ফিচার

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও প্রত্যাশা

মো. হাবিবুর রহমানপ্রতিটি মানুষের জন্ম তার স্বজাতির জন্য বড় সুসংবাদ বয়ে আনে। এ মানব সন্তানই অজানা ইতিহাস গড়ার মূল কারিগরের ভূমিকা পালন করে। কালের পরিক্রমায় মানব সন্তানের প্রতিভা লুকিয়ে জন সম্মুখে প্রকাশ পায়। যদিও কখনো কখনো কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার আগে তা ঝরে যায়। তা মূলত স্থান কাল পাত্র ভেদে ও সমাজের অবস্থার উপর নির্ভর করে।

Advertisement

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় লিখেছিলেন, “যখন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে। এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। গুণিজনদের সঙ্গে কবি নজরুলের এ পংক্তি মিলে যায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা শহীদ এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের হারিয়ে জাতি ভারাক্রান্ত, ব্যথিত ও শোকাহত। এই শোককে বাঙালি জাতি রূপান্তরিত করেছে শক্তিতে। যে শক্তি তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।

যুগে যুগে পৃথিবীতে গুণীজনরা জন্ম নিয়েছেন মূলত, মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশনা ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য। তাদের কাছে কোনো ধরনের অস্ত্র ও আনবিক শক্তি ছিলো না। কিন্তু তাদের লেখনি শক্তি ও বক্তব্যের প্রতিধ্বনিতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও অত্যাচারী শাসকদের সাম্রাজ্য কেঁপে উঠেছে। তাদের লেখনী শাসকগোষ্ঠী ও পেশীশক্তির কাছে গোলাবারুদ ও অস্ত্র থেকেও ভয়ংকর মনে হয়েছে।

Advertisement

কবি, সাহিত্যিক, নেতা ও সমাজের গুণীজন সংখ্যায় কম হলেও তাদের লেখনি ও চিন্তার মাধ্যমে দেশের আপামর জনসাধারণ বৈষম্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ফলত, শাসকগোষ্ঠী তাদের বিভিন্নভাবে দমন করতো এবং যুদ্ধের মুহূর্তে বুদ্ধিজীবীদের ভীতিপ্রদর্শনের পাশাপাশি হত্যা করতো। যদিও তারা ভুলে যেতো গুণীজনের উত্তরসূরীরা যুগে যুগে জন্ম নেয়। বাংলাদেশে এ রকম গুণীজন মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবি স্মৃতিস্তম্ভ। কিছু কিছু বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবি স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণ করা হলেও আবার কিছুক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্নচিত্র। আবার কখনো কখনো দেখা যায় প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে ঐ সকল স্থান ও স্মৃতিস্তম্ভ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করা হয়।

মূলত আমাদের উচিত কোনো দিবসে তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন সীমাবদ্ধ না রাখা। সারাবছর নির্দিষ্ট সময়ে তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস পর্যালোচনা করা এবং সময় বের করে বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করা। তাদের বংশধর, জীবিত মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাস বিশ্লেষক ও গবেষকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, “যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না। সুতরাং গুণীজনদের সম্মান ও তাদের ইতিহাস জানা আমাদের সকলেরই কর্তব্য।

Advertisement

দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ অতিবাহিত হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছিলো যে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তখন এ শত্রুপক্ষ দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং এ দেশের বিজ্ঞজনদের বাছাই করে হত্যা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিলো তা নিয়ে গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ বিশ্লেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এ নিয়ে আরো বিস্তৃত গবেষণা করা প্রয়োজন।

১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শেষ অধ্যায়টি সম্পন্ন হয়েছিলো ঢাকাসহ সমগ্র দেশে। সেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও মুনির চৌধুরীসহ আরও অনেককে। তারপর তাদের মধ্যে থেকে কারও কারও লাশ খুঁজে পাওয়া যায় বধ্যভূমিতে। আবার কাউকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুরে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও চলে তাদের বুদ্ধিজীবীদের শেষ করার কর্মযজ্ঞ। কারো কারো মতে, মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র দেশে ১ হাজার ১১১ জনকে হত্যা করা হয়েছিলো। তন্মোধ্যে রাজশাহীতে ৫৪জন, বরিশালে ৭৫জন, খুলনাতে ৬৫জন, চট্টগ্রামে ৬২জন, ফরিদপুরে ৪৩জন, ময়মনসিংহে ৭৫জন, পাবনাতে ৫৩জন, দিনাজপুরে ৬১জন, যশোরে ৯১জন, কুমিল্লায় ৮৬জন, রংপুরে ৭২জন এবং ঢাকাতেই ১৪৯জন।

মূলত মুক্তিযুদ্ধের এক সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বিজয় অর্জন করতে অনেক তাজা প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো তা শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আরও বৃহৎ পরিসরে গবেষণা করা প্রয়োজন। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিসব নির্ধারণ করার পেছনে যুক্তি উপস্থাপন করে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, “১৪ ডিসেম্বরটাকে করা হয়েছে এই কারণে যে, বিজয় দিবস হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে।” ঢাকায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিস্তম্ভে সম্মান প্রদর্শন করার পাশাপাশি সমগ্র বাংলাদেশে এ দিবসটি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে পালন করা উচিত।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রংপুর ভৌগলিক ও কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কদের পাশাপাশি ৭২জনকে হত্যা করা হয়। রংপুরের মুক্তিকামী জনতা ৩ মার্চই প্রথম যুদ্ধ শুরু করে। এ অঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন শংকু সমজদার। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল মধ্যরাতে রংপুরে প্রথম গণহত্যা হয় দখিগঞ্জে।

এখানে হত্যা করা হয় যথাক্রমে ওয়াই এ মাহফুজ আলী জররেজ, এহসানুল হক দুলাল, রফিকুল ইসলাম রফিক, তোফাজ্জল হোসেন মহরম, পাগলা দরবেশ, ক্ষীতিশ হালদার, শান্তি চাকী, দুর্গাদাশ অধিকারী, গোপাল চন্দ্র এবং উত্তম কুমার অধিকারী গোলাপ। অন্যদিকে ৩০ এপ্রিল রংপুর ঢাকা মহাসড়কের দমদমা ব্রীজের কাছে হত্যা করা হয় কারমাইকেল কলেজ ও রংপুরের ৪জন শিক্ষককে। তারা হলেন অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়।

এ ছাড়াও আরও কিছু স্থান যথাক্রমে জাফরগঞ্জ, নিসবেতগঞ্জ, ঘাঘটপাড়, লাহিড়ীরহাট, সাহেবগঞ্জ, জয়রাম আনোয়ার মৌজা, পদ্মপুকুর, ঝাড়–দার বিল, বলারখাইলে গণহত্যা সংঘটিত হয়। নব্দীগঞ্জ, নিসবেতগঞ্জ ও দমাদমা ব্রীজের বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবী, সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক সাধারণ মানুষকে রাতের আঁধারে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও রংপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুখতার ইলাহীর নামও জড়িত। তাকে যেখানে হত্যা করা হয় সেই লালমনিরহাটে আইরখামারেও গণহত্যা সংঘটিত হয়।

যে সকল গুণীজন দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমি পরিদর্শন করার পাশাপাশি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করা দরকার। বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণ করার পাশাপাশি কোনো অব্যবস্থাপনা থাকলে তা স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর মাধ্যমে তা রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ দিবসে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

কেএসকে/জেআইএম