১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তৎকালীন পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান এই দুইটি ভাগে পাকিস্তান বিভক্ত হলেও দেশ শাসনের দায়িত্ব ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উপর। ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকেই ভারতে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর চরম দৌরাত্ম্য ছিল। আর এই কারণেই পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। পাকিস্তানে সেনা শাসকরা সব সময়ই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপরে শোষণ করতো।
Advertisement
অর্থনীতি-ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব-পাকিস্তান পিছিয়ে ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের ট্যাক্সের টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার পরিচালিত হলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে তারা কোনো কাজ করতো না। আর এই বঞ্চনার বিষয়টি বঙ্গবন্ধু তাঁর যৌবন কাল থেকে লক্ষ্য করেছিলেন। আর তাই ১৯৫০ সাল পরবর্তী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল সেটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং শোষণের বিরুদ্ধে যে মানুষটি শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে অস্বীকার করার উপায় নেই যে বঙ্গবন্ধুর যে সময় উদীয়মান নেতা, ঠিক সেই সময়ই হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল কাশেম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বঞ্চনা বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। এর মধ্যে কেউ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়টি ভাবা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই ভাবনাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সক্ষম হননি।
তবে বঙ্গবন্ধু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে বাঁচাতে হলে দেশকে স্বাধীন করতে হবে। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই তিনি ১৯৬০ পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। তিনি প্রথমে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেন এবং জনগণকে এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য প্রস্তুত করেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফার মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা প্রেরণ করে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানে সেনা সরকারের চিন্তার কারণ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জনগণ যেভাবে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তা সত্যিই বিস্ময়কর। আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয় পশ্চিম পাকিস্তানিদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
Advertisement
পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হয়েও পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা শাসিত সরকার যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে তালবাহানা শুরু করে ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ কূটনৈতিক ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ডাক দেন নি খুব যৌক্তিক কারণেই কারণ পাকিস্তানের সরকার চেষ্টা করছিল বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে তকমা লাগিয়ে সাজা দেওয়ার মাধ্যমে বাংলার উত্তাল জনগণকে আন্দোলন থেকে পিছপা হতে বাধ্য করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানী সরকারের সেই পরিকল্পনাটি বঙ্গবন্ধু খুব ভালোভাবে বুঝেছিলেন বিধায় ৭ মার্চের ভাষণে তিনি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই ভাষণে এমন কোন বিষয় ছিল না যেটা অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে একজন নেতার পক্ষে একটি অলিখিত বক্তব্যের মাধ্যমে এরকম ভাবে স্বাধীনতার একটি দৃশ্যপট রচনা করা সম্ভব। পরবর্তীতে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুমিয়ে থাকা নিরীহ জনগণকে বুলেটের মাধ্যমে হত্যা করা হলে ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন পাকিস্তানি সরকার তাঁকে কারাগারে আটক করেলেও সেদিন থেকেই বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এক দিকে যেমন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং বঙ্গবন্ধু ঘনিষ্ঠরা মুজিবনগর সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করবার চেষ্টা করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে জীবনবাজি রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। একথা না বললেই নয় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে ভূমিকা রেখেছিলেন সেটি বাঙালি জাতি চিরদিন মনে রাখবে।
তিনি শুধু এক কোটি শরণার্থীকে ভারতে আশ্রয়ই দিয়েছিলেন না, তিনি সামরিক সহায়তাসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে অর্জন করতে দেওয়া হয় নি। ঘাতকদের বুলেটের নির্মম আঘাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
Advertisement
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর সরকার বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট পরিবর্তন করার মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল ভিত্তিকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছিল। তারা চেষ্টা করেছিল পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশকে গড়ে তুলবার। পরবর্তীতে গণ আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে সামরিক সরকারের বিদায়ের পরে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলে যে সরকার ক্ষমতায় আসে সেই সরকার পূর্ববর্তী সরকারের ধারাবাহিকতায় দেশ পরিচালনা করেছে বিধায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জন বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে উন্নয়নের চাকাকে সচল করার চেষ্টা করে বেশ সফল হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হওয়ার ফলে পুনরায় সে পথ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০০৭-২০০৮ সালের ব্যতিক্রমী সরকার ব্যবস্থার পরে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃতে আওয়ামী লীগ জনগণের পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দিন বদলের সনদ নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছে। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকার ফলে সরকারের ধারাবাহিকতা বর্তমান সরকারকে দেশের উন্নয়নকে তরান্বিত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন এবং নিরলস প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।
এছাড়াও উন্নয়নশীল দেশের তালিকা অন্তর্ভুক্তির জন্য বাংলাদেশ সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রোল মডেল হয়েছে আমাদের দেশ। ঘরে বসে নাগরিকরা বিভিন্ন ধরনের সেবা পাচ্ছেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে। মাথাপিছু আয় ২৪০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং ২০২১ সালের অক্টোবরের হিসেব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬৪৫৯.৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার। দেশে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল, এবং ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্পের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আজ থেকে ১২ বছর আগেও এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন সবার কাছে একটি স্বপ্নের বিষয় ছিল। দারিদ্রতার হার কমে গেছে এবং শিক্ষার হার বেড়েছে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এমনকি করোনাকালে যখন পৃথিবীর বিভিন্ন ধনী রাষ্ট্র অর্থনীতি এবং স্বার্থ খাতের বিপর্যয় সামলাতে ব্যস্ত রয়েছে, ঠিক সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশে বেশ ভালোভাবেই করোনা অতিমারির প্রথম দুই ঢেউ সামাল দিয়েছে। কোভিড-১৯ অতিমারিকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য খাতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে যখন লকডাউন কার্যকর করা হয়েছিল, সেই সময় সরকার সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে সাহায্য প্রদান করার। আর এই কারণেই বাংলাদেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় অতিমারির ভয়াবহতা তেমনটি পরিলক্ষিত হয়নি। সরকার ইতিমধ্যেই প্রায় ১০ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে যার মধ্যে ৫ কোটির বেশি মানুষ টিকার দুই ডোজ গ্রহণ করেছে যা পৃথিবীর বুকে অনেক রাষ্ট্রের তুলনায় একটি দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের এই ব্যাপক অর্জন এমনিতেই সম্ভব হয় নি। এর পেছনে রয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিরলস প্রচেষ্টা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর পিতার স্বপ্নকে হৃদয়ে লালন করে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য। গত ১২ বছরে তিনি তাঁর লক্ষ্য পূরণের দিকে এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশে যে প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে, উন্নয়নের এই গতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে।
ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ এশিয়ান টাইগার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। একই সাথে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দেখা হয়। জাতির পিতার হাত দিয়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতা এবং কন্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের এই উন্নয়ন সত্যিই এক যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ যা অর্জন করেছে, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো এই অর্জন অনেক আগেই সম্পন্ন হতো। তার পরেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দূরদর্শিতার কারণে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের এই অর্জন দেখে সবাই অবাক হয়েছে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/জেআইএম