মতামত

খাদ্য নয় মা ভাত খেতে ডাকেন

ভাত নিয়ে ক’দিন ধরে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। গত ২৪ অক্টোবর খাদ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের ৫০ বছরে কৃষির উৎপাদন : রূপান্তর ও অর্জন শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা অনেক বেশি ভাত খাই। ভাত খাওয়া কমাতে পারলে চালের ব্যবহার অনেক কমে যাবে।’ তিনি সহজ-সরলভাবে কথাটি বললেও ভেতো বাঙালির কানে কথাটি শুনে মনে কষ্ট পেয়েছে। ভাত খাওয়া কমানোর পরামর্শ কারও দারিদ্র্য অথবা ডায়াবেটিস রোগ হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে। অনেকে ভাবছেন, তাহলে দেশে কি ভাতের অভাব দেখা দিয়েছে? এদেশে পেটপুরে ভাত খেতে না পারলে কারও কারও রাতে ঘুমই আসে না এমন ঘটনাও ঘটে যে!

Advertisement

ধানের দেশ গানের দেশ বাংলাদেশে একবেলা পেটপুরে ভাত খেতে না পারলে কি আর কারও মুখে ভাটিয়ালি, জারি-সারি গান বের হয়? রুটি খেলে তো আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। মিষ্টি মধুর সুরেলা কণ্ঠের গান বেরোবে কোন গলা দিয়ে? ভাত নিয়ে একটি লেখা পড়তে গিয়ে একবার এক স্বাধীনতা দিবসে বাচ্চাদের অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে গেলো। খেলাধুলার পর্ব শেষে গ্রামের স্কুলে বিচিত্রানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কবিতা, নাচ, গানের প্রতিযোগিতা হবে। তারপর বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়া হবে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। আমি মঞ্চে বসেছি একজন অতিথি হিসেবে। বিচারকরা বসেছেন একদিকে সারি করে। ঘোষক মাইকে ঘোষণা দিলেন- এবারে যে গান গাইতে আসছে সে খুব ভালো গান গায়। কয়েকবার তার নাম ধরে ঘোষণা দেয়া হলেও সে উপস্থিত নেই। অথচ একটু আগেই তাকে মঞ্চের পাশে বসে থাকতে দেখা গেছে। একটু খোঁজাখুঁজি করতে তাকে স্কুলের টিউবওয়েলে বাম হাতে হাতল চেপে ডান হাত দিয়ে নলে মুখ লাগিয়ে পানি খেতে দেখতে পাওয়া গেল।

তাকে গান গাওয়ার জন্য ধরে আনা হলো। কিন্তু সে ভালো সুরেলা কণ্ঠে গান গাইতে পারছিল না। তাকে বিচারকরা জিজ্ঞেস করলেন আজ তোমার কি হলো? কেন এমন হচ্ছে? সে কাঁদতে শুরু করলো। বলল, আজ সকালে ভাত খায়নি। রুটি খেয়ে স্কুলে এসেছে। তাই পেটে ব্যথা হচ্ছে! বার বার পানির পিপাসা লেগে যাচ্ছে। সেবার বন্যায় ওদের ধানের আবাদ হয়নি। তাই ঘরের ভাত ফুরিয়ে যাওয়ায় দু’বেলা করে রুটি খাচ্ছে ওরা। রুটি খাওয়া ওদের অভ্যেস নেই। তাই মনে খুব কষ্ট হচ্ছে। গলা দিয়ে গানের সুর বের হচ্ছে না। উপস্থিত অনেকে বললো আহারে বেচারা আজ ভাত খেতে পারেনি!

সেই ভাত কম খাওয়া নিয়ে আবার কথা বলাবলি শুরু হয়েছে। তাই বিষয়টি খুব চিত্তাকর্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। ভাত শর্করা, শরীরে শক্তি জোগায়। কায়িক পরিশ্রমে গায়ে বল দেয়। ভাত ফুরিয়ে গেলে মঙ্গা পরিস্থিতি ভাবা যায়। এ নিয়ে রাজনীতিও জমে ব্যাপক।

Advertisement

আমাদের দেশে খাদ্যের উৎপাদন বেড়েছে। তবু কেন খাদ্যাভাব? বাজারে খাদ্যদ্রব্য ও তৈজসপত্রের সরবরাহে ঘাটতি নেই, তবু কেন সংকট? লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য গুদামে মজুত করা আছে বলে তথ্যে দাবি করা হচ্ছে। তবুও কেন ক্ষুধার সময় ভাত কম করে খেতে হবে?

