মতামত

রেমিট্যান্স যোদ্ধারা সম্মানটুকু যেন পায়

সম্প্রতি ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি ছবি দেখে মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত ট্রলি না থাকায় বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শ্রমিকরা তাদের বিশাল আকারের লাগেজ মাথায় বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল। দীর্ঘ বিমানযাত্রা শেষে দেশে ফিরে অত বড় লাগেজ মাথায় করে নেওয়া একটা মানুষের যতটা কষ্টের, একটি দেশের মূল বিমানবন্দরে ট্রলির সংকট তারচেয়ে বেশি লজ্জার।

Advertisement

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এজন্য রাতের ৮ ঘণ্টা ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ আছে। ২৪ ঘণ্টার কাজ ১৬ ঘণ্টায় করতে হচ্ছে বলে বিমানবন্দরে প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জট লেগে গেছে ফ্লাইট সিডিউলে। প্রায় নিয়মিতই ফ্লাইটে দেরি হচ্ছে। লাগেজ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তাতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে দেশের বাইরে যাওয়া বা বাইরে থেকে আসা মানুষদের। ৮ ঘণ্টা ফ্লাইট বন্ধ থাকায় ভোগান্তি বেড়েছে, তাই তা সবার নজরে এসেছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভোগান্তির চিত্র নিত্যদিনের। তবে সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ আর শ্রমিকদের দুর্ভোগে আকাশ পাতাল ফারাক। বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে আসা-যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে, বিমানে বাংলাদেশের শ্রমিকদের সাথে যে অমানবিক আচরণ করতে দেখেছি; তাতে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যেসব শ্রমিক যান, তাদের অধিকাংশই গ্রামের, তাদের শিক্ষা-দীক্ষাও তত নেই। বিমানবন্দরে বোর্ডিং থেকে ইমিগ্রেশন- পদে পদে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়।

অনেকে বিভিন্ন ফরম ঠিকমতো পূরণ করতে পারেন না। তাদের সহায়তার জন্যও কেউ থাকে না। সহায়তা তো দূরের কথা, উল্টো তাদের নিয়ে হাসাহাসি করা হয়। সত্যি কথা বলতে, তাদের সাথে কুকুর-বেড়ালের মতো আচরণ করা হয়। প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। যেন সবাই অপরাধী, চুরি করে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। সত্যি সত্যি চুরি করে বা টাকা পাচার করে যারা দেশ ছাড়ে; বিমানবন্দরে তারা ভিআইপি মর্যাদা পায়। যতবার দেশের বাইরে গেছি বা ফিরেছি; ততবারই আমি আগ বাড়িয়ে অনেক শ্রমিককে সহায়তা করেছি। কিন্তু আমার একার একবেলার সহায়তায় তো তাদের চিরদিনের সমস্যার সমাধান হবে না। প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানি বন্ধে বিমানবন্দরে আন্তরিক কর্মীদের সমন্বয়ে স্থায়ী ডেস্ক স্থাপন করতে হবে।

গার্মেন্টসের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তি রেমিট্যান্স। কোটির বেশি প্রবাসী শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠায়। সে অর্থে আমাদের বৈদেশিক মূদ্রার মজুত বাড়ে; আমরা ভিআইপি, সিআইপি হই। কিন্তু সেই শ্রমিকদের মর্যাদা দেই না। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলোর একটি। ৫৫ হাজার বর্গমাইলে ১৮ কোটি মানুষের বাস। জনসংখ্যার এই আধিক্য আমাদের মানুষকে বাহিরমুখী করেছে। দেশে কাজ না পেয়ে তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে কাজের সন্ধান করেছে।

Advertisement

বাংলাদেশের মানুষের সস্তা শ্রমই বিভিন্ন দেশকে উৎসাহিত করেছে শ্রমিক নিতে। বাংলাদেশের মূল শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। অল্পকিছু ভাগ্যবান ইউরোপ-আমেরিকার সোনার হরিণের দেখা পায়। মালয়েশিয়ার বিশাল বাজার বন্ধ ছিল তিন বছর। গতকাল নতুন করে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাতে আশার আলো বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশের শ্রমিকরা কিছু দালালের দাবার ঘুঁটি। বাংলাদেশের মানুষ ভাগ্য বদলানোর আশায় বিদেশে যেতে চায়। আশির দশকে আমজাদ হোসেনের ঈদের নাটক জব্বর আলীর জনপ্রিয় সংলাপ ছিল ‘দুবাই যামু, ট্যাকা দাও।’ এই টাকা জোগাড় করতে গিয়ে অনেকে জমিজমা বিক্রি করে। তাতে সবারই ভাগ্য বদলায়। যারা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যেতে পারে, তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরে ইতিবাচক দিকে। আর প্রতারিতরা পথের ফকির হয়ে যায়।

