বগুড়ার শিবগঞ্জ, রাজশাহীর বাগমারা কিংবা পুরোনো ঢাকার হোসেনী দালান। কোথাও কখনো ভিন্নমতের কে বা কারা, থাকলে খুনের নেশা জেগে উঠবে, এমন কোনো ভাবনা কারো মাথায় কখনো আসেনি। ২০১৫ তে আমাদের অতি শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে বিভাজনের বীজ রোপন করে গেল যারা এ দেশটি চায়নি ১৯৭১-এ। গেল বলাটা ভুল হবে, ওরা আছে, থাকবে, ওদের জন্য বড় বড় রাজনৈতিক দল আর ব্যক্তির সমর্থনও আছে, আন্তর্জাতিক সাহায্য সহযোগিতাও আছে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজনের একটি নাতিদীর্ঘ ইতিহাস আছে। ধর্মকে পুঁজি করে যারা রাজনীতি করে, তাদের পেশিশক্তিও কম নয়। এরা রগ কাটে, এরা খুন করে যেমন করে এরা করেছিল ১৯৭১-এ। তবে সাধারণ মানুষের মনে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির শংকা বা আকাঙ্খা কিছুই তৈরি করতে পারেনি এরা। ২০১৫-তে কিছুটা সফল হয়েছে বলেই মনে হয়। এই গোষ্ঠি গত বছরে যেমন লাগাতার দেশের নানা অঞ্চলে মুক্তমনা লেখকদের হত্যা করেছে, তেমনি এরা ভিন্ন ধর্মই কেবল নয়, ইসলাম ধর্মের ভেতরকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রুপগুলোকেও তাদের আক্রোশের লক্ষ্য করেছে। বাংলাদেশের বেঁচে থাকার প্রধান স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা আজ ভয়ংকর চাপে পড়েছে এই গোষ্ঠির তৎপরতায়। সরাসরি যদি বলি, তবে অবশ্যই বলতে হবে ঘটনাবহুল। কিন্তু এর ধরন কেমন ছিল। বছরের শুরু থেকে সরকারের উপর রাগ ঝারতে গিয়ে সাধারণ মানুষের উপর লাগাতার পেট্রোল বোমা ছুড়েছে একটি দলও জোটের অবরোধ কর্মসূচির সময়। টানা তিন মাস এই আগুন সন্ত্রাস চলেছে, যদিও অবরোধ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়নি। কত মায়ের কোলে আবুঝ শিশু পুড়ে নিস্তব্ধ হয়েছে, কত শিশুকে দেখতে হয়েছে বাবা কিংবা ভাইয়ের ঝলসে যাওয়া দেহ, কত শিশু, কত নারী, কত নিরীহ মানুষ এখনো বয়ে বেড়ান পোড়া ক্ষত, তার হিসেব জানা বড় কঠিন।আবার ৫ জানুয়ারি সমাগত। দশম সংসদের ২য় বার্ষিকী। একই সাথে ২য় মেয়াদের শেখ হাসিনার সরকারের দু’বছর পূর্তি। এই দু’বছরে বিগত বছরগুলোর মতো শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর উচ্ছ্বাসে উন্নযনের পথে চলেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে বেশ কিছু অগ্রগতি, বিশেষ করে অবকাঠামোগত খাতে কর্মযজ্ঞ মানুষের মনে স্বপ্নের বীজ বুনেছে যে আমরাও হতে পারি উন্নত দেশ। বিনিযোগে আবশ্য লম্বা স্থবিরতা সেই স্বপ্নের পথে অন্তরায় হয়ে আছে। খবর আসে নাইজেরিয়া থেকে বোকো হারাম কত স্কুল ছাত্রীকে অপহরণ করলো, সংবাদ তৈরি হয় প্যারিসে, সিরিয়াতে, এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রে, আইসিস কত মানুষকে নির্দয়ভাবে খুন করলো, কি ধরনের যৌনাচারের ফতোয়া দিল। এসবই দূরের খবর ছিল। এখন তা ঘরের খবরও। আইসিস আছে বা নেই, তাতে কি? অতিথি পরায়ণ বাংলাদেশে