মতামত

ওমিক্রন হোক না হোক : সতর্কতাতেই মুক্তি

কোভিড প্যান্ডেমিকে জর্জরিত পৃথিবীতে নতুন মাথাব্যথার নাম ওমিক্রন। ডেল্টার ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে আমরা যতটা স্বস্তিতে, পৃথিবীর অনেক প্রান্তে অনেকেই অতটা স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন না। আমেরিকায় প্রতিদিন শনাক্ত হচ্ছিল লাখের কাছাকাছি মানুষ আর অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করছিলেন আরও প্রায় কম-বেশি হাজারখানেক। নেদারল্যান্ডসে এরই মাঝে একদিনে শনাক্ত হয়েছে ২০ হাজারের বেশি রোগী, যা দেশটির জন্য একদিনে সর্বোচ্চ।

Advertisement

আমার একজন ডাচ কোলাবরেটর কদিন আগে বলছিলেন যে, সে দেশে এখন মৃত্যুযোগ্য মানুষের ঘাটতি পড়ছে! ইউরোপের দেশে দেশে যখন এভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কোভিড, ঠিক তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভাব নতুন কোভিড খলনায়ক ওমিক্রনের। স্পাইক প্রোটিনে কম-বেশি ৩০টি আর রিসেপ্টার প্রোটিনে আরও প্রায় ২০টি মিউটেশন নিয়ে মাঠে হাজির ওমিক্রন। দক্ষিণ আফ্রিকায় যাত্রা শুরুর পর দ্রুতই তা ছড়িয়েছে বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশে। দেশে দেশে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আর সব সতর্কতা সত্ত্বেও ওমিক্রন ঠেকাতে পারেনি যেমন সুদূর ইউরোপের দেশগুলো, পারেনি তেমনি ভারতও। সদ্যই বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছেন ওমিক্রন আক্রান্ত প্রথম দু’জন রোগী। বলা হচ্ছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটির ইভোলুশনারি জাম্প হয়েছে। মিউটেশনের কয়েকটি ধাপ এক লাফে অতিক্রম করেছে ভাইরাসটি, রূপ নিয়েছে ওমিক্রনে।

ওমিক্রন নিয়ে বিশ্বকে সতর্ক করায় কাল বিলম্ব করেনি বিশ্বের স্বাস্থ্যের নজরদারির দায়িত্বে থাকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও। ওমিক্রন যেমন ইভোলুশনে লাফ দিয়েছে, তেমনিভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেসপন্সটাও ছিল এক লাফেই। এই প্রথম সার্স-কোভ-২-এর কোনো ভ্যারিয়েন্টকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ না বলে সরাসরি ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে সংস্থাটি। শুধু ওমিক্রন মোকাবিলায় করণীয়গুলো নির্ধারণে সংস্থাটির উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য অ্যাসেম্বলি। সংস্থাটির ৭৩ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা এটা দ্বিতীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে দ্রুতই তারা জি-৭-এর বৈঠক আহ্বান করলে সতর্কতা লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও। দ্রুতই ঘোষণা করা হয়েছে ১৫ দফা নির্দেশনা। নিরুৎসাহিত করা হয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক আর ধর্মীয় সমাবেশগুলো। হোটেল-রেস্তোরাঁ আর পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে অর্ধেক ধারণক্ষমতায় অপারেট করার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে জিম্বাবুয়েফেরত বিজয়ী বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলকে।

পাশাপাশি ওমিক্রন ঝুঁকিতে থাকা বেশকিছু মূলত আফ্রিকান দেশ ফেরতদের জন্য প্রায় ১০০টি হোটেলে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনের আয়োজনও সম্পন্ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে নিশ্চিত করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকাফেরত প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইন। প্রায় দুই শতাধিক আফ্রিকাফেরত প্রবাসীকে হারিয়ে ফেলে সমালোচনায় পড়ে ছিলেন স্বাস্থ্যের কর্তারা। মাত্রই তারা অবশ্য জানিয়েছেন খুঁজে পাওয়া গেছে হারিয়ে ফেলা সেসব প্রবাসীকে। অর্থাৎ পরিস্থিতি সেই জায়গাটায়ও এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সাধারণত কোভিড লকডাউনের আগে আগে বা প্রত্যাহারের ঠিক পরপর যে নির্দেশনাগুলো আমরা সচরাচর দেখে থাকি এবার নির্দেশনাগুলো অনেকটাই সে ধরনের। বোঝাই যাচ্ছে সরকারের চেষ্টা আছে ওমিক্রনকে শুরু থেকেই ঠিকঠাক মতো সামাল দেয়ার। দেশে সিনিয়র সিটিজেন ও ফ্রন্টলাইনারদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সবচেয়ে বড় কথা খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওমিক্রনের বিষয়ে একাধিকবার প্রকাশ্যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

