণ করা হয়। এসব বর্জ্য অপসারণ করতে দিনে ৬৫০ থেকে ৭০০ ট্রিপ লাগে। সঠিকভাবে পরিবহন করায় কোথাও সড়কে বর্জ্য পড়ছে না।
এমএমএ/এএ/এমএস