মতামত

কী বার্তা দিলেন রাবি উপাচার্য?

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই কারণেই জাতীয় উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতির বিবেক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সব সময় দেশ গড়ার কারিগর হিসেবে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবেন। কিন্তু কালের বিবর্তনে বঙ্গবন্ধুর সে ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। শিক্ষকরা কখনও কখনও নিজেদের অপকর্মের কারণে আবার কখনও কখনও দলীয় রাজনীতির আবর্তে নিজেদের অবস্থানকে নষ্ট করেছেন। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে কখনো কখনো রাষ্ট্র ব্যবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানহানির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তারপরেও অন্যান্য শিক্ষকতা পেশার মতই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা মহান পেশা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষতার পাশাপাশি গবেষণা করবেন এবং সেই গবেষণার মাধ্যমে কিভাবে দেশের উপকার করা যায় সেটি নিয়ে ভাববেন এটিই জাতি প্রত্যাশা করে।

Advertisement

২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। কখনও কখনও তৎকালীন প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সমালোচিত হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের মাঝামাঝির দিকে তৎকালীন উপাচার্য মহোদয়ের শেষ কর্ম দিবসে দেওয়া নিয়োগকে কেন্দ্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশ তথা গোটা পৃথিবীতে সমালোচিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় আইনে মাননীয় উপাচার্যকে যে পরিমাণ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাতে অনেক উপাচার্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ক্ষমতা একজন উপাচার্য কোন কাজে ব্যবহার করবেন এবং কেমন করে ব্যবহার করবেন? এই ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়কে পঠন-পাঠন এবং গবেষণার শীর্ষে নিয়ে যেতে পারেন, আবার ঠিক একই ভাবে সে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে সব দিক থেকেই সমালোচনার দিকে ঠেলে দিতে পারেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন, সেই স্বায়ত্তশাসন বর্তমানে বিভিন্ন ভাবে খারাপ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের জাতির বিবেক হিসেবে কল্পনা করেই স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে সেটি অনেকটাই নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচালনা করছেন তার উপর।

গত প্রায় চার মাস আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন। আরো দুই মাস আগে একজন নতুন উপ-উপাচার্যের নিয়োগ হয়েছে। নতুন উপাচার্য মহোদয়- প্রফেসর গোলাম সাব্বির সাত্তার- নিয়োগ প্রাপ্তির পর থেকে যে বার্তাটি প্রদান করার চেষ্টা করেছেন তা হল তিনি কোন দল বা গোষ্ঠীর উপাচার্য না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত সকলের উপাচার্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান। যদি তিনি এই দর্শন মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তাহলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আগামী চার বছরে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

Advertisement

বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব নেবার পরে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত "বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক" পদে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং রবীন্দ্র গবেষক প্রফেসর সনৎ কুমার সাহার নিয়োগ। প্রফেসর সনৎ সাহা বাংলাদেশ তথা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন শিক্ষক, গবেষক ও লেখক। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপকভাবে পরিচিত। এই নির্মোহ শিক্ষককে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেবার জন্য মাননীয় উপাচার্য অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।

প্রফেসর সনৎ কুমার সাহা ১৯৫৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে সম্মান ডিগ্রি এবং ১৯৬১ সালের মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৬২ সালের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা জীবনে তিনি যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং স্কলার এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। তিনি কয়েক বছর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি নিজস্ব একাডেমিক ডিসিপ্লিন এর বাইরে সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি ও রবীন্দ্র সাহিত্য নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি কর্মজীবনে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। এই রকম একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক পদে পদায়নের মাধ্যমে উপাচার্য মহোদয় যে বার্তাটি প্রদান করেছেন সেটি হচ্ছে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান তাঁর মেয়াদকালীন সময়ে।

প্রফেসর সনৎ কুমার সাহা ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছেন। তাঁর জ্ঞানের ব্যাপ্তি সকলকে অভিভূত করে। তিনি শুধুমাত্র জ্ঞান চর্চা করেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে "বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক" পদটি সৃষ্টি করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানোর জন্য। যদিও এই পদটি গত প্রশাসনের আমলে সৃষ্টি করা হয়েছিল তবে বিভিন্ন কারণে নিয়োগ হয় নি। বর্তমান উপাচার্য দায়িত্ব নিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই পদে প্রফেসর সনৎ কুমার সাহাকে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রক্রিত সম্মান দেখাতে পেরেছি বলে আমি বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক পদে এমন একজন ব্যক্তির নিয়োগ সকলের প্রত্যাশিত ছিল। আমরা জানি যে কোন সৃষ্টির শুরুতে যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া না যায় তাহলে সেই সৃষ্টির ভবিষ্যৎ খুব ভালো হয় না। আর এই প্রেক্ষিতেই এই মহান শিক্ষককে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের মাধ্যমে উপাচার্য মহোদয় অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ করেছেন। আর এই কারণেই মাননীয় উপাচার্য মহোদয়সহ, আই বি এস এর সকল শিক্ষক এবং বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক নিয়োগ বোর্ডের সকল সদস্যকে আমি অভিনন্দন জানাই।

বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক পদে নিয়োগের আগেও মাননীয় উপাচার্য আরও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যেগুলো প্রশংসিত হয়েছে। কিছুদিন আগে আমরা উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক স্যারকে হারিয়েছি। মৃত্যুর পরে তাঁর মৃতদেহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমাহিত করার তিনি যে সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন সেটিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার এবং জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তাঁর মতো একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাহিত করার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি সত্যিই এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। একই সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহনে প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন সংরক্ষণের মাধ্যমে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিবন্ধী বান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এটিও অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত একটি সিদ্ধান্ত। আর এই কারণে এই সিদ্ধান্তের সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদেরও আমি অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।

Advertisement

আগেই উল্লেখ করেছি একটি বিশ্ববিদ্যালয় কতটা সুনামের সাথে চলবে, দেশে ও আন্তর্জাতিক ভাবে কতটা সুনাম অর্জন করবে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সেই বিশ্ববিদ্যালয় কতটা অবদান রাখতে পারবে সেটি অনেকটাই নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে আসীন উপাচার্য মহোদয়ের মানসিকতার উপর। আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় হল জ্ঞানচর্চা স্থান। শুধু ছাত্র ভর্তি করা কিংবা ছাত্রদের ডিগ্রি দিয়ে বের করে দেওয়া এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ নয়। ছাত্র পড়ানোর সাথে সাথে জ্ঞানচর্চায় অবদান রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় কাজ। পঠন-পাঠন এবং গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়কে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়কে যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তাঁর যোগ্যতা এবং দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমান উপাচার্য মহোদয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের সময় এখনও আসেনি কারণ তিনি মাত্র চার মাস অতিবাহিত করেছেন। তবে তিনি এই চার মাসে তিনি যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সেই সিদ্ধান্তগুলো দেশবাসী এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার সংশ্লিষ্ট সকলের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে। তিনি যদি তাঁর এই অবস্থান ধরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিই বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চান তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলে তাঁকে সহায়তা করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

তাছাড়া নিকট অতীতে দেশে এবং দেশের বাইরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সম্মানহানি হয়েছে তা পুনুরুদ্ধার করার দায়িত্ব বর্তমান উপাচার্যের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার ৫০ বছরে নতুন উপাচার্য মহোদয়ের কাছে আমার প্রত্যাশা তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদের সম্মান বৃদ্ধি করবেন এবং সকল ক্ষেত্রে এমন একটি মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করবেন যাতে পরবর্তী উপাচার্যরা সেই মানদণ্ডের নিচে নামতে না পারেন।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/এমএস