বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে একটানা ৩ দিনের সরকারি ছুটিতে অনেকেই রাঙামাটিতে ভিড় করছেন। টানা ছুটির কারণে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যাচ্ছেন প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান রাঙামাটিতে।
Advertisement
লাল মাটি, হ্রদ, পাহাড় ও ঝরনার অপরূপ দৃশ্য দেখতে এখনই রাঙামাটি ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। প্রাণভরে দেখতে চাইলে ঘুরতে যেতে হবে শহর এর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে। রাঙামাটির যেসব পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বাড়ে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের ভিড়-
পলওয়েল পার্ক
রাঙামাটির বর্তমানে পর্যটকদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানের নাম পলওয়েল পার্ক। মাত্র ৩০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে আপনি পাহাড় থেকে দেখতে পারবেন বিস্তৃত হ্রদের সৌন্দর্য ও পার্কের নানান স্থাপত্য সৌন্দর্য। একইসঙ্গে আছে ঝুলন্ত সেতু। সেটি পার হয়ে দেশের প্রথম লাভ পয়েন্টে।
Advertisement
আর এখানে কেন লাভ পয়েন্ট তৈরি করা হয়েছে সেই লিমন-রিমা দম্পতির বেদনামূলক কাহিনীও জানতে পারবেন এই স্থান পরিদর্শন করলে। ভালবাসা বন্ধনকে চিরস্থায়ী করতে অনেক যুগল দম্পতি লাভ লক পয়েন্টে ভালবাসার তালা ঝুলিয়ে তালার চাবি কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফেলে দেয়।
জেলা পুলিশের পরিচালনায় এই পার্কের পাশে রয়েছে কটেজ এবং সুইমিং পুল। শহরের ডিসি বাংলো এলাকার পাশেই পলওয়েল পার্ক।
ঝুলন্ত সেতু
রাঙামাটি এসেছেন অথচ ঝুলন্ত সেতু ঘুরতে যাবেন না, এমনটা তো কখনো হবে না। কাপ্তাই হ্রদের দুই পাহাড়কে ৩৩৫ ফুটের একটি ঝুলন্ত সেতু কীভাবে মেলবন্ধন করেছে, তা দেখতে চাইলে স্থানটি ভ্রমণ করুন।
Advertisement
এই শহরের একপাশে ঝুলন্ত সেতু। শহরের যে কোনো জায়গা থেকে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে ঝুলন্ত সেতুতে যাওয়া যায়।
সুবলং
ঝুলন্ত সেতু থেকে সুবলং যেতে পারবেন নৌকায় চড়ে। সুবলঙে যেতে যেতে হ্রদ ও পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে আপনি মোহিত হয়ে পড়বেন। দু’দিকে পাহাড় আর কাপ্তাই হ্রদ হয়ে সুবলং ছুটে চলা একই সঙ্গে হ্রদের জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্যও এই যাত্রাপথে ধরা পড়বে।
সুবলঙে যাত্রাপথে আছে প্রচুর পাহাড়ি ঝরনা। তবে তার মধ্যে বিখ্যাত বড় ও ছোট ঝরনা। রাঙামাটি শহর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে ঘণ্টাখানেকের পথ সুবলং। এই পথে যেতে যেতে বিভিন্ন পাহাড়ি দ্বীপে আছে ছোট ছোট পর্যটন স্পট। যেখানে গিয়ে পরিবার নিয়ে পাহাড়ের ঐহিত্যবাহী খাওয়া-দাওয়াও সারতে পারবেন।
সাজেক
সাজেক রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে অবস্থিত। পাহাড় চূড়ায় অবস্থিত এ পর্যটন কেন্দ্রটি এরই মধ্যে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছে। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক সাজেকে বেড়াতে আসে। সাজেক থেকে ভারত দেখা যায়। ভোরে মেঘের সঙ্গে খেলা করা যায়।
সূর্য উদয়ের আগে মেঘগুলো যেন পর্যটকদের আলিঙ্গন করে চলে যায়। সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা হয়ে সাজেকে যায় পর্যটকরা। এরই মধ্যে সাজেকে বাণিজ্যিকভাবে শতাধিক রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। ছুটির দিনগুলোতে এসব রিসোর্টের কোনটিই খালি থাকে না।
আরণ্যক
রাঙামাটি শহরে সেনাবাহিনীর পরিচালনায় পর্যটকদের বিনোদন দেওয়ার লক্ষ্যে খুলে দেয়া হয় আরণ্যক পার্ক। পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি এই পার্কে গেলে হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আরণ্যক থেকে স্বল্প দূরত্বে আরেকটি পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ওয়াটার ল্যান্ড। যেখানে আছে সুইমিংপুল ও খেলার সামগ্রী।
চাকমা রাজবাড়ি
তিন সার্কেলের মধ্যে রাঙামাটি অঞ্চলটি আছে চাকমা সার্কেলে অধীনে। কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর পুরোনো রাঙামাটির সঙ্গে ডুবে যায় পুরোনো রাজবাড়িও। ১৯৬০ সালে পুরোনো রাজবাড়ি ছেড়ে শহরের মধ্যখানে বর্তমান স্থানে চাকমা রাজবাড়ি গড়ে তোলা হয়। শহরের রাজবাড়ি এলাকা থেকে নৌকা দিয়ে পেরিয়ে চাকমা রাজবাড়ি যেতে হয়। যেখানে গেলে চাকমা ঐতিহ্য চোখে পড়বে।
মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতিসৌধ
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ ১৯৭১ সালে ২০ এপ্রিল হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন রাঙামাটির নানিয়াচর বুড়িঘাটের চেঙ্গী নদীর পাড়ের একটি টিলায়। তিনি যে টিলায় শহীদ হন সেখানে আছে তার কবর। নির্মাণ করা হয়েছে ‘সীমান্ত শিখা’ নামে স্মৃতিস্তম্ভ।
রাঙামাটি শহরের বনরূপা, গর্জনতলী থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে সময় লাগে ১ ঘণ্টার একটু বেশি। একটি নৌকার ভাড়া পড়বে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। স্পীড বোটে সময় লাগবে ২০-২৫ মিনিট। ভাড়া তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা। যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। এটি পরিদর্শনে টিকিটের প্রয়োজন হয় না।
আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়ক
রাঙামাটিতে বেড়াতে আসলে আসামবস্তি-কাপ্তাই সড়কে ঘুরতে না গেলে রাঙামাটির আসল সৌন্দর্যটাই মিস করবেন। কাপ্তাই হ্রদ থেকে কয়েকশ ফুট উঁচু পাহাড়ের ঢাল দিয়ে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা সড়ক দিয়ে কাপ্তাই চলে যাওয়া যায়। ১৯ কিলোমিটারের এই সড়কটি পুরোটাই মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেছে।
কখনো একপাশে পাহাড় অন্যপাশে দিগন্তবিস্তৃত কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য আবার কখনো কখনো দুই পাশের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা সড়ক পর্যটকদের মুগ্ধ করে। এই সড়ক ধরে গড়ে উঠেছে বড়গাঙ, বেরান্নে লেক শো, বার্গি বেশকিছু পাহাড়ি ক্যাফে ও রিসোর্ট।
ফুরোমোন
ফুরোমোনকে বলা হয় জেলার দ্বিতীয় সাজেক। সাজেককে যেমন মেঘের রাজ্য বলা হয় তেমনি ফুরোমোনে উঠলে দেখতে পারবেন মেঘের রাজ্য আর সকালে মেঘ সরিয়ে সূর্য আলো পড়তেই দেখা যায় রাঙামাটি শহর।
যেন মনে হবে ড্রোন দিয়ে দেখা শহর। ফুরোমোনে যেতে হলে শহর থেকে অটোরিকশায় ৩০ মিনিট পথ পেরিয়ে সাপছড়ি এলাকা হয়ে উঠতে হবে। ফুরোমোন চ‚ড়ায় উঠতে দুইঘণ্টা সময় লাগে।
আসামবস্তি ও পুরানপাড়া সেতু
রাঙামাটি শহরে স্থানীয়দের কাছে এখন বিনোদনের প্রধান আকর্ষণ আসামবস্তি সেতু ও রিজার্ভ বাজার এলাকার পুরানপাড়া সেতু। কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্মিত এই দুই সেতুটি দাঁড়ালে হ্রদ ও পাহাড়ের সৌন্দর্য ও নির্মল বায়ু পাওয়া যায়।
দুই সেতু থেকে রাঙামাটি শহরের সবচেয়ে বড় পাহাড় ফুরোমোনের সৌন্দর্য ও ফুরোমোনের আড়ালে সূর্যাস্ত দেখা যায়। এ ছাড়াও শহরের মধ্যে সুখীনীলগঞ্জ, রাঙামাটি পার্ক, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ডিসি বাংলো, রাজবন বিহারেও ভ্রমণ করা যাবে।
কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন ও খাবেন?
রাজধানী ঢাকার গাবতলী, কলাবাগান, পান্থপথ, ফকিরাপুল থেকে ডলফিন, শ্যামলী, হানিফ, ইউনিক, সেন্টমার্টিন, এস আলম বাস যোগে রাঙামাটিতে যেতে পারেন। শ্যামলী ও সেন্টমার্টিনে এসি সার্ভিস চালু আছে। বিভিন্ন বাসের ভাড়া ভিন্ন ভিন্ন।
৭/৮ ঘণ্টায় রাঙামাটি পৌঁছে যাবে বাসগুলো। রাঙামাটিতে থাকার জন্য আছে বহু হোটেল-মোটেল। পাবেন বিভিন্ন সরকারি বিশ্রামাগার। রাঙামাটিতে বেড়াতে এসে অনেকে আদিবাসী খাবার খেতে চান।
তাদের জন্য শহরের রাজবাড়ি এলাকায় আছে একাধিক হোটেল। যার মধ্যে টুগুন রেস্টুরেন্ট, পিবির ভাতঘর, সমাজ্জ্যে, বিজুফুল, স্টিফেন ভাতঘর, বনরূপা বাজারে যদন ক্যাফে, আইরিশ অন্যতম।
কাপ্তাই হ্রদের মাঝখানে দ্বীপের কোথাও খেতে মন চাইলে চাং পাং, পেদা টিং টিং, মেজাং, গরবা রেস্টুরেন্টে খাওয়া যায়। তবে পরিবহন খরচের তারতম্যের কারণে দাম শহরের রেস্টুরেন্টের চেয়ে সেখানে একটু বেশি।
জেএমএস/জেআইএম