সাহিত্য

মায়াবতী: পর্ব ২৬

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

Advertisement

চব্বিশ.সেলুলার সেট প্রায়ই বন্ধ রাখে রিয়া। আজও হ্যান্ডব্যাগের ভেতর বন্ধ ছিল। হ্যান্ডব্যাগ রেখেছিল ওয়াড্রোবে।কী মনে হলো বুঝতে পারেনি। মনের ভেতর একটা অস্থিরতা টের পেল ও। সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল ওয়ারড্রবের কাছে। সেট নিয়ে এসে অন করে বসল চেয়ারে। কারো ফোনের অপেক্ষা কি মনে দোলা দিয়ে যাচ্ছিল? বুঝতে পারেনি।মোবাইল অন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিংটোন বেজে ওঠে।বাঁধন! বাঁধনের কল এসেছে।দারুচিনি দ্বীপের নায়িকা, কেমন আছিস? ফোন ধরেই উল্লাসে চিৎকার দিয়ে জানতে চায় রিয়া।খোঁটা দিচ্ছিস নাকি? আমি তো দারুচিনি দ্বীপের নায়িকা না। নায়িকা হয়েছে মম।রেজা মামা বলেছিল, আসল নায়িকা তুই-ই। বলেছিলাম তোকে, হেরেও জয় পেয়েছিস তুই। তাই আমাদের কাছে তুই-ই সেরা স্টার।শোন। তোর লেকচার বন্ধ রাখ। আমার কথা শোন। আগামীকাল ব্যাংকক যাচ্ছি। নাটকের শুটিং আছে। কয়েকদিন থাকব। যাবি নাকি সঙ্গে? আমার সঙ্গে একজন যেতে পারবে। মামণি একটু অসুস্থ, যেতে চাইছে না।পাগল হয়েছিস নাকি? সামনে পরীক্ষা না? তোর তো পরীক্ষা নেই। তা ছাড়া নাটকে ক্যারিয়ার গড়ে তোল। তুই যা। আমাদের শুভ কামনা থাকল তোর জন্য। সঙ্গে না হয় যূথীকে নিয়ে যা। আর শোন, ব্যাংকক ভালো করে দেখে আসিস। ব্যাংককের গল্প শুনব তুই ফিরে এলে।

