দেশের ফুটবলের সেই সোনালী দিন এখন আর নেই। গ্যালারিতে উপচেপড়া দর্শকের গগণবিদারী চিৎকার, মুহুর্মুহু করতালি, সর্বোচ্চ উৎসাহ উদ্দীপনা এখন শুধুই অতীত। ঢাকার ক্লাব ফুটবলের সেই রমরমা দিনও বিগত হয়েছে অনেক আগেই।
Advertisement
দেশের ফুটবলের সেই সোনাঝরা দিনগুলোয় বিশেষ করে ৭০ দশক থেকে শুরু করে ৮০-৯০ দশকে বাংলাদেশের ফুটবলে একটি প্রশ্নই উঠতো সবচেয়ে বেশি- কে সেরা সালাউদ্দীন নাকি এনায়েত? সেই কাজী সালাউদ্দীন এখন দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান।
আর এনায়েত? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকেই ধাঁধায় পড়ে যান। সত্যিই তো, কোথায় এনায়েত? তিনি কি দেশের ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন? বর্তমান প্রজন্মের অনেকের তা জানাও নেই। এখন যারা দেশের ফুটবলের খুুঁটিনাটি খোঁজখবর রাখেন, তারা কী করে জানবেন- এনায়েত কী মানের ফুটবলার ছিলেন? তার ফুটবল মেধা কেমন ছিল?
একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করি, স্বাধীন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে বিদেশের মাটিতে প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি এনায়েতের। ১৯৭৩ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপ টুর্নামেন্টে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে গোলটি করেছিলেন এনায়েত। সত্তর দশকের মাঠ কাপানো ফুটবলার এনায়েত।
Advertisement
এখন যেটাকে স্ট্রাইকার বলা হয়, তখন ঐ পজিশনটার নাম ছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড। তুখোড় সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন এনায়েত। দুর্দান্ত বল প্লেয়ার, প্রচন্ড শারীরিক সক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। বল নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ড্রিবল করায় ছিল দারুণ পারদর্শিতা। আর লক্ষ্যভেদী শটের জন্য এখনও তাকে স্মরণ করেন সমসাময়িক ফুটবলাররা।
এমন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এনায়েতুর রহমান দেশে ছিলেন না দুই যুগের বেশি সময়। সেই ১৯৯৪ সালে এক বুক অভিমান নিয়ে দেশে ছেড়ে গেছেন বাংলাদেশের ফুটবলের সব সময়ের অন্যতম সেরা প্রতিভা। দীর্ঘ ২৭ বছর পর এবার দেশে এসেছেন।
শনিবার (১১ ডিসেম্বর) সেই বরেণ্য ফুটবলার এক অন্যরকম আয়োজনে হলেন সংবর্ধিত। দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (বিএসজেএ) শনিবার মধ্যাহ্নে দেশের ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি এনায়েতকে সংবর্ধিত করলো।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সুইমিং পুলের পাশে বিএসজেএ ভবনে হলো সে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। যদিও অনুষ্ঠানের ব্যানারে লেখা ছিল ‘কিংবদন্তির সঙ্গে...’ তবে ঐ অনুষ্ঠানে এনায়েত একা নন, দেশের ফুটবলের একঝাঁক তারার সম্মেলন ঘটেছিল।
Advertisement
কে ছিলেন না? দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার, ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাবেক অধিনায়ক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সাক্ষী স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু, সেই দলের সহ অধিনায়ক, অসাধারণ প্রতিভাবান রাইট উইং প্রতাপ শংকর হাজরা। দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা লেফট উইং গোলাম সারোয়ার টিপু, স্টপার ব্যাক শেখ আশরাফ আলী, দেশবরেণ্য সিনিয়র সাংবাদিক ও ৫০-৬০ দশকের মাঠ কাঁপানো সেন্টার ফরোয়ার্ড কামরুজ্জামান এসেছিলেন এনায়েতকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে।
তাদের সঙ্গে ছিলেন ৭০-৮০’র দশকের মাঠ মাতানো ও দারুণ মেধাবী একঝাঁক ফুটবলার। সে তালিকাও অনেক বড়। সেই ‘৭৮ সালে এশীয় যুব (অনূর্ধ্ব-১৯) ফুটবলে বাংলাদেশের একমাত্র জয়ের নায়ক হাসান, জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতা, দেশের ফুটবলের অন্যতম সেরা লেফট উইং আশরাফউদ্দীন আহমেদ চুন্নু, ঢাকার ক্লাব ফুটবল ও জাতীয় দলের সফলতম স্ট্রাইকার শেখ মোহাম্মদ আসলাম, পায়ের কাজের সঙ্গে প্রচণ্ড গতি ও ড্রিবলিংয়ের মিশেলে দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম স্কিলড ফুটবলার ওয়াসিম ইকবাল, আবাহনী-মোহামেডান তথা জাতীয় দলের অন্যতম সেরা লেফট ব্যাক ইমতিয়াজ সুলতান জনি, বল নিয়ন্ত্রণের অসামান্য দক্ষতা ও ড্রিবলিংয়ের জন্য যাকে এখনও দর্শকরা মনে রেখেছেন সেই হাসানুজ্জামান বাবলু, মাঝমাঠের দুই পরিশ্রমী তারকা খুরশিদ বাবুল-আব্দুস সালাম, মোহামেডান-আবাহনী ও জাতীয় দলে খেলা নামী লেফট ব্যাক রকিব, আরেক জনপ্রিয় ফুটবলার এবং মোহামেডানের স্বর্ণ সময়ের (৮০-৮২) দুর্দার্ন্ত লেফট উইংগার আব্দুল গাফফার, ৭০-৮০ দশকের স্ট্রাইকার মোহাম্মদ মালাও ফুটবলার এনায়েতকে নিয়ে কথা বলেন। তার অসামান্য ফুটবল প্রতিভার অকুন্ঠ প্রশংসা করেন।
সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক দিলু খন্দকারের সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএসজেএ’র বর্তমান সভাপতি সাইদুজ্জামান, সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল হকসহ প্রথিতযশা সাংবাদিকরা। দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতার অগ্রদূত, বিএসজেএ’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান বলেন, এনায়েত দেশের ফুটবলের বড় অলংকার। সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন এনায়েত। ঢাকার ফুটবল দেখছি ১৯৫০ সাল থেকে। এনায়েতের মতো বল প্লে মেকার আমি আর দেখিনি। দুই-তিনজনকে কাটিয়ে গোল দিতো। দুই পা’ই রকেটের মতো চলতো।
গোলাম সারোয়ার টিপুর মূল্যায়ন, অনেক মেধাবী ও প্রচণ্ড সাহসী খেলোয়াড় ছিলেন এনায়েত। খন্দকার ওয়াসিম ইকবালের চোখে, এনায়েত ভাই ছিলেন কিংবদন্তি খেলোয়াড়। হাসানুজ্জামান বাবলু বলেন ৫-৬ জন প্লেয়ার ও গোলকিপারকে কাটিয়ে গোল করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এনায়েত ভাইয়ের।
এনায়েতকে দেশের ফুটবলের কিংবদন্তি উল্লেখ করে আশরাফউদ্দীন আহমেদ চুন্নু বলেন, আমরা এনায়েত ভাইদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। তারা আমাদের অনেক স্নেহ, মমতা ও ভালবাসায় কাছে টেনে নিয়েছেন।
স্বাধীনতার আগে বিজিপ্রেস দিয়ে শুরু ঢাকার ফুটবলে যাত্রা। তারপর ওয়াপদা, বিআইডিসি, বিজেএমসি হয়ে মোহামেডানে আসা। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মোহামেডানের লিগ জয়ের অন্যতম রুপকার এনায়েত। সেবার ঢাকা লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছিলেন তিনি।
যার পা থেকে বল কেড়ে নেয়া ছিল দূরহ কাজ, যিনি একাই প্রতিপক্ষ সীমানার যেকোনো জায়গায় বল পেয়ে অনায়াসে দু-তিনজনকে কাটিয়ে গোলের উৎস রচনা ও লক্ষভেদী শটে গোল করায় ছিলেন সমান পারদর্শী, সেই এনায়েতের খেলোয়াড়ি জীবনের বড় সময় কেটেছে বিআইডিসি ও বিজেএমসিতে।
মোহামেডানে পুরো দুই মৌসুমও খেলা হয়নি এ কালজয়ী ফুটবলারের। সাদা কালো শিবিরে যোগ দেওয়ার দ্বিতীয় বছরেই জড়িয়ে পড়েন এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায়। ৭৯’র ঢাকা লিগের এক ম্যাচে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের বিপক্ষে রেফারি দলিল খানের গায়ে হাত তুলে ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন এনায়েত। বছর দেড়েক পর শাস্তি মওকুফ হলেও নিজেকে আর সেভাবে ফিরে পাননি। ৮১ সালে রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটির হয়ে খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি।
এরপর মোহামেডান ও ব্রাদার্সের হয়ে ক্লাব কোচিং করিয়েছেন। কিন্তু খেলোয়াড়ি জীবনে দারুণ সফল ও সৃজনশীল ফুটবলার এনায়েতুর রহমান ফুটবল গড়ার কাজে সেভাবে মনোনিবেশ না করে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। এখন তার স্থায়ী নিবাস কানাডা।
এই অসামান্য প্রতিভাবান ফুটবলার এনায়েত নিজের বক্তব্যের শুরুতেই তাকে সম্মানিত করায় বিএসজেএকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, পুরো আয়োজন দেখে আমি অভিভূত। বিনয়ী এনায়েতের আত্মোপলব্ধি, ‘আমি এতটা প্রাপ্তির যোগ্য নই।’
সামনে থাকা জাকারিয়া পিন্টু, গোলাম সারোয়ার টিপু, প্রতাপ শংকর হাজরা, শেখ আশরাফ আলীরদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করে বলেন, ‘তারা সবাই অনেক বড় মাপের ফুটবলার ছিলেন।’
এছাড়া তার সমসাময়িক ফুটবলার প্রয়াত মনোয়ার হোসেন নান্নু, শহিদুর রহমান চৌধুরী শান্টু ও শামসুল আলম মঞ্জুর ফুটবল মেধারও কদর করেন এনায়েত। পাশাপাশি অনুজপ্রতিম আসলাম, চুন্নু, ওয়াসিম, জনি, গাফফার, হাসান, খুরশিদ বাবুল, সালাম, হাসানদের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন এনায়েত।
শেষের আগে খানিকটা আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ফুটবল রত্নদের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। এটা হওয়া খুব দরকার। পুরোনোরা যথাযথ মর্যাদা পেলে এবং মূল্যায়িত হলেই নতুনরা ফুটবলে আগ্রহী হবে। ফুটবলের সোনালী দিন ফিরে আসবে।’
এআরবি/এসএএস/জেআইএম