তথ্যপ্রযুক্তি

মাসে এক কোটি মানুষ পাচ্ছে ডিজিটাল সেবা

এক যুগ আগে, বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পর তথ্য ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধা নিয়ে শহর-গ্রামের মধ্যে কমেছে পার্থক্য। হয়েছে হাজার হাজার কর্মসংস্থান। বৈদেশিক আয়ও বাড়ছে। দেশে তৈরি হচ্ছে ৩৯টি আইটি পার্ক। ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু হচ্ছে। এখন প্রতি মাসে বিভিন্নভাবে ডিজিটালসেবা নিচ্ছে প্রায় এক কোটি মানুষ। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশকে আরও অনেক দূর যেতে হবে।

Advertisement

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার জাগো নিউজকে বলেন, ১২ ডিসেম্বর পঞ্চম ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে আমরা ফাইভ-জি যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব আহমেদ ওয়াজেদ জয় ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে এ ঐতিহাসিক যাত্রার উদ্বোধন করবেন।

জানা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়ন আজ থেকে ১২ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু করেন। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিলেন, ২০২১ সালে যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবো, তখন বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের মর্যাদাশীল, প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ।

সে সময় দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৫০০ ডলারের কম। বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমা ছিল ৪২ শতাংশের ওপর। বিদ্যুতের সংযোগ ছিল মাত্র ৪০ শতাংশের ঘরে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৫৬ লাখ। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ওয়েবসাইট ছিল অল্প সংখ্যক। ১২-২০টি ওয়েবসাইট ছিল। মেইল ব্যবহারের কোনো চর্চা ছিল না। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য কোথাও ছিল না ব্রডব্যান্ড। গ্রাম-ইউনিয়ন তো পরের কথা, বিভাগ-জেলা সদর পর্যন্ত ২০০৯ সালের আগে কোনো ব্রডব্যান্ড সংযোগ ছিল না। ছিল না আইসিটি শিল্পের কোনো অস্তিত্ব। তরুণদের আইসিটিতে কর্মসংস্থান তো দূরের কথা, প্রযুক্তিশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত ছিল না। প্রাইমারি, হাইস্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না কম্পিউটার।

Advertisement

এসব বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জাগো নিউজকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল দেশের ১৭ কোটি মানুষ পাচ্ছে। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প ঘোষণা করেন তখন তা ছিল একজন রাজনৈতিক নেতা শেখ হাসিনার। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব লাভের পর ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প হয়েছে দেশের সব জনগণের।

বিগত ১২ বছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন সাফল্যের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আইসিটি খাতে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২০ লাখ। বর্তমানে আইসিটি খাতে রপ্তানি এক দশমিক তিন মার্কিন ডলার। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশের প্রায় সাড়ে ছয় লাখের বেশি ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিং খাত থেকে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৭০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে। ডিজিটালের সুযোগ নিয়ে এখন ১০ কোটিরও বেশি মানুষ মোবাইল ব্যাংকিং করছে।

প্রধানমন্ত্রীর তথ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় রূপকল্প দিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশে ইন্টারনেটের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি। আর ২০ লাখে দাঁড়িয়েছে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান।

প্রতিমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে ৫২ হাজার ওয়েবসাইট, ৮২ হাজারের বেশি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, পৌরসভা ডিজিটাল সেন্টার, সিটি করপোরেশন ডিজিটাল সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। এখন ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, ডিজিটাল সার্ভিস, ডেলিভারি সেন্টার থেকে প্রতি মাসে প্রায় এক কোটি মানুষ সেবা নিচ্ছে। আয় করছে সাড়ে ৭০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

Advertisement

এত কিছুর পরও বাংলাদেশকে আরও অনেক দূর যেতে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। যশোরের শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে বিনিয়োগকারী যশোর আইটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিব হাসান জাগো নিউজকে বলেন, কারও অধীনে কাজ না করে এখন আমি ২০-২৫ জনকে চাকরি দিতে পারছি। এখানে বড় সুবিধা হচ্ছে আইটির কোনো গণ্ডি নেই। আপনি পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বসেই কাজ করতে পারছেন।