এ সময় ফোন সেটে শব্দ হতে থাকে পিপ্পিপ্। কল ওয়েটিং। কেউ রিং করেছে। কানের কাছ থেকে ও চোখের সামনে নিয়ে আসে মোবাইল ফোন সেট। ভিজুয়াল স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ‘রেমামা’।খুশিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে রিয়া। তাড়াহুড়ো করে বলল, বাঁধন, ফোন রাখছি। জরুরি কল এসেছে। ধরতে হবে কলটা।ওকে রাখছি। মনে হচ্ছে তোর টোন হঠাৎ বদলে গেছে?গুড বাই, সুইট গার্ল। বাঁধনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লাইন কেটে দিয়েছে রিয়া।লাইন ফ্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও কল এলো। ‘রেমামা’ অর্থাৎ রেজা মামা কল করেছে।দ্রুত কল অ্যাটেন্ড করে ও বলল, হ্যালো, রিয়া বলছি।শোনো, তোমার জন্য সুখবর আছে।সুখবর! আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠে রিয়ার গলার স্বর।হ্যাঁ। সুখবর। ফারুক ফোন করেছে। তোমার দেওয়া নম্বর থেকে লোকেশন শনাক্ত করেছিল তারা। ওটা ছিল পাবলিক ফোন বুথ। সেখান থেকে যে ফোন করত তাকে ধরা গেছে।বাকিরা ধরে পড়েনি?না। বাকিরাও ধরা পড়বে। বিষয়টা সিক্রেট রাখো এখন।একজন ধরা পড়লে তো সুখবরের কিছু দেখছি না। অন্যরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।সুখবর আছে। ধৃত ছেলেকে ইন্টারোগেশন করা হয়েছে। এক্সটেনসিভ ইন্টারোগেশনের সময় সে অনেক তথ্য দিয়েছে।কী তথ্য মামা?ফারুক জানিয়েছে, গ্রুপের একজন তোমার প্রতি অনুরক্ত ছিল। তার প্ররোচনায় ওরা তোমাকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করেনি। সে-ছেলেই কৌশলে মোবাইল ফোন সেট রেখে গিয়েছিল সোফার কোণে। তোমাকে যে-রুমে আটকে রেখেছিল সেই রুম থেকে তাই তুমি ফোন করার সুযোগ পেয়েছিলে।ওহ! গলার স্বর ভারী হয়ে গেল রিয়ার। পুরোনো দৃশ্য মনে করার চেষ্টা করল। হ্যাঁ। মনে পড়ছে। একটি ছেলে, বেশ হ্যান্ডসাম, পরে এসে সেট নিয়ে গেছে। ভাবখানা এই যে ভুলে রেখে গেছে। পুলিশ উদ্ধার করার আগেই সে এসেছিল। তবে কি সে-ই ছেলেটা ইচ্ছাকৃতভাবে ওই কাজ করেছিল? নিজেকে উদ্ধারের পথ বাতলে দিয়েছিল? সবাই ছিল উগ্র, অস্বাভাবিক ধরনের ক্রূর, ক্রুয়েল। এমন ছেলের মনেও কি মায়া থাকতে পারে? ড্রাগ অ্যাডিক্টদের তো মন পুড়ে যায়। আবেগ পুড়ে যায়। পত্রিকার স্বাস্থ্যকুশল পাতায় পড়েছিল। কোত্থেকে মায়া এলো ছেলেটার মনে? কোনো কূলকিনারা খুঁজে পেল না রিয়া। ঠান্ডা গলায় বলল, মামা সুখবরের তো কিছুই দেখছি না। বরং ভয় বাড়ছে। ওরা যদি ক্ষেপে ফটোগুলো অনলাইনে ছেড়ে দেয়? তোমার শঙ্কা বুঝতে পারছি। সেই সুযোগ নেই তাদের হাতে। এটাই সুখবর।সুযোগ নেই মানে?মানে খুব সোজা। অনুরক্ত এই ছেলের সঙ্গে অন্যদের ঝগড়া বেঁধেছিল। সে ক্যামেরা থেকে রিল বের করে ছিঁড়ে নষ্ট করে ফেলেছিল। ওরা ছবি প্রিন্ট করার সুযোগ পায়নি। তাই এতদিনেও অনলাইনে ছবি ছাড়তে পারেনি, ব্ল্যাকমেইলের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তবে কয়েকটি মেয়েকে তারা ফাঁদে ফেলেছে। তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে। রক্ষা কবচ হচ্ছে ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করেনি ওরা।উফ! বড় একটা শ্বাস ছাড়ল রিয়া। বুকের ভেতর থেকে আশি হাজার মণ ওজনের বস্তা নেমে গেল এইমাত্র। আনন্দে চোখে পানি চলে এলো। ধরা গলা এবং ভেজা চোখে রিয়া কৃতজ্ঞতা জানাল, মামা ইউ আর গ্রেট। ইউ হ্যাভ সেভ্ড মাই লাইফ।না না। আমি গ্রেট না। তোমার ভাগ্য তোমাকে রক্ষা করেছে। আর একজন উপরওয়ালা তো আছেন, কী বলো?জি মামা ঠিক বলেছেন। তবে আপনার কারণে ফারুক মামার আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। তিনি পোস্টিং নিয়ে চট্টগ্রাম আছেন। চট্টগ্রাম থেকেও আমার সঙ্গে টাইম টু টাইম কথা বলেছেন, সবকিছু হয়েছে আপনার কারণে। মামা, আপনি কোথায়? আপনার সঙ্গে এই মুহূর্তে একটু দেখা করতে ইচ্ছা করছে।এ মুহূর্তে আমি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে আছি। একা একা ঘুরছি? একসময়ের প্রিয় ক্যাম্পাসে ভালো লাগছে ঘুরতে।আমি আসি, মামা? অল্প সময়ে চলে আসব।আসতে চাইলে আসো। আমি ফুলার রোডের সড়কদ্বীপে ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্যের সামনে আছি। এলে এখানে পাবে আমাকে।আমি আসছি। আপনি ওখান থেকে চলে যাবেন না।দ্রুত লাইন কেটে দিয়েছে রিয়া।

