ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে।
Advertisement
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক, ভূ-রাজনীতি, নিরাপত্তা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ প্রতি বছর অসংখ্য মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করে। অথচ একই অভিযোগে বাংলাদেশের সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটি। এই নিষেধাজ্ঞার কোনো গুরুত্ব আছে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে নানা সমালোচনা আছে। এই অভিযোগ একদিনের নয়। কেউ-ই এমন একটি হত্যাকাণ্ড প্রত্যাশা করে না। বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোও এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সরব থেকেছে। মিডিয়ায় আলোচনা হয়েছে।
Advertisement
সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র বলুক বা না বলুক, বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে নজর দিতেই হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে বলার অধিকার রাখে কি না? যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে হইচই পড়েছে, তা ঠিক বলে মনে করি না। এখানে দুটি বিষয় সামনে আনতে হবে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রে বহু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বলবে যে, সরকার জানে না এমন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে। একই দাবি আমাদের সরকারও করে আসছে। বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেআইনি হত্যাকাণ্ড অনেক বেশি।
ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধের নামে লাখ লাখ মানুষ হত্যার অভিযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
জাগো নিউজ: যুদ্ধনীতি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঘোরতর অভিযোগ আছে…
ইমতিয়াজ আহমেদ: একদম। যুক্তরাষ্ট্র দেশের বাইরে একতরফা যুদ্ধ চালিয়ে যে পরিমাণ মানুষ হত্যা করেছে, তার হিসাবও তো মানুষ রাখছে। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরান ও সিরিয়ায় যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র লাখ লাখ মানুষ হত্যা করলো, তা কি আইনসম্মত? নাকি বেআইনি? যুক্তরাষ্ট্র কোন আইন বলে এসব যুদ্ধ করছে? নারী-শিশু নির্বিচারে হত্যা করেছে বেআইনি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। হাসপাতাল, মসজিদ, বিয়ের অনুষ্ঠানে বোমাবর্ষণ করে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা।
Advertisement
দেশের ভেতরে-বাইরে সমানতালে বেআইনিভাবে মানুষ হত্যা করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করে বর্ণবাদী আচারণ প্রকাশ করছে যুগ যুগ ধরে। দেশটির পুলিশ কর্তৃক হত্যাকারীদের ৮০ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ।
জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা বলছেন। তাহলে এই সময়ে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রসঙ্গ তোলার কী কারণ থাকতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু আমি মূলত এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাই না। কারণ গুরুত্ব দিলে যুক্তরাষ্ট্রের অনৈতিক শক্তিকে স্বীকার করে নিতে হয়। আমরা তা করতে পারি না।
আমাদের সচেতনতা বাড়ানো দরকার। যুক্তরাষ্ট্রে কী পরিমাণ মানুষ হত্যার শিকার হয়, তা মানুষ জানে না। জানা দরকার। অনেকেই বলেন, সেখানে এসব হত্যার বিচার হয়। এটাও ঠিক নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশের ওপর হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় না। প্রযুক্তির সময়ে সবই এখন পাওয়া যায়।
প্রাচুর্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্র দিনের পর দিন অন্যায় করে পার পেয়ে যায়। এটি আমাদের সমাজেও আছে। গ্রামের প্রভাবশালী গরিবের ওপর অন্যায় করতে দ্বিধা করে না। আবার নিজের দোষ ভুলে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়।
এখন বিরোধী পক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে আমলে নিয়ে রাজনীতি করছে। আবার তারা যখন ক্ষমতায় যাবে বা ছিল, তখন এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। এটা ঠিক নয়।
জাগো নিউজ: দেশে তো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে সরকারগুলোর পরম্পরায় এবং তা অস্বীকার করার উপায়ও নেই...