নিরপরাধ বিদেশিকে খুন করে সাথে সাথেই বিবৃতি। মসজিদে হামলা, ধর্মযাজকদের গলা কাটার চেষ্টা আর হুমকি। বছর জুড়ে বিশ্ব যেমন মুক্ত ছিলনা, বাংলাদেশও ছিলনা। অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ছিল এখানে সেখানে। আতংকিত মানুষ এখন উন্নত দেশে, আমাদের দেশেও। এই আতংক সমাজে পরাজিত হয় যদি রাজনীতি তার সঙ্গী না হয়। পাশ্চাত্যে সব শক্তি একাট্টা অন্ধকারের শক্তিকে পরাভূত করতে। কিন্তু আমার দেশে মৌলিক জায়গায় গোলযোগ। ধর্মের নামে খুনের কারবারিরা যা চায়, তা তাদের হাতে তুলে দিতে তাই মহান শুক্তিযুদ্বে শহিদের সংখ্যা নিয়ে আচমকাই বিতর্ক তুলে দেয়া হয়, কিংবা অশ্লীলভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কটাক্ষ করা হয়। এসবই মসজিদে হামলাকারী, লেখক হত্যাকারীদের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন। নির্বাচন বর্জন করে রাজনীতির মাঠে এতিম হয়ে যাওয়া শক্তি নিজেদের ভুল বিশ্লেষণ করে না। ভুল শুধরে না নিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়, আগুণ দিয়ে মারে আর খুনের কারবারিদের উস্কে দেয়। নতুন বছরে তাই নতুন রাজনীতি চাই। তিন মাসের অবরোধে বাংলাদেশ এক দগ্ধ জনপদে পরিণত হয়েছিল যার ক্ষত কোনোদিনই হয়তো শুকাবেনা। আগুনে জ্বলেছে শহর, বন্দর আর গ্রাম। দগ্ধ মানুষের চিৎকার শোনার নারকীয় উল্লাসে যারা মেতেছিল তারা রাজনৈতিক কর্মী ছিল। আর টেলিভিশনের পর্দায় যারা এই উল্লাসের পক্ষে সাফাই গেয়েছিল তারা তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিক সমাজ। দিন-রাতকে বিভীষিকাময় করে রাখার এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি পুরো বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল বার্ন ইউনিটে। পেট্রোল বোমায় প্রাণ হারায় ১শ ২২ জন মানুষ, কিন্তু অন্তর জ্বলেছে তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি মানুষের। তবে জ্বলেনি, কোনো দুঃখবোধ হয়নি তাদের যারা এমন কর্মসূচির আদেশ দিয়েছিল। পেট্রোল বোমা নামের আতংকের সাথে ছিল লেখক-বুদ্ধিজীবী বা সৃজনশীল মানুষ খুন। এ ছিল আরেক আতঙ্ক। এই আতঙ্কের নাম মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদ। দিনের বেলা প্রকাশ্য হত্যা করা হয়েছে ব্লগারকে। কেবল ব্লগার বা লেখকদের হত্যা করেই তারা থেমে থাকেনি, এমনকি প্রকাশকরাও নিরাপদ ছিলেন না। গত বছরটির ডায়েরির অনেক পাতায়ই রক্তের দাগ। প্রতি পরতে পরতে শংকার ছায়া। কান পাতলেই শুনতে পাবো অসংখ্য মানুষের আর্তনাদ ও চিৎকার। নতুন বছরে এই আর্তনাদ আর চিৎকার শুনতে চাইনা। চাইনা প্রিয় মানুষকে কোনো কারণ ছাড়াই হারিয়ে পরিবারগুলোর দীর্ঘশ্বাস। আতঙ্ক, উদ্বেগ ও শংকা কাটিয়ে নতুন বছরটি হয়ে উঠুক চির চেনা হাসি গানের বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষকে জ্বালিয়ে দেয়ার রাজনীতি সফল হয় না কোনোদিনই। এইচআর/এমএস
Advertisement