উৎপাদন বাড়লেও খাদ্যাভাবের বা অভাবের মূল কারণ হচ্ছে- খাদ্য সংগ্রহে ভুল তথ্য, সংরক্ষণ, বণ্টন, বাজারের নিয়ন্ত্রণহীনতা ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সুরক্ষা বলয় তৈরির অভাব। সম্পদের মেরুকরণে কেউ নিত্য বাসমতি, চিনিগুঁড়া চালের পোলাও, ফ্রায়েড রাইস খায়, কেউবা ইরি-বিরি চালের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে উপোস দিন-রাত কাটায়। আমরা পুষ্টিকর খাবারের মেন্যু নিয়ে খাবার বৈচিত্র সম্পর্কে মোটেও ভাবি না। শতকরা ৮০ মানুষ এক গামলা ভাত লবণ-মরিচ দিয়ে পেটে পুরতে পারলে খুশি হই। এটাই আমাদের কৃষ্টি। তাই ভাতের ওপর চাপ অনেক বেশি। বাড়িতে তিনবেলা ভাত রান্না হয়। শহর-গ্রাম সব জায়গায় প্রতিবেলায়ই ভাত খেতে ডাকা হয়, ভাত খাওয়া হয়। সামান্য তরকারী ও ভরপেট ভাত-ই আমাদের পরম প্রত্যাশা ও চাওয়া। আমরা কেউই খাবার চাই না, ভাত চাই, ভাত খেতে ভালোবাসি। তাই ভাতের অভাব মোটেও সহ্য করতে পারি না। ভাতের ক্ষুধা লাগলে অন্য কিছু দিয়ে তা পূরণ হওয়ার নয়। কেউ ভাত কম খেতে বললে তার কোনো নিস্তার নেই।

বাস্তব গল্পটা বলি। বহু বছর আগে আমাদের তিন বছর বয়সী মেয়ে জাপানের ‘হইকুয়েন’ বা ডে কেয়ার সেন্টার কাম স্কুলে পড়তো। সে সেখানে জাপানিজ সহপাঠীদের সাথে স্টিকি ভাত খেত। এক গ্রীষ্মাবকাশে পরিবারসহ ওকে একটি কনফারেন্সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সঙ্গে নিয়ে যাই। পোর্টল্যান্ডে জুলাই মাসে রাত ৯টা বাজলেও সূর্য ডোবে না। হোটেলে নানা পদের আমেরিকান খাবার খাওয়া শেষে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে সে বলল, এখনও ভাত খাইনি তো। আমি ভাত খাবার পর ঘুমাবো। সে কিছুতেই ভাত না খেয়ে ঘুমাবে না। মুশকিল হলো- তখন অনেক রাত, অন্ধকারও নেমে গেছে। পিৎজা, বিস্কুট, জুস কোনোটাই ওর মনপুত হলো না। আমি বললাম, এদেশে তো ভাত নেই। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। কি আর করা। ওর মাসহ ওকে সাথে নিয়ে নিচের ফুড কর্নারে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তোমাদের স্টিকি ভাত আছে কি না। তারা বলল, লম্বা মোটা চালের ওয়াইল্ড রাইস দিতে পারবে। তবে একটু সময় লাগবে।

আমরা বললাম ঠিক আছে, সময় লাগুক তবু ভাত রান্না করে দিন। প্রেশার কুকারে ওয়াইল্ড রাইস হতে দেরি হলো না। দুই ডলারে একটি বড় কাগজের কাপ ভর্তি করে ভাত পাওয়া গেল। আমাদের মেয়ে সেটা পেয়েই খুশি। সে সামান্য কিছু খেল, বাকিটা রুমে নিয়ে এলো। পরে যদি আবার খেতে ইচ্ছে করে তাই ফ্রিজে রেখে দেয়া হলো। পরবর্তী কয়েকদিন সে সেই ভাত খেয়েছিল। হাজার হোক, ভাত না হলে বাঙালির কি মন ভরে? আমরা যেখানেই যাই, যে দেশে থাকি না কেন- ভাত খেতে চাই, ভাত খেতে ডাকাডাকি করি, ভাত-ই খাই। ভাত কম খেতে বললে তা মানবো কেন? ভাত ফুরালে আমাদের দিন চলবে কী করে?

Advertisement

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/জেআইএম