Advertisement

প্রশ্ন হচ্ছে কি আছে ওমিক্রনের? কেন ওমিক্রন নিয়ে এত উৎকণ্ঠা আর বড় বেশি বাড়াবাড়ি? যতদূর জানা যাচ্ছে এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ত্বরিতগতিতে, এতসব সতর্কতা সত্ত্বেও, ওমিক্রনের ইন্টারকন্টিনেন্টাল বিস্তৃতির মধ্যে দিয়েই যা স্পষ্ট, তা হলো ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে সম্ভবত বেশি সংক্রামক। অনেক বেশি মানুষ সম্ভবত অনেক তাড়াতাড়ি ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। কাজেই শঙ্কা আছে ওমিক্রন একবার ছড়ালে আরও অনেক বেশি তাড়াতাড়ি ভরে যেতে পারে হাসপাতাল শয্যাগুলো অসুস্থ মানুষে। তাই ওমিক্রন নিয়ে দেশ আর দুনিয়াজুড়ে এত সাজসাজ রব।

তবে এত কিছুর মধ্যে সবটাই যে হতাশার তা কিন্তু নয়। যতদূর জানা যাচ্ছে ওমিক্রনে ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণের শংকাটা কম। ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীর ক্লান্তিবোধ, শরীরে ব্যথা, শুকনো কাঁশি, জ্বর, গলা ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলেও, ওমিক্রনে আক্রান্ত হলেই রোগীরা দলে দলে আইসিউতে ভিড় বাড়াচ্ছেন, এমন তথ্য এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা পৃথিবীর অন্যান্য ওমিক্রন সংক্রমিত দেশগুলো থেকে পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নতুন কিছু না। কোন ভাইরাসের যখন দফায় দফায় মিউটেশন ঘটতে থাকে, তখন তার সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়লেও ‘ভিরুলেন্স’ অর্থাৎ তীব্র রোগ সৃষ্টির সক্ষমতা সাধারণত কমে যায়। কাজেই ওমিক্রনের ব্যাপারেও তেমনটা ঘটলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যদিও ‘চোরায় যেমন ধর্মের কথা শোনে না’, তেমনি ভাইরাসের বেলায়ও এমনি কোনো বেদবাক্য কিন্তু নেই। মার্কিন শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এন্থনি ফাউসিও জানিয়েছেন এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলার আগে আরও সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে।

সুখবর আছে আরও একটি। এরই মধ্যে ফাইজার এবং মডার্না জানিয়েছে তারা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে। তবে প্রচলিত কোভিড টিকাগুলো যে ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে না তাও কিন্তু হলফ করে বলা যাচ্ছে না। এটুকু আশা করা যেতেই পারে যে যারা প্রচলিত টিকাগুলো নিয়েছেন তাদের অন্তত ওমিক্রনের কারণে আইসিইউতে যেতে হবে না। বাংলাদেশের নিজস্ব উদ্ভাবিত কোভিড ভ্যাকসিন বঙ্গভ্যাক্সও মানবদেহে ফেইজ-১ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল থেকে এই ট্রায়ালের জন্য নৈতিক অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন শুধু ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদনের অপেক্ষা। লক্ষণীয় ফাইজার এবং মডার্নার মতো বঙ্গভ্যাক্সও একটি এমআরএনএ ভ্যাকসিন। ফাইজার এবং মর্ডানার মতো করে বঙ্গভ্যাক্সকেও ওমিক্রনের বিরুদ্ধে ডিজাইন করা সম্ভব এবং সেই সক্ষমতাটুকু দেশেই আছে। অনেকের হয়তো জানা নেই যে, বাংলাদেশে ফেইজ-১ হিউম্যান ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যে বঙ্গভ্যাক্স ব্যবহার করা হবে তা ডেল্টার বিরুদ্ধে ডিজাইন করা পৃথিবীর একমাত্র কোভিড ভ্যাকসিন। বানরের ওপর পরিচালিত বঙ্গভ্যাক্সের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ডেল্টার বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ ডেল্টার বিরুদ্ধে বঙ্গভ্যাক্সকে ডিজাইন করেছেন আমাদের বিজ্ঞানীরাই। আর এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে ডেল্টার বিরুদ্ধে ডিজাইন করা কোনো ভ্যাকসিন যে কারণে নেই তাহলো বাজারে যে কোভিড ভ্যাকসিনগুলো আছে তার সবগুলোই ডেভেলপ করা হয়েছিল ডেল্টা ওয়েভ আসার আগেই।

Advertisement

পৃথিবীতে কোভিড আছে এবং থাকবে যে আরও বেশকিছু দিন, তা নিয়েও সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। আশা করা যায় ওমিক্রন ডেল্টার মতো অমন ভয়াবহ হয়ে উঠবে না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না কোভিড তো কোভিডই, এটি ইনফ্লুয়েঞ্জা নয়। শুরুর দিকে বিশ্বে যখন ছিল না ব্রিটিশ, সাউথ আফ্রিকান কিংবা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টগুলো, তখনও তো চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া কোভিডের মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়েছিল দুনিয়াজুড়ে লাখো মানুষ। কাজেই সেই আপ্ত বাক্যগুলো অর্থাৎ মাস্ক পরা, হাত ধোয়া আর অপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে ঘোরাঘুরি না করার সেই পরামর্শগুলো বেদবাক্যের মতো হৃদয়ে ধারণ করতেই হবে। নচেত ওমিক্রন হোক চাই না হোক, মৃত্যুর মিছিল হবে প্রলম্বিত আর আমাদের আবারো ‘ওল্ড নরমালে’ ফিরে যাওয়াটা হবে বিলম্বিত।

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর রিসার্চার, এহিমি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।

এইচআর/জিকেএস