বিশেষ প্রতিবেদন

শৃঙ্খলা ফেরেনি বাসে, ভাড়া নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলছেই

রাজধানীর মহাখালী থেকে গুলিস্তান যেতে প্রভাতী বনশ্রী পরিবহনের বাসে ওঠেন রফিকুল নামে এক যাত্রী। কিছুক্ষণ পর কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতেই ৫০ টাকার নোট দেন। ২৫ টাকা ভাড়া রেখে বাকিটা ফেরত দেন কন্ডাক্টর। ওই যাত্রী কন্ডাক্টরের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ভাড়া কত?’ কন্ডাক্টর বললেন, ‘২৫ টাকা’। যাত্রী রফিকুল বললেন, ‘তোমার চার্ট (ভাড়ার তালিকা) দেখি।’ দেখা গেলো চালকের পেছনে ডান পাশের জানালার কাচে তালিকা আঠা দিয়ে লাগানো থাকলেও তা ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। পরে ওই যাত্রী গুগল ম্যাপে মহাখালী থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব বের করে দেখেন ৯ কিলোমিটার। কিলোমিটারপ্রতি দুই টাকা ১৫ পয়সা হিসাব করে মোট ২০ টাকা ভাড়া দিলেন তিনি। এতে কন্ডাক্টর রেগে গিয়ে বলেন, ‘আপনাকে ভাড়াই দিতে হবে না...যান’। এ সময় ওই যাত্রীও রেগে গিয়ে বলেন, ‘বেশি কথা বলবা না, তোমাদের যন্ত্রণায় যাত্রীরা অতিষ্ঠ।’

Advertisement

ভাড়া পরিশোধ করার পর ওই যাত্রীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। রফিকুল নামের ওই যাত্রী কয়েক মাস হলো বনানীতে একটি কোম্পানিতে চাকরিতে ঢুকেছেন। তিনি বলেন, আমাদের হিসাব করা পয়সা। কিছুদিন আগেও স্টুডেন্ট ভাড়া দিয়েছি। নিতে চাইতো না, জোর করে দিতাম। এখন নিজে আয় করি, এজন্য হিসাবটাও ঠিকমতো বুঝি। তেলের দাম বাড়ার পর ভাড়া বাড়ানোর জন্য তারা (বাসমালিক ও শ্রমিকরা) যা নাটক করেছে, মানুষকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছে। এর পরেও আবার বাড়তি ভাড়া নেয় কীভাবে!

নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। পরে দেশব্যাপী ডাকা পরিবহন মালিক সমিতির ধর্মঘটের মুখে গণপরিবহনের ভাড়াও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে, গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া না রাখা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের অশোভন আচরণের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। হাফ ভাড়ার দাবিতে করা এ আন্দোলনে কয়েক জায়গায় সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া রাজধানীতে গণপরিবহনের চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে সড়কে পর পর একাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নতুন করে আবারও সরব হন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে। একদিকে ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে চাপ, অন্যদিকে সড়কে পরিবহন শ্রমিকদের নৈরাজ্য ও বেপরোয়া আচরণের কারণে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যেও পড়ে এর প্রভাব।

গত কয়েকদিন রাজধানীর মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, পল্টন, মগবাজার এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, যাত্রীরা ভাড়া দেওয়ার আগে তালিকা দেখতে চাইছেন। অনেকেই ভাড়ার তালিকা মোবাইলে সেভ করে রেখেছেন। অনেকেই আবার প্রতি কিলোমিটার ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসাব করে গুগল থেকে রাস্তার দূরত্ব দেখে ভাড়া দিচ্ছেন। তবে, বাস শ্রমিকদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় যেতে চান না বেশিরভাগ যাত্রীই। যারা ভাড়া নিয়ে কথা বলেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বয়সে তরুণ।

Advertisement

বনানী থেকে বলাকা পরিবহনের একটি বাসে চড়েছেন দীপংকর চৌধুরী। বাস তেজগাঁও যেতেই কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চাইলেন। ভাড়া চাইতেই তিনি বললেন, ‘একটু পরে নাও’। তাৎক্ষণিক তিনি ফেসবুকে ঢুকলেন। ফেসবুকে আপলোড করা রাজধানীর প্রতিটি রুটের ভাড়ার তালিকা বের করলেন তিনি। সঙ্গে থাকা পাশের জনকে বললেন, ‘একটা পেজ গাড়ি ভাড়ার সব তালিকা আপলোড দিয়েছে। আমি শেয়ার দিয়ে রাখছি। গাড়িতে চড়লে কাজে লাগে।’ পরে কন্ডাক্টর আসতেই দুজনের ৫০ টাকা ভাড়া দিলেন তিনি। যাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেও কিছু বললেন না কন্ডাক্টর। পরে পাশের জনকে ওই যাত্রী বললেন, ‘একদম কাঁটায় কাঁটায় ভাড়া দিছি তো... এজন্য কিছু বলতেও পারছে না। আবার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখেও।’

