মতামত

সব কিছুই নিয়মরক্ষার?

কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। এরমধ্যেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে ২০ ডিসেম্বর সংলাপের মাধ্যমে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের তৎপরতা শুরু করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে আগের বার ৩১টির সঙ্গে সংলাপ হয়েছিল। এবার কতটি দলের সঙ্গে সংলাপ হবে তা জানা না গেলেও অনেক নিবন্ধিত দলই আমন্ত্রণ পাবে। বিএনপি আমন্ত্রণ পেলেও বঙ্গভবনে যাবে কিনা সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। এই সংলাপের মাধ্যমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা সম্ভব হবে বলে বিএনপি মনে করে না। অন্য দলগুলোও হয়তো মনে করে না। তারপরও অনেক দলই রাষ্ট্রপতির সংলাপে উপস্থিত হয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরবে।

Advertisement

রাষ্ট্রপতি সবার কথা শুনবেন। কেউ নামের তালিকা দিলে সেটাও রাখবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমিশন গঠন করা হবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পরামর্শ অনুযায়ী। ইসি গঠনের জন্য আইনের কথা সংবিধানে বলা থাকেলও আইনটি কোনো সরকারই করার গরজ বোধ করেনি। এবারও সে দাবি উঠেছে এবং তা নাকচ হয়ে গেছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলে দিয়েছেন, সময়ের অভাবে এবারও আইন হচ্ছে না। তাই রাষ্ট্রপতি সংলাপ ও সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। এতে অতীতের মতো ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছারই প্রাধান্য থাকবে, এটাও নিশ্চিত করেই বলা যায়।

সবার মন জুগিয়ে আমাদের দেশে কি কিছু আদৌ হয়? সব কিছুই আমরা এখন নিয়মরক্ষার জন্য করি। নিয়মরক্ষার নির্বাচন। নিয়মরক্ষার সংলাপ। নির্বাচনের নামে প্রহসন হলেও আমরা তা মেনে নেই। না নিয়ে উপায় কি? জনমতের প্রতিফলন হয়তো ঘটছে না কিন্তু নিয়ম তো রক্ষা হচ্ছে! আন্দোলন করে দাবি আদায়ের ক্ষমতা আমাদের দেশে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হারিয়েছে। তাই সব হয় সরকারের ইচ্ছায়, সরকারের সুবিধায়। ইসি গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির সংলাপে যদি বিএনপি না যায়, তাহলে ইসি গঠন বন্ধ থাকবে না। বিএনপির মতামত সরকার যে আমলে নেয় না, তা তো বহুবার দেখা গেছে। তাতে কি সরকারের জন্য বড় সমস্যা হয়েছে?

কেউ কেউ সরকারের বৈধতার সংকট, নৈতিকতার সংকটের কথা বলেন। এগুলো শুনতে ভালো। কিন্তু শাসনকাজ চালাতে তাতে অসুবিধা হয় না। আওয়ামী লীগ দুটি জাতীয় নির্বাচন করেছে নিজেদের ইচ্ছামতো। বিএনপিসহ অনেকে এতে নাখোশ, ক্ষুব্ধ। আবার অনেকে তো আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে যারা সোচ্চার, দেশে কিংবা বিদেশে, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পথচলা কি বন্ধ বা বাধাগ্রস্ত করতে পেরেছে?

Advertisement

সম্প্রতি মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একটি বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার ঘটনাটি নিয়ে কেউ কেউ উৎসাহ বোধ করছেন। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে বলে কেউ কেউ বোগল বাজাতে শুরু করলেও বিষয়টি আসলে তত গুরুত্বপূর্ণ হলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দিন কয়েক পরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতেন না। হ্যাঁ, কিছু সমস্যা হয়তো হয়েছে, কিন্তু সেটা একেবারে সরকারের জন্য কোনো লালবার্তাবাহীও নয়।