পঁচিশ.সড়কদ্বীপের চারপাশে ঘুরছে রেজা। একসময় গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল চারপাশ।‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’ ভাস্কর্য দেশের সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য। বঙ্গবন্ধুর তর্জনি ওঠানো বিশাল ভাস্কর্যটি স্বাধীনতার বড় স্তম্ভ। আর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বেশ কতকগুলো ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ভাস্কর্যে। বিশালাকৃতির মূল ভাস্কর্যের ভিত গড়ে তোলা হয়েছে ভাষাশহীদদের ভাস্কর্য দিয়ে।মূল ভাস্কর্য ছাড়াও ত্রিভুজাকৃতির এই দ্বীপের তিন কোণে রয়েছে তিন ভাস্কর্য। দক্ষিণ-পূর্ব কোণে শোভা পাচ্ছে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিহত শহীদ নূর হোসেনের ভাস্কর্য। বুকে পিঠে লেখা আছে সময়ের বিখ্যাত স্লোগান ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।নূর হোসেনের প্রতিকৃতির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল রেজা।গণতন্ত্রের কথা ভাবছে ও। ভাবতে ভাবতে ডালিয়া ফুলগাছের পাতা ছিঁড়ে নেয়। গ্রিলের কাছেই ছিল ডালিয়াগাছ। ছিঁড়েই অবাক হয়ে গেল। অন্যমনস্ক অবস্থায় পাতা ছিঁড়েছে ও।দ্বীপের বাগান বেশ সুন্দর। বাগানের মধ্যে আছে কৃত্রিম ফোয়ারা, চমৎকার সব গাছগাছালি। এখানে আছে হাসনাহেনা, বেলি, রজনিগন্ধা, গোলাপ, চিনিচাঁপা, শিউলি, গন্ধরাজ, ক্যামেলিয়া, গাঁদা, চেরি, ডালিয়াসহ নানা ফুলগাছ।ডালিয়ার পাতা এখনো হাতে ধরা। এ সময় একজন লোক এসে সামনে দাঁড়ালেন। তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি এ বাগানের মালী।রেজা বলল, আপনাকে পেয়ে ভালোই হলো। প্রথমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি বাগানের পরিচর্যার জন্য। সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন গাছগাছালি, ফুল। আবারও ধন্যবাদ। আপনার নামটা জানতে পারি কি?নরম স্বরে লোকটা বলল, আমার নাম বাদল গোয়ালা।উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল রেজা। বাদল গোয়ালা একটা কিছু বলতে চাচ্ছিল। বলতে পারল না। রেজার গলার স্বরের আন্তরিকতা ও দাপটে বাদল গোয়ালার কথা থেমে গেল। রেজা বলল, ফুলগাছ আর পাতাবাহার গাছের আড়ালে অসংখ্য ছোট ছোট ভাস্কর্য দেখছি। সেগুলোর পরিচয় বলবেন? অনেককে চিনতে পারছি, অনেককে পারছি না।বাদল গোয়ালা বলতে চাচ্ছিল, বাগানের পাতা ছেঁড়া নিষেধ। অন্যায়। আপনি অন্যায় করেছেন। বলতে পারল না। নিজের কথা নিজের মধ্যে হারিয়ে গেল। উচ্ছ্বসিত কাউকে কষ্ট দিতে চায় না সে। বরং বলতে শুরু করল: এটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জগদীশচন্দ্র বসু, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকান্ত, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শিল্পী সুলতান, জি সি দেব, সুভাস বোস, কামাল আতাতুর্ক, মহাত্মা গান্ধী, রাজা রামমোহন রায়, মাও সেতুং, ইয়াসির আরাফাত, জেনারেল ওসমানী, তাজউদ্দীন আহমদ, সিরাজ সিকদার... মোট ১১৬টি ভাস্কর্য এখানে। সবগুলো শামিম সিকদারের গড়া। মূল ভাস্কর্য ছাড়া অন্যগুলোর গড় উচ্চতা ৩ থেকে ৪ ফিট উঁচু।রেজা এবার বাদল গোয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাই, আপনার হাতটা দেন।কেন? বাদল গোয়ালা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।এত মনীষীর যত্ন নিচ্ছেন আপনি। আপনার হাতটা ছুঁতে ইচ্ছা করছে। সব ভাস্কর্যের রং শুভ্র। আপনি ভাস্কর্যগুলো মলিন হতে দেননি। বাদল গোয়ালা হাত বাড়াতে সংকোচ করছে। রেজা দুহাত বাড়িয়ে লুফে নিল বাদলের ডান হাত।হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে রেজা।