পরে ওই যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জাগো নিউজ। তিনি বলেন, আগেও গণপরিবহনে ভাড়া বেশি নিতো। কিছু না বলেই সে ভাড়া দিতাম। কিন্তু তেলের দাম বাড়তেই যাত্রীদের জিম্মি করে তারা যে আচরণ করলো! এখন আমরাও সোজা। হিসাব করেই ভাড়া দেই।

ভাড়া নিয়ে আলোচনা করতে করতে এক ব্যক্তি বলেন, আরে ভাই...আপনি পাঁচ টাকা ভাড়া বেশি দিতে আপত্তি জানাবেন, দেখবেন আরও পাঁচজন কন্ডাক্টরের পক্ষ নিয়ে পাল্টা আপনাকেই কথা শোনাবে। এসব মানুষের জন্যই তো বাকিদের সমস্যা হয়। এরা নিজেরাও কথা বলে না, অন্যকেও বলতে দেবে না। অথচ বাসমালিকরা যে ভাড়া বাড়ানোর জন্য বাস বন্ধ রেখে জনগণকে কষ্ট দিলো, তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে, আমি এখন খুব হিসাব করি। রাস্তা মেপে ভাড়া দেই।

গত বৃহস্পতিবার বাড্ডা লিংক রোড থেকে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের বাসে ওঠেন এক যাত্রী। কিছুক্ষণ পর কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলে ভাংতি না থাকায় ১০০ টাকার নোট দেন তিনি। কন্ডাক্টর ২৫ টাকা রাখায় ‘কতো রাখলা’ বলে ওঠেন তিনি। এসময় কন্ডাক্টর বলেন, ‘যা ভাড়া তাই রাখছি। আগে ২০ টাকা ছিল, এখন বাড়ছে।’ পরে ওই যাত্রী ভাড়ার তালিকা (চার্ট) দেখতে চাইলে কন্ডাক্টর বলেন, ‘চার্ট বাদ দেন, আমি কি বেশি রাখছি নাকি’। পরে গুগল ম্যাপ থেকে বের করেন বাড্ডা থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। এরপর তিনি ২০ টাকা রেখে ৮০ টাকা ফেরত দিতে বললে কন্ডাক্টর বলেন, ‘আগের ভাড়াই তো ২০ টাকা ছিল।’ তখন ওই ব্যক্তি রেগে গিয়ে বলেন, ‘আগে তো বেশিই রাখতা, কয়দিন আগে নিজেরাই বাড়াইলা, কিলোমিটার মেপে তোমাদের হিসাবেই ভাড়া দিছি।’

Advertisement

ভাড়া নিয়ে খলিলুর রহমান নামে ওই যাত্রীর সঙ্গে আলাপ করলে তিনি বলেন, কিছু না বলতে বলতে ওদের সাহস বেড়ে গেছে। আচরণও খারাপ করে, আবার ভাড়াও বেশি রাখে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের বেপরোয়া আচরণ আগেও ছিল, এখনো আছে। মাঝে মধ্যে কিছু বড় ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিষয়গুলো সামনে আসে। বিগত কিছুদিন ধরে সড়কের বেশকিছু অরাজকতা সামনে এসেছে। এতে এত আলোচনা-সমালোনা হলেও পরিবহন শ্রমিকদের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তারা আগের মতোই বেপরোয়া রয়ে গেছেন।

যাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সচেতন যাত্রীরা সব সময়ই ছিল। তবে এর সংখ্যা খুবই কম। শুধু দু-একজন প্রতিবাদ করলে আসলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। পরিবহনখাতের অরাজকতা রুখতে হলে বাসে যেসব যাত্রীরা চড়েন, প্রত্যেককেই সচেতন হতে হবে। অতিরিক্ত ভাড়া চাইলে সব যাত্রীকেই একসঙ্গে প্রতিবাদ করতে হবে।

তবে, নির্ধারিত ভাড়া ও হাফ পাস কার্যকর হচ্ছে দাবি করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এ ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করতে নয়টি টিম গঠন করেছি। এরই মধ্যে আমাদের এই টিম মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করেছে। হাফ পাস শতভাগ কার্যকর করা হয়েছে।

তবে ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ১৫ পয়সা কার্যকর হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৯০ শতাংশ বাসেই নির্ধারিত চার্ট (ভাড়ার তালিকা) অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম হচ্ছে, তা ১০ শতাংশের বেশি নয়।

যেসব বাসে অতিরিক্ত ভাড়া রাখা হয়, তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন জানতে চাইলে খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, আমাদের টিম মাঠে আছে। আমরা মাঠে থাকবো। যেসব বাস অনিয়ম করছে, সেসব বাসমালিককে ডেকে আমরা সতর্ক করছি।

এমআইএস/কেএসআর/এএ/জিকেএস