শ্রমিক রপ্তানির এই খাতটি শুরু থেকেই দালালদের খপ্পরে। শ্রমিকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে বিদেশে না পাঠানো, এক দেশের কথা বলে আরেক দেশে পাঠানো, এক চাকরির কথা বলে আরেক চাকরিতে ঠেলে দেয়া- এসন অসংখ্য অভিযোগ। মানবপাচার, নারীদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করার মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে অহরহ। বিশেষ করে সৌদি আরব যাওয়া নারীদের দুঃসহ যন্ত্রণার কথা আমরা প্রায়ই শুনি। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খোলার কথা হচ্ছে। কিন্তু সেটি ধরে রাখা সহজ নয়। রিক্রুটিং এজেন্টদের দৌরাত্ম্যের কারণে ২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এবার যাতে তার পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটা নজর রাখতে হবে।

বাংলাদেশের অভিবাসন ব্যয় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। কারণ আদম ব্যবসা বাংলাদেশের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। আদম ব্যবসা করে এক প্রজন্মে অনেক মানুষ ফুলে ফেপে উঠেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য খুব একটা বদলায়নি। করোনার সময় আমরা দেখেছি দেশে এসে আটকেপড়া শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশা, আহাজারি। করোনার কারণে তারা ফিরে যেতে পারছিল না। সময় মতো যেতে না পারলে ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে বা চাকরি চলে যাবে; এ শঙ্কায় তারা করোনার ভয়কে ঠেলে রাস্তায় নেমেছিল।

সৌদি এয়ারলাইন্সের অফিস রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ে। সেখানে ঢোকার সাহস নেই এসব শ্রমিকের। তাই তারা দিনের পর দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে বসে থেকেছে সোনারগাঁওয়ের ফুটপাতে। পয়সা দিয়ে বিমান টিকিট কিনতে এত হেনস্থা বিশ্বের আর কোনো দেশে নিশ্চয়ই নেই। শুধু টিকিট কেনায়ই নয়; প্রবাসীদের করোনা টেস্ট, টিকা দেয়া নিয়েও কম হয়রানি পোহাতে হয়নি। পদে পদে তাদের এত হয়রানি, যেন তারা মানুষ নয়। এখন আবার হুট করে মধ্যপ্রাচ্যের বিমান ভাড়া তিনগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। উপমহাদেশের অন্য দেশের ভাড়া আগের মতোই আছে। শুধু বেড়েছে বাংলাদেশের ভাড়া। কেন? এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে? এ অন্যায়ের প্রতিকার করবে কে?

Advertisement

প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালিত হয়েছে। এবারের স্লোগান ছিল, ‘অভিবাসনে আনবো-মর্যাদা ও নৈতিকতা’। স্লোগানটি চমৎকার। কিন্তু বাংলাদেশের আদম ব্যবসাটা গড়েই উঠেছে অনৈতিকতা আর প্রতারণার ওপর। কত শত মানুষ যে প্রতারিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। খরচ হয় দেড় লাখ, মানুষের কাছ থেকে আদায় করে পাঁচ লাখ টাকা। পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আগের মতো গলাকাটা পাসপোর্টের সিস্টেম এখন নেই। তবুই ইউরোপে যাওয়ার লোভে কোনো সাগরের মাঝখানে ভাসতে থাকা বাংলাদেশীদের কথা শুনি প্রায়শই। এখনও বিশ্বের অনেক দেশে অবৈধ বাংলাদেশীরা দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়ায়, পেটেভাতে কাজ করে।

অভিবাসনে নৈতিকতা আর সততা সবার আগে জরুরি। তবে বাংলাদেশের মানুষ যদি কিছুটা দক্ষতা নিয়ে বিদেশে যেতে পারতো, তাহলে তাদেরও লাভ হতো, দেশেরও সুনাম হতো। একদম গ্রামের অশিক্ষিত মানুষটি যখন শুধু গায়ের শক্তির ওপর ভর করে পাড়ি জমায় কোনো মরুভূমিতে, তখন তার জীবনটা আর জীবন থাকে না। সর্বস্ব বিক্রি করে যারো গেছে, তারা যত কষ্টই হোক ফিরতে চায় না। আর মর্যাদার কথা যেটা স্লোগানে বলা হচ্ছে, এটা শুনতে যত মধুর লাগে, বাস্তব পরিস্থিতি ততটাই তেতো। নিজেরা গায়ে খেটে তারা কিছুটা টাকা-পয়সা কামায় বটে, তবে মর্যাদাটা পায় না কোথাও।

আমরা তাদের গালভরা নাম দিয়েছি রেমিট্যান্সযোদ্ধা। কিন্তু মর্যাদা দেইনি একদমই। অভিবাসন দিবসের স্লোগান বলে নয়, দাবি করছি রেমিট্যান্সে যোদ্ধাদের বিমানবন্দরে, বিমানে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হোক। আর অভিবাসী দিবসের পরদিনই কুয়ালালামপুর বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া সরকারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে যে স্বস্তি এসেছে শ্রমবাজারে, তা যেন কোনো দালাল বা সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে হারিয়ে না যায়।

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম/ফারুক