ইমতিয়াজ আহমেদ: হ্যাঁ, আলোচনা এটি নিয়েই হওয়া উচিত। কারণ এমন একটি হত্যাকাণ্ড যে পরিবারে ঘটে, কেবল তারাই বোঝে এর যাতনা। যুক্তরাষ্ট্র কী বললো না বললো, তাতে কিছু যায় আসে না। নিজেদের বোধের জায়গা থেকেই শোধরানো দরকার।
মানবাধিকারের কথা বললেও যুক্তরাষ্ট্রেই বর্ণবাদের ঘটনা বেশি/প্রতীকী ছবি
জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের প্রশংসাও করেছে।
ইমতিয়াজ আহমেদ: হ্যাঁ। এটি তো বড় অর্জন। সন্ত্রাস দমনে সরকার জিরো টলারেন্স অবস্থানে আছে বলেই এই সফলতা। আপাতত আমরা শূন্য কোটায়। একইভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধেও সরকার জিরো টলারেন্স অবস্থান নিতে পারে।
জাগো নিউজ: কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলে আসছে, সন্ত্রাস-মাদক কারবারিদের দমনে জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। অস্ত্রের ব্যবহার আত্মরক্ষার্থেই। আপনি কী মনে করেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: পুলিশ, র্যাব তাই বলে আসছে। এমন চিত্র পাশের দেশেও আমরা দেখতে পাই। কাশ্মীরে বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে। সীমান্তে হত্যা হচ্ছে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে হচ্ছে। এটি গোটা পৃথিবীর সমস্যা।
কিন্তু এরপরও বলবো, বাংলাদেশকে এই অভিযোগ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থেই এমন হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্র এই সময়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশেষ কোনো কৌশল প্রয়োগ করতে চাইছে কি না?
ইমতিয়াজ আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্রকে আসলে বোঝা বড় মুশকিল। অনেকেই ভাবেন যে, যুক্তরাষ্ট্র অনেক চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে আফগানিস্তানে। সেখান থেকে রাতারাতি পালিয়ে গেলো।
তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। আবার তালেবানের বিরুদ্ধেই ২০ বছর যুদ্ধ করলো। শেষে তালেবানের কাছেই পরাজিত হয়ে চলে গেল। ওসামা বিন লাদেনকে ধরার নাম করে গোটা আফগানিস্তান দখল করলো। অথচ বিন লাদেন ছিল সৌদি আরবের নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রযুক্তি, তার মধ্য দিয়ে যে কোনো ব্যক্তি ধরা কোনো ব্যাপারই নয়। বিন লাদেনকে ধরতে একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। আবার তালেবানের কাছেই ধরাশায়ী হয়ে ফিরে গেল।
এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা যেভাবে চিন্তা করি তাদের আচরণ ঠিক তেমন নয়। মানবাধিকার প্রশ্নে যারা যুক্তরাষ্ট্রকে গুরুত্ব দেন, তারা হয় অন্ধ, না হয় মানবাধিকারের বিষয়টিই বোঝেন না।
বাংলাদেশে মানবাধিকারের বিষয়টি আমাদেরই মাথা ব্যথা। লেখালেখি তো হচ্ছে। টকশোতে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদে মাঠে নামছেন। আমরা একটি হত্যাকাণ্ডও চাই না।
এ কারণে আমি মনে করি না, বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে নাক গলানোর নৈতিক কর্তৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায়ই পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে রাজপথ
জাগো নিউজ: এ নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে বিশ্লেষকরা দুটি বিষয় সামনে আনছেন। প্রথমত, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সামনে। গত দুটি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ছিল। এবারের নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে যুক্তরাষ্ট্রের এমন নিষেধাজ্ঞার কৌশল কি না? দ্বিতীয়ত, প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা বলয়ে (কোয়াড) বাংলাদেশকে যুক্ত করতে বিশেষ চাপ কি না?
ইমতিয়াজ আহমেদ: প্রথম প্রশ্নের আলোকে যদি বলি, তাহলে বলবো, গণতন্ত্রের জন্য দুর্বলতা রয়েছে, তা আমাদেরই বের করতে হবে। বাইরের কোনো শক্তি কী বললো, তার ওপর নির্ভর করলে বা গুরুত্ব দিলে সমাধান আসবে না। বাইরের শক্তিকে গুরুত্ব দিলে নিজেদের শক্তি দুর্বল হয়।
মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের ঐতিহাসিকভাবে সম্পর্ক মধুর নয়। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্র ভালো কিছু করতে চাইলেও বাংলাদেশের মানুষ সেটি ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে, ভিয়েতনামে গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। পরে সেখান থেকে পালিয়ে গেছে। এ কারণে বাংলাদেশ নিয়ে মাথা ঘামালেও ফল একই আসবে।
তবে আমাদের সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। অন্যরা সুযোগ নেবে, তা হতে দেওয়া যায় না। এমনটি হলে চাপ বাড়বে এবং তা অবশ্যই মঙ্গলজনক হবে না। আমাদের ভেতরের পরিস্থিতি খারাপ থাকলে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিগুলো হস্তক্ষেপ করতে চাইবেই।
এএসএস/এইচএ/জিকেএস