Advertisement

এ সময় রিয়াদের টয়োটা গাড়িটা পাশে এসে দাঁড়াল। রিয়া বেশ দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল রেজা মামাকে।গাড়ি থেকে নেমেই, অবাক চোখে তাকিয়ে ও চোখে চোখে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী?রেজা আচমকা রিয়াকে দেখে সংকুচিত হয়ে হাত ছেড়ে দিয়ে গোয়ালাকে বলল, আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।রিয়া বলল, গাড়িতে ওঠেন।রেজা আদেশ পালন করে ডান পাশ থেকে ঘুরে বাঁ পাশে গাড়িতে উঠে বসল।রিয়া ড্রাইভারকে বলল, টিএসসি সড়কদ্বীপের পাশে ডাচে চলো।ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে চলতে লাগল।টিএসসি সড়কদ্বীপের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের দক্ষিণে ডাচ, ফাস্ট ফুড স্টল। স্টলের সামনে গাড়ি থেকে নামল ওরা। এখানে ফুচকাও বিক্রি হয়। রিয়া ফুচকার অর্ডার দিয়ে বলল, মামা, সামনে গিয়ে বসেন। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের সামনে বসার জায়গা আছে।রেজা আবারও আদেশ পালন করে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে বসে চারপাশটা দেখতে লাগল।কিছুক্ষণ পর প্লেটে ফুচকা নিয়ে এলো রিয়া। প্লেটে আছে দশটা ফুচকা। প্রতিটা ফুচকায় গাঁথা আছে একটা কাঠি। ফুচকা নিয়ে রেজা মামার পাশে বসে রিয়া।রিয়া এসেছিল আনন্দদৌড়ে। এই মুহূর্তে মুখে আনন্দ নেই। আনন্দের কথা ভুলে গেছে। গম্ভীর হয়ে আছে। গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করল, মনে হচ্ছিল মন্দিরের সামনে পুরোহিতের হাত ধরে পুজো করছিলেন! ব্যাপার কী? এভাবে লোকটার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন কেন?রেজা উত্তর দিলো, লোকটার নাম বাদল গোয়ালা।রিয়া তেতে ওঠে, লোকটার নাম জানার দরকার নেই আমার। অশোভনভাবে হাত ধরেছিলেন কেন, সেটা বলেন।বাদল গোয়ালা ভাস্কর্যের সিকিউরিটি গার্ড কাম মালী।তো কী হয়েছে?মালী হলেও তিনি অসাধারণ হৃদয়বান একজন মানুষ। হৃদয়ছোঁয়া মমতা দিয়ে ভাস্কর্যগুলোর যত্ন নেন। শ্বেত-শুভ্রই আছে ভাস্কর্যগুলো। একটুও মলিনতা নেই ওসবের গায়ে।এটা ওর দায়িত্ব। দায়িত্ববান একজন মানুষ হতে পারেন তিনি। ব্যস। হাত ধরবেন কেন? রিয়ার ক্ষ্যাপাটে ভাব কমেনি। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে ও।অনেকের মনে মমতা আছে, বাইরে থেকে দেখা যায় না, জানো রিয়া?রিয়া এবার চোখ তুলে রেজা মামার চোখের দিকে তাকাল। মামাকে মনে হলো অসাধারণ মমতাবান পুরুষ। মামার চোখে এই মুহূর্তে সেই মমতার ঢেউ দেখতে পেল। দেখে মন গলে গেল ওর। বসা অবস্থা থেকে সামান্য উঠে রেজা মামার দেহ ঘেঁষে বসল এবার। গলার স্বর একদম নরম হয়ে গেছে। নরম গলায় বলল, নিন ফুচকা খান। বলেই কাঠির মাথায় আটকিয়ে একটি ফুচকা নিজের মুখে পুরে দেয় ও।রেজার ফুচকার দিকে মন নেই। বলে যেতে থাকে, বাদল গোয়ালার যত্নে আছে হৃদয়ভরা মমতা। এমন লোকের হাত ধরা সৌভাগ্যের ব্যাপার।রিয়া বলল, ভাস্কর্য নিয়ে তো নেতিবাচক ধারণা আছে। আমাদের সমাজে ভাস্কর্য নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ির দরকার কী?হ্যাঁ ঠিক বলেছ, বিভ্রান্তি আছে। ভাস্কর্য নিয়ে অনীহা আছে। ভ্রান্ত ধারণা আছে। এটাও সত্যি, ভাস্কর্য হচ্ছে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির ইটপাথরের রূপ। এর সঙ্গে মিশে থাকে শিল্পীর একান্ত নিজস্ব কল্পনা, বিশ্বাস।রিয়া প্রশ্ন করে, ইতিহাস কি পুরোটুকু জীবন্ত করা যায়?না। তা বলা যাবে না। এখানে ‘পুরোটুকু’ শব্দটার মধ্যে লিমিটেশন থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে মিশে থাকবে শিল্পীর নিজস্ব বিশ্বাস। আদর্শ।কিন্তু মামা, ঐতিহাসিক সত্য হলো ভাস্কর্য হচ্ছে পূজার্চনার বিষয়।না। ভাস্কর্য পূজার্চনার বিষয় না। এখানেই তো রয়েছে বড় ভুল। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম দেশেও ভাস্কর্য হচ্ছে সংস্কৃতির একটা অঙ্গ। উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে শিল্পকর্মকে শিল্প হিসেবে দেখা উচিত। পূজার্চনার বিষয়টা এখানে আসে না। পূজার্চনার সঙ্গে থাকে ধর্মবিশ্বাসীদের আলাদা মূর্তি। মূর্তিকে নয়, মূর্তিতে তারা পূজা করে। তাদের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করাও মনের উদারতা। হৃদয়বান মানুষেরা তো শ্রদ্ধা করবে অন্যের বিশ্বাসকে, তাই না? ধর্মও তো তাই-ই বলেছে, জানো?রিয়া আর কথা বলল না, পুরো আলাপচারিতার মধ্যে তিন শব্দ ওর মনে গেঁথে গেল। একটা শব্দ হচ্ছে ‘হৃদয়ভরা মমতা’, দ্বিতীয়টা হচ্ছে ‘হৃদয়বান মানুষ’। তৃতীয়টা হচ্ছে ‘হৃদয়ছোঁয়া মানুষ’। রেজা মামাকে মনে হচ্ছে অসাধারণ এক হৃদয়বান মানুষ, যার মন ভরে আছে মমতায়। মমতায় সিক্ত হয়ে মামার দেহের সঙ্গে সেঁটে বসে থাকে ও। ফুচকা খাচ্ছে। মাঝে মাঝে রেজাও মুখে পুরে নিচ্ছে ফুচকা।

চলবে...

এসইউ/জেআইএম

Advertisement