নিষেধাজ্ঞা আরোপ আমেরিকার একটি রুটিন কাজ। মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদিকে তো জাঁকজমকপূর্ণ অভ্যর্থনাও জানানো হয়েছিল। র‌্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে, এই র‌্যাবকে তো তারাই প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকার প্রশংসা তো এরমধ্যে আমেরিকার পক্ষ থেকে করা হয়েছে। তো, জঙ্গিবাদ দমনে সফলার পেছনে র‌্যাবের ভূমিকার কথা কি আমেরিকার জানা নেই? যা হোক, এটাও সম্ভবত কোনো পক্ষকে খুশি করতে আমেরিকার একটি নিয়মরক্ষার সিদ্ধান্ত।

বিএনপি সংলাপে অংশ না নিলেও ঠিক সময়েই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ঘোষণা আমরা শুনবো। নতুন ওই নির্বাচন কমিশনের অধীনেই দেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি সেই নির্বাচনে অংশ নেবে? এখন পর্যন্ত বিএনপির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া। বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য সরকার কি বড় কোনো ছাড় দেবে? অর্থাৎ সরকার পদত্যাগ করে ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে?

এখন পর্যন্ত সরকারের দিক থেকে বিএনপির প্রতি নমনীয়তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘উন্নত’ চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি সরকার কানে তোলেনি। গত ১৯ নভেম্বর থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলে আসছেন যে, বেগম জিয়া ‘জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’। দলনেত্রীর মুক্তির জন্য আন্দোলনের কথা বলেও তেমন কিছু অর্জিত হয়নি। বেগম জিয়ার ‘কিছু হলে' দেশে আগুন জ্বলবে বলে বিএনপি আশায় আছে। এমন কত দুরাশা তারা বহু বছর ধরেই করছে। কি হলে কি হবে – এই অনিশ্চয়তা দিয়ে দেশ বা দেশের রাজনীতি চলে না। সঠিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া মানুষের মনে পরিবর্তনের ঢেউ তোলা যায় না।

Advertisement

বিএনপি ভুল রাজনীতি ও ভুল কৌশলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। তারেক রহমানকে ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি বানিয়ে তারা যত হুংকার ছাড়ুক, তাতে কাজ হবে না। বাংলাদেশে সাধারণত জনগণ সাহসী মানুষের পিছনে দাঁড়ায়। পালিয়ে থাকা নেতাদের থেকে দূরে থাকে। তারেক দুঃসময়ে সাহস না দেখিয়ে পালিয়েছেন। তাছাড়া দেশে কিংবা দেশের বাইরে যারা ক্ষমতার গিট্টু তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন, তাদের কাছে তারেক রহমানের ইমেজ খুব উজ্জ্বল নয়। উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে তারেকের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি এখনো অসত্য প্রমাণিত হয়নি।

রাজনৈতিক অবস্থানেও বিএনপির নীতিনিষ্ঠতা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় আছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে অংশ নিচ্ছে না। আবার স্বতন্ত্র পরিচয়ে অনেকে নির্বাচন করে জয়লাভও করছেন। বিএনপির কোনো কোনো নেতা স্বতন্ত্রভাবে ভোট করাতেও লাভ দেখছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক তৈমুর আলম খন্দকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি দলীয় প্রতীক নিয়ে না লড়লেও বিএনপির পরিচয়ে এবং বিএনপিকে পাশে নিয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে প্রচুর সম্ভাবনা দেখছেন। তৈমুর আলম খন্দকার বলেছেন, ‘দীর্ঘ ১৫ বছর নেতাকর্মীরা ভোট দিতে পারেননি। নাসিক নির্বাচনকে ঘিরে তারা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন, চাঙা হচ্ছেন। আমার বিশ্বাস, জনগণ ভোটের মধ্য দিয়ে প্রতিশোধ নেবে’।

জনগণ কিসের প্রতিশোধ নেবে? ক্ষমতাসীনদের অপশাসনের, নাকি বিএনপির নীতিহীনতার রাজনীতির? বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন নয় – বিএনপির এই নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দলের যারা নির্বাচন করছেন, তারা কি আসলে দলের বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ নিচ্ছেন না? নাকি এ সব কিছুই নিয়মরক্ষার?

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।

এইচআর/জিকেএস