এই পার্কে কাজের চ্যালেঞ্জ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ এটি দেশের কান্ট্রি সাইডে হওয়ার কারণে দক্ষ মানুষ পাওয়া কঠিন। এজন্য আমরা যশোর আইটি ইনস্টিটিউট থেকে কিছু মানুষকে দক্ষ করে তুলছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সক্ষমতা আছে। কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষতা নেই। এখনও আমাদের দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। সরকার যদি সারাদেশে দ্রুতগতির ইন্টারনেট ছড়িয়ে দিতে পারে তখন দেখা যাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা তা ব্যবহার করে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতে পারবে।

তিনি বলেন, এখানে একটি সমস্যা রয়ে গেছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আওতাটা তো এখন অনেক কম। আর আমাদের যে সফটওয়ার টেকনোলজি ও হাইটেক পার্কগুলো তৈরি হচ্ছে সেগুলো যদি তাড়াতাড়ি শেষ করা যায় তাহলে সেখানেও দেশি-বিদেশি কোম্পানি কাজ শুরু করতে পারবে।

ফ্রিল্যান্স খাতের আয় ৮৫০ কোটি টাকাজাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাডের তথ্য মতে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা মাত্র ২০ হাজার ছিল। এখন বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ ফ্রিল্যান্সিং পেশার সঙ্গে যুক্ত। তারা বছরে ১০ কোটি ডলার বা ৮৫০ কোটি টাকা আয় করছেন।

আঙ্কটাড তাদের ‘ডিজিটাল ইকোনমি রিপোর্ট-২০১৯’ প্রকাশ করে বলেছে, উন্নত দেশগুলো তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যে মাত্রায় এগোচ্ছে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো সে তুলনায় পারছে না।

যশোর জেলার লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের গ্রাফিক্স ডিজাইনার কোর্সের প্রশিক্ষক নুরুন নাহার লীনা জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা সফলভাবে ফ্রিলান্সিং করছেন এবং নিজেদের মতো করে উপার্জন করছেন। শিক্ষার্থীরা করোনাকালে সুযোগ খুঁজছিলেন কীভাবে এই সময়টাকে কাজে লাগানো যায়। বিশেষ করে নারীরা এগিয়ে এসেছেন। তারাও ভালো করছেন। অনেকের প্রয়োজনীয় উপকরণসহ নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তারা চেষ্টা করেছেন এবং নিজেকে গড়ে তুলছেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করা শারমিন আক্তার শান্তা জাগো নিউজকে বলেন, মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর বেশ কিছুদিন বসেছিলাম। এরপর একটা চাকরি হয়েছিল। সেটার পোস্টিং ছিল মোংলা। নিরাপত্তা এবং আমার জন্য চ্যালেঞ্জিং হওয়ায় চাকরিটা আর করা হয়নি। তখন আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে এ বিষয়ে জানতে পারি। এরপর গ্রাফিক ডিজাইন বিষয়ে কোর্স করি। কোর্স শেষে বিজনেস কার্ড ডিজাইন, লোগো ডিজাইন, মেনু কার্ড ডিজাইন- এ ধরনের কাজ করি। এভাবে আমার ওই সময় যাত্রা শুরু। এরপর গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর কাজ শুরু করি। আমাদের বেশিরভাগ বায়ার (গ্রাহক) বিদেশি।

তিনি বলেন, এই কাজ করার পর জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কারণ বিদেশি যখন একটি বায়ারের কাছ থেকে ডলার আসে তখন তো একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে।

এ ধরনের ফ্রিল্যান্সিং কাজ নারীদের জন্য অনেক সুবিধাজনক উল্লেখ করে শারমিন বলেন, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থায় মেয়েরা বাইরে চাকরি করতে গেলে তাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন- রাত করে বাড়ি ফেরা যাবে না। বিবাহিত হলে শ্বশুরবাড়ি থেকেও তার প্রবলেম হয়। এ ধরনের নানা সমস্যা। সে হিসেবে ঘরে বসে যখন আমি একটা কাজ করছি, সেটা থেকে যখন আমার টাকা আসে, পরিবারকে আর্থিক সাপোর্ট দিতে পারছি- সেটা অন্য রকম অনুভূতি।

এইচএস/জেডএইচ/বিএ/জেআইএম