মাসুম পারভেজ
Advertisement
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ ও আত্মজীবনী। এর মধ্যে প্রতিভাবান গল্পকারগণ মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে লিখেছেন ছোটগল্প। মুুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পসংকলন ‘বাংলাদেশ কথা কয়’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। এ সংকলনে ষোলোটি গল্প স্থান পায়। এতে বিপ্রদাশ বড়ুয়া, নির্মলেন্দু গুণ, আবদুল হাফিজ, সুব্রত বড়ুয়া, ফজলুল হক, আসফ-উজ-জামান, বুলবন ওসমান, কামাল মাহবুব, অনু ইসলাম, আসাদ চৌধুরী, সত্যেন সেন, ইলিয়াস আহমদ, জহির রায়হান, কায়েস আহমেদ, শওকত ওসমান এবং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গল্প লিখেছেন।
এর প্রায় বারো বছর পর প্রকাশিত হয় মুক্তিযুদ্ধের আরও দুটি গল্পসংকলন। আবুল হাসনাত সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৮৩)’ এবং হারুন হাবীব সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ: নির্বাচিত গল্প (১৯৮৫)’। ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ সংকলনে লিখেছেন শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, জহির রায়হান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সুচরিত চৌধুরী, রাবেয়া খাতুন, হাসান আজিজুল হক, রাহাত খান, মাহমুদুল হক, জাহানারা ইমাম, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন, কায়েস আহমেদ, রবিউল হুসাইন, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, তাপস মজুমদার, সিরাজুল ইসলাম, আহমদ বশীর, রিজিয়া রহমান, ইমদাদুল হক মিলন এবং মঈনুল আহসান সাবের।
‘মুক্তিযুদ্ধ: নির্বাচিত গল্প’ সংকলনে লিখেছেন জহির রায়হান, রাবেয়া খাতুন, রণেশ দাশগুপ্ত, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল হাফিজ, রশীদ হায়দার, আলমগীর সাত্তার, মাহবুব তালুকদার, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, শওকত আলী, মিন্নাত আলী, মাহমুদুল হক, বশীর আল হেলাল, শওকত ওসমান, হারুন হাবীব, আবুবকর সিদ্দিক, শাহরিয়ার কবির, হাসান আজিজুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মঈনুল আহসান সাবের, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, সরদার জয়েনউদ্দিন, হুমায়ূন আহমেদ, সৈয়দ ইকবাল, সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, রাহাত খান এবং সৈয়দ শামসুল হক।
Advertisement
এ ছাড়াও বিগত কয়েক দশকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প সংকলনের সংখ্যা কম নয়। বশীর আল হেলালের ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া (১৯৭২)’ সংকলনে স্থান পেয়েছে আটটি গল্প। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘আমার রক্ত স্বপ্ন আমার (১৯৭৫)’ সংকলনে স্থান পেয়েছে সাতটি গল্প। হাসান আজিজুল হকের ‘নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫)’ বইয়ের সব গল্পই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৭)’ বইয়ে আছে চারটি গল্প। তাঁর ‘ল্যাংড়ী (১৯৮৪)’ সংকলনেও মুক্তিযুদ্ধের বিষয় এসেছে চারটি গল্পে।
পাশাপাশি শওকত আলীর লেলিহান সাধ (১৯৭৭), সাদেকা সফিউল্লাহর যুদ্ধ অবশেষে (১৯৮০), শওকত ওসমানের জন্ম যদি তব বঙ্গে (১৯৮৪), বিপ্রদাশ বড়ুয়ার সাদা কফিন (১৯৮৪), যুদ্ধ জয়ের গল্প (১৯৮৫) ও মুক্তিযোদ্ধারা (১৯৯১), হারুন হাবীরের লাল শার্ট ও পিতৃপুরুষ (১৯৮৫), বিদ্রোহী ও আপন পদাবলী (১৯৮৫) ও গল্পসপ্তম (১৯৯৭), জুবাইদা গুলশান আরার বাতাসে বারুদ-রক্তে নিরুদ্ধ উল্লাস (১৯৮৬), খালেদা সালাউদ্দিনের যখন রুদ্ধশ্বাস (১৯৮৬), এহসান চৌধুরীর একাত্তরের গল্প (১৯৮৬), সৈয়দ ইকবালের একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প (১৯৮৬), রশীদ হায়দারের তখন (১৯৭৭), আবুবকর সিদ্দিকের মরে বাঁচার স্বাধীনতা (১৯৮৭), রাবেয়া খাতুনের মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (১৯৮৬), মকবুলা মনজুরের মুক্তিযুদ্ধের গল্প (১৯৯১), কাজী জাকির হাসানের যুদ্ধের গল্প (১৯৯১), সৈয়দ শামসুল হকের জলেশ্বরীর গল্পগুলো (১৯৯০) ও প্রাচীন বংশের নিঃস্ব সন্তান (১৯৮১), সেলিনা হোসেনের পরজন্ম (১৯৮৬), বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মুরুহীন মহারