ফিচার

অত্যাচারী যে সম্রাট নিজের মাকেও হত্যা করেন

রোম যখন শত্রুদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছারখার হচ্ছিল, সেসময় সম্রাট নিরো আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন একটি কথা প্রচলিত রয়েছে ইতিহাসে, যা শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিলই বটে। মধ্যযুগের রোমান সাম্রাজ্য যেমন ইতিহাসে বিতর্কিত তেমনি এর সম্রাট নিরোও বিতর্কিত নানান ইতিহাস রচনা করেছেন জীবদ্দশায়। তবে নিষ্ঠুরতার জন্যই বেশি পরিচিত তিনি।

Advertisement

মাত্র ১৭ বছর বয়সে সৎ বাবা সম্রাট ক্লডিয়াসের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন নিরো। তাও মায়ের সহায়তায়। প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাসের বংশধর এই এগ্রিপিনা। তার ধমনিতেও বইছে নীলরক্ত। রাজকীয় উচ্চাশার পাশাপাশি কূটবুদ্ধি আর হিংস্রতা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

সম্রাট ক্লডিয়াস ছিলেন এগ্রিপিনের চাচা। এগ্রিপিনের বাবা সম্রাট অগাস্টাসের মৃত্যুর পর রোমান সম্রাট হন এগ্রিপিনের ভাই ক্যালিগুলা। যিনি ছিলেন অত্যাচারী এক রাজা। সিংহাসনে বসেই তিনি প্রথম যে কাজটি করেন তা হচ্ছে তার বোন এগ্রিপিনার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে একটি ছোট্ট দ্বীপে নির্বাসিত করেন। শিশু নিরোর শিক্ষক হিসেবে এক নর্তকীকে নিয়োগ করেন।

তখনকার যুগে নর্তকী বা অভিনেতাদের সামাজিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত নিচু। অত্যাচারী ক্যালিগুলার অধীনে শিশু নিরোর বেঁচে থাকা অনেকটা অসম্ভব ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, সে অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায় ক্যালিগুলার আকস্মিক মৃত্যুতে। ক্যালিগুলার মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তার সৎ চাচা ক্লডিয়াস।

Advertisement

ক্লডিয়াস নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে ভাইঝি এগ্রিপিনাকে বিয়ে করে প্রাসাদে নিয়ে আসেন। যার ফলে সম্রাট হওয়ার পথে নিরো আরও একধাপ এগিয়ে যায়। নিরোর মা এগ্রিপিনা দ্য ইয়াঙ্গার ছেলেকে সিংহাসনে বসাতে স্বামীকে হত্যা করেছিলেন। এমনকি এক সময় এগ্রিপিনা দ্য ইয়াঙ্গারের মৃত্যুও হয় তার ছেলের নির্দেশেই। অর্থাৎ নিজের মাকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন।

১৫ ডিসেম্বর, ৩৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নিরোর। মায়ের আদরে-প্রশ্রয়ে ছেলেবেলা থেকেই উচ্ছন্নে গেছিল নিরো। রাজ্য পরিচালনার চেয়ে অভিনয়, সুর আর সুরাতেই তার আগ্রহ ছিল বেশি। একইসঙ্গে তার ভেতর জন্ম নিচ্ছিল এক ভয়ানক নিষ্ঠুর ব্যক্তিত্বের। সৎ ছেলে হলেও রাজার সন্তানদের মধ্যে বয়সে নিরোই ছিলেন বড়। তাই ক্লডিয়াসের পর নিরোই ছিলেন রাজসিংহাসনের দাবিদার।

সিংহাসনে বসার পর নিরো অত্যাচারের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। তবে এর মাঝে অনেক ভালো কিছু কাজ করে প্রজাদের মন জয়ও করেছিল নিরো। তার শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছর ছিল রোমানদের স্বর্ণযুগ। মন্ত্রণা পরিষদের স্বাধীনতা বৃদ্ধি, গোপন বিচারের নামে হত্যা ও দুর্নীতি কমিয়ে আনা, খেলাধুলা ও বিনোদনভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজনসহ নানা কারণে রোমানদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন নিরো।

সম্রাট নিরো ছিলেন অত্যন্ত বেহিসাবি। বিশাল আকারের একটি প্রাসাদ নির্মাণ করতে গিয়ে তার পেছনে উড়িয়েছেন অঢেল অর্থ। খেলাধুলার নামে প্রাণী হত্যা ও রক্তক্ষয়ী গ্ল্যাডিয়েটর কমব্যাট বন্ধ করে গ্রিক কুস্তি চালু করেন তিনি। এসব কারণে তার সকল পাগলামি সত্ত্বেও লোকজন তাকে পছন্দ করত। বিখ্যাত সম্রাট ট্রাজান, নিরোর শাসনামলের প্রথম পাঁচ বছরকে উল্লেখ করেছেন রোমানদের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শাসনামল হিসেবে। কিন্তু সহিংসতা আর নিষ্ঠুরতার পূজারী নিরোর আসল রূপ ফুটে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। রাজনৈতিক খুন, লাম্পট্য, খ্রিষ্টানদের উপর অমানবিক অত্যাচার নিরোকে শীঘ্রই পরিণত করে একজন অত্যাচারী সম্রাটে।

Advertisement

মা এগ্রিপিনের মৃত্যুর পর নিরো রাজকার্য ছেড়ে দিয়ে সংগীত-অভিনয়-নারীসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি অলিম্পিকেও অংশগ্রহণ করেন। বলাই বাহুল্য, তার অংশগ্রহণ করা সবগুলো ইভেন্টে তিনিই বিজয়ী হয়েছিলেন। ৬২ খ্রিষ্টাব্দ। নিরোর উপপত্নী পপেয়া সাবিনা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। অথচ নিরো তখনো সম্ভ্রান্ত ক্লডিয়া অক্টাভিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। কলঙ্ক এড়াতে নিরো ক্লডিয়ার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করে তাকে নির্বাসনে পাঠান।

রোমের জনগণ এর বিরোধিতা করায় তিনি ক্লডিয়াকে হত্যা করেন। প্রথমে নিজের মা, তারপর স্ত্রী। নিরোর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। একই বছরে তার প্রিয়পাত্র ও প্রিটোরিয়ান রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্যুরোস মারা যান। যিনি নিরোর সমস্ত কুকর্মের সাহায্যকারী ছিলেন এবং তাকে আগলে রাখতেন। তবে এসব নয়, নিরো কুখ্যাত হয়ে আছেন অন্য কীর্তির জন্য।

ক্লডিয়া অক্টাভিয়াকে বিয়ে করেন ৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুন। তবে সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিরো নিজেকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় আবিষ্কার করেন। নিরো প্রথমে তাকে সাহায্য করার জন্য চিৎকার করতে থাকেন। এরপর তাকে হত্যা করার জন্য চিৎকার করে ডাক্তে থাকেন প্রহরীকে। তবে ভবিতব্য বুঝতে পেরে সকলেই নিরোকে ছেড়ে গিয়েছিল।

উন্মাদ রাজা বিলাপ শুরু করেন,"আমার কি কোনো বন্ধু নেই, শত্রুও নেই?" কিন্তু না, বন্ধু না থাকলেও শত্রুর অভাব ছিল না নিরোর। পরিস্থিতি অনুধাবন করে তিনি পালিয়ে যান ও নিস্তার অসম্ভব বুঝতে পেরে শেষমেশ আত্মহত্যা করেন আত্মপ্রেমে বুঁদ এই সম্রাট। মৃত্যুর আগে তিনি বিড়বিড় করছিলেন, "আহ, আমার সঙ্গে সঙ্গে কত বড় একজন শিল্পীর মৃত্যু হলো!"

এদিকে একটি বতর্ক এখনো রয়েই গিয়েছে। তা হলো সত্যিই কি সেদিন নিরো আপন মনে বাঁশি বাজিয়েছিলেন। যেদিন রোম পুড়ছিলো দাউ দাউ করে। সে প্রশ্নের সঠিক জবাব এখনো পাওয়া যায়নি ইতিহাসের কোথাও। ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে ৬৪ খৃস্টাব্দে রোমের বেশিরভাগ এলাকা পুড়ে গিয়েছিল। একটা গুজব আছে যে নিরোই নাকি এই আগুনটা লাগিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পরে এও দাবি করা হয় যে রোম নগরী যখন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি বেহালা বাজাচ্ছিলেন।

এই তথ্য সঠিক হতে পারে না। বিশেষজ্ঞদের দাবি, রোমান সাম্রাজ্যের আমলে বেহালার অস্তিত্ব ছিল না। তবে নিরো বীণাজাতীয় বিশেষ একটি বাদ্যযন্ত্র বাজানো উপভোগ করতেন।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন রোমের অগ্নিকাণ্ডের জন্যে নিরো দায়ী নন। কারণ এই আগুনে নিরোর নিজের প্রাসাদও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি রোম নগরীর বড় ধরনের উন্নতিও সাধন করেছিলেন।

সূত্র: ব্রিটিশ মিউজিয়াম

কেএসকে/এমএস