দেশজুড়ে

জমির জন্য ৮ বছর ধরে বড় ভাইকে শিকলবন্দি

বরিশালের আগৈলঝাড়ায় জমির জন্য জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে তোতা নামে এক ব্যক্তিকে আট বছর ধরে শিকলবন্দি রাখার অভিযোগ উঠেছে ছোট ভাইয়ের বিরুদ্ধে।

Advertisement

বিষয়টি জানাজানি হলে রোববার (১৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় তোতার বাড়ি যান উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা।

জাহাঙ্গীর হোসেন উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রাংতা গ্রামের মৃত আলতাব হোসেনের বড় ছেলে। তার ছোট ভাই রাংতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মানিক মিয়া।

জাহাঙ্গীর হোসেনের কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় জাহাঙ্গীর হোসেন তোতা। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা তিতুমীর কলেজে পড়াশোনারত অবস্থায় মানসিক রোগে আক্রন্ত হন তিনি। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে বিয়ে করানো হয়। বিয়ের পর স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তান নষ্ট হলে আবারও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন জাহাঙ্গীর হোসেন। এ নিয়ে কলহ হলে ১০ বছর আগে তাকে ছেড়ে চলে যান স্ত্রী। এ ঘটনার দুই বছর পর থেকে পরিত্যক্ত একটি ঘরে শিকল দিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে জাহাঙ্গীর হোসেনকে।

Advertisement

প্রতিবেশী হাবিব মল্লিক বলেন, কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে শনিবার খোঁজ নিতে জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ভাই মানিক মিয়া নিজে থাকার জন্য পাকা ভবন নির্মাণ করলেও বড় ভাই জাহাঙ্গীর হোসেনকে রাখা হয়েছে ধানের গোলার ঘরে। ছোট পরিত্যক্ত ঘরে লোহার শিকল পরিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে তালা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। খুঁটির সঙ্গে একটি এবং তার পায়ে ঝুলছে আরও একটি তালা। ওই ঘরে নেই কোনো বিদ্যুৎ। ঝুপড়ি ঘরে আলো-বাতাস নেই। এসময় জাহাঙ্গীর হোসেন পা জড়িয়ে ধরে বলেন, ভাই আমি পাগল না। আমাকে জমির জন্য শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। শিকলবন্দি জীবন থেকে মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবি জানান জাহাঙ্গীর হোসেন।

সাইফুল আকন নামে আরেক প্রতিবেশী বলেন, আমরা এতদিন জানতাম জাহাঙ্গীর হোসেন মারা গেছে। কারণ প্রায় ৮ বছর তাকে দেখা যায়নি। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখেলাম জাহাঙ্গীর হোসেন জীবিত। তবে তার করুণ অবস্থা। তাকে দেখে স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার জন্যই ছোট ভাই মানিক মিয়া জাহাঙ্গীর হোসেনকে মানসিক ভারসাম্যহীন সাজিয়ে শিকলবন্দি করে রেখেছেন।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জাহাঙ্গীর হোসেন মানসিক রোগে আক্রান্ত। তবে পাগল বলা যাবে না। তার আচার-আচরণ একজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই। উন্নত চিকিৎসা পেলে হয়তো জাহাঙ্গীর হোসেন পুরোপুরি সুস্থ হতেন। তবে ছোট ভাই মানিক মিয়া শুধু সম্পত্তির লোভে সুচিকিৎসা না করিয়ে তাকে পাগল হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করছেন।

শিকবন্দি জাহাঙ্গীর হোসেন অভিযোগ করে বলেন, আট বছর ধরে আমাকে শিকলে আটকে রাখা হয়েছে। ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না। বেশিরভাগ দিন আমার উপোস কাটে। আগে বাম পায়ে শিকল ছিল। সেখানে ক্ষত হওয়ায় ডান পায়ে শিকল দেওয়া হয়েছে। কয়েক বছর আগে জমির খতিয়ান রেকর্ডের নামে দলিলে ছোট ভাই মানিক আমার স্বাক্ষর নিয়েছে। শুধু সম্পত্তি নিজের নামে করতে ভাই আমাকে শিকলবন্দি করে রেখেছে। শিকলবন্দি জীবন থেকে মুক্তির দাবি জানান জাহাঙ্গীর হোসেন

Advertisement

জাহাঙ্গীর হোসেনের মা হাওয়া বেগম বলেন, তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে আগেই। তারা স্বামীর বাড়িতে থাকে। ছোট ছেলে মানিক মিয়ার কাছে আমার আশ্রয় হয়েছে। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন মানসিক রোগে আক্রন্ত। আট বছর আগে বাড়ির পাশের সেলিম মল্লিকের স্ত্রী মাকসুদা বেগমকে মারধর করার কারণে তোতাকে শিকল দিয়ে বন্দি করে রেখেছে মানিক। মানিক বলেছে তোতা ভাই পাগল হয়ে গেছে। তাই শিকল দিয়ে আটকে রেখেছে।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে জাহাঙ্গীর হোসেনের ছোট ভাই রাংতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মানিক মিয়া বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে মানসিক রোগে ভুগছেন বড় ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন। পাগলামির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে বড় ভাইয়ের স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। তার চিকিৎসা করতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছি। বড় ভাই অচেনা কাউকে দেখলে তেড়ে যান। মারধর করেন। এ কারণে তাকে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।

সম্পত্তি লিখে নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে মানিক মিয়া বলেন, সরকারিভাবে জমি জরিপের পর খতিয়ান রেকর্ডের জন্য বড় ভাইয়ের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল। জমি আত্মসাতের জন্য নয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবুল হাশেম জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি জানতে পেরে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সন্ধ্যা ৬টার দিকে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়িতে অবস্থান করছি। আমি জাহাঙ্গীর হোসেন ও তার প্রতিবেশী এবং জাহাঙ্গীর হোসেনের ছোট ভাই মানিক মিয়ার সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবো।

সাইফ আমীন/এসজে/জেআইএম