মতামত

মুরাদকাণ্ড: লাভক্ষতি এবং শিক্ষা!

মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু তার নিজের কথা। আর কথা হলো ছুড়ে দেয়া তীরের মতো। একবার বেরিয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনার উপায় নেই। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে এমপি আর ৪৫ বছর বয়সে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া ডা. মুরাদ হাসানের সামনে লম্বা এবং ঝলমলে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ছিল। কিন্তু তিনি ডেকে এনে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছেন। স্রেফ বেফাঁস কথাবার্তায় সব হারিয়েছেন ডা. মুরাদ হাসান। প্রতিমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন, দলের পদ হারিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সংসদ সদস্যপদও হারাতে পারেন। সব হারিয়ে নীরবে দেশ ছেড়েছেন ডা. মুরাদ হাসান। কিন্তু কপাল এমনই খারাপ ভিসা থাকলেও কানাডায় তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এসবই হয়েছে তার নিজের লাগামছাড়া কথার কারণে। মুরাদের আজকের পরিণতির জন্য তিনি নিজেই দায়ী। এখানে আর কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

Advertisement

ডা. মুরাদ হাসানকে হাইব্রিড বলার উপায় নেই। তার পিতা মতিউর রহমান তালুকদার বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সাংসদ এবং জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। মুরাদ হাসান নিজেও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তারপর যুবলীগ হয়ে আওয়ামী লীগে এসেছেন। তবে তার এই ক্যারিয়ারে একটি কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি দাবি করেছেন, মুরাদ হাসান ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক ছিলেন।

যুবদলের এক নেতা মির্জা ফখরুলের মুখের ওপর এই দাবির প্রতিবাদ করলেও তিনি তার দাবিতে অটল ছিলেন। মুরাদ হাসানের মতো একজন বিতর্কিত ব্যক্তির দায় কেন মির্জা ফখরুল আগ বাড়িয়ে নিজেদের কাঁধে নিলেন, এটা একটা রহস্য বটে। এখন আওয়ামী লীগ নেতারা বলার সুযোগ পাচ্ছেন, একসময় ছাত্রদল করতেন বলেই, তার রুচি ছাত্রদল মানের। এখন জানা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপির ছেলে হলেও মুরাদ ঠিকই একসময় ছাত্রদল করতেন।

নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর মুরাদ হাসান যখন ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি হন, তখন বিএনপি ছিল ক্ষমতায়। তিনি তখন ছাত্রদলের রাজনীতির সাথেই জড়িত ছিলেন। একপর্যায়ে ছাত্রদলের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখার প্রচার সম্পাদকও হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি ছাত্রদল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতার ছেলের সুবাদে ছাত্রলীগ তাকে সাদরে বরণও করে নেয়। তবে ছাত্রলীগ করতে গিয়ে তাকে অনেক লড়াই, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।

Advertisement

ত্যাগী আওয়ামী লীগার হলেও সব হারানোর আগের কয়েক মাস তার আচরণ, তার কথা তার প্রিয় সংগঠনের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। মুরাদ হাসানের পদত্যাগের পর তথ্য মন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, শেষ তিন মাস তার আচরণে অস্বাভাবিকতা ছিল। অবশ্য রাষ্ট্রধর্মের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে একটা অংশের অশ্লীল সমালোচনার শিকার যেমন হয়েছেন। আবার বড় একটা সমর্থনও পেয়েছিলেন। আশির দশকে এরশাদ যখন রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তন করেন, তখন আওয়ামী লীগ তো বটেই; এমনকি বিএনপি-জামায়াত এর প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু গত সাড়ে তিন দশকে বাংলাদেশ এতটাই বদলে গেছে, রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বললেই তোপের মুখে পড়তে হয়। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ’৭২এর সংবিধানেও চার মূলনীতির অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু দুই সামরিক শাসক নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সংবিধান এবং রাষ্ট্রের মৌলিক চেতনায় কাঁচি চালায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর রাষ্ট্রধর্মের বিপক্ষে অবস্থান নেয়াটা তাই বেশ সাহসের কাজই বলতে হবে। কিন্তু তিনি তার সে অবস্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি।

আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের তীব্র সমালোচনা করেন। মুরাদ হাসানও সেখানে ব্যতিক্রম নন। তবে তিনি অতি উৎসাহে আগ বাড়িয়ে বিএনপির সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব জাইমা রহমান সম্পর্কে অশালীন বক্তব্য দিয়ে নিজেও ডুবেছেন, দলকেও ডুবিয়েছেন। যিনি কোনো আলোচনায়ই নেই, তাকে টেনে এনে মুরাদ হাসান বিএনপির হাতে বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। হঠাৎ করেই জাইমা রহমানের প্রতি অনেক মানুষের সহানুভূতি এনে দিয়েছেন মুরাদ হাসান। তবে আওয়ামী লীগ করলেও প্রতিপক্ষকে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করা যায় না, এই উদারতা সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ দ্রুতই নিজেদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগের এই চেষ্টা থেকে শিক্ষা নেয়নি বিএনপি। অশ্লীল, অশালীন, লাগামছাড়া কথা বললে আওয়ামী লীগে তার ঠাঁই নেই; মুরাদ হাসানই এর প্রথম উদাহরণ নয়। এর আগে লতিফ সিদ্দিকী স্রেফ কথার কারণে সব হারিয়েছেন। গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, রাজশাহীর কাটাখালীর পৌর মেয়র আব্বাস আলীও লাগামছাড়া কথার কারণে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপি কোনো শিক্ষা নেয়নি। অতীতে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বা আশিফা আশরাফী পাপিয়াদের বিরুদ্ধে বিএনপি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, বরং তাদের লাই দিয়েছে। ডা. মুরাদ হাসানের অশ্লীল বক্তব্য নিয়ে যখন দেশজুড়ে তোলপাড়, তখন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে অশ্লীল বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু সরকারের সমালোচনা করা যত সহজ, বিরোধী দলের সমালোচনা বোধহয় অত মধুর নয়। তাই মুরাদ হাসানের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও আলালের বক্তব্য নিয়ে সেই অর্থে আলোচনাই নেই। যেন সরকারি দলের নেতা অশ্লীল কথা বললেই অপরাধ, বিএনপি নেতাদের যেন অশ্লীল কথা বলার লাইসেন্স আছে। আওয়ামী লীগ দ্রুত মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও আলালের ব্যাপারে বিএনপির কোনো ব্যবস্থার উদ্যোগ নেই। সমালোচনার দারুণ এক ডাবল স্ট্যান্ডার্ড দেখা গেল বাংলাদেশের রাজনীতিতে।

ডা. মুরাদ হাসানের ঘটনা থেকে আমাদের সবারই শিক্ষা নিতে হবে। মাঝে মধ্যেই আমরা ফাঁস হওয়া ফোনালাপ নিয়ে তোলপাড় তুলি। কিন্তু খতিয়ে দেখি না, কোত্থেকে ফোনালাপ ফাঁস হয়, কারা করে। এখন প্রমাণিত হলো, ফোনালাপ ফাঁসের ভয়ঙ্কর প্রবণতা থেকে এমনকি সরকারের মন্ত্রীরাও নিরাপদ নন। এমনকি তথ্য প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তথ্যও সুরক্ষিত নয়। প্রাইভেসি বলে আর কিছু নেই দেশে। এখন সবাইকে কথা বলার সময় সাবধান থাকতে হবে। দেয়ালেরও কান আছে- এই পুরোনো প্রবাদবাক্যটিই এখন ধ্রুব সত্য।

Advertisement

তবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। লতিফ সিদ্দিকী বা জাহাঙ্গীর আলমের পরিণতি দেখে সতর্ক হলে ডা. মুরাদ হাসানকে এই পরিণতি বরণ করতে হতো না। সময় এসেছে সবাইকে সতর্ক হওয়ার। নিজের জিহ্বাকে সামলে রাখার। রাজনীতিকে অশ্লীলতামুক্ত রাখার দায়িত্বটা রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। মুরাদ হোক আর আলাল হোক; অশ্লীল কথা বলে কেউ যেন রাজনীতিকে কলুষিত করতে না পারে।১২ ডিসেম্বর, ২০২১

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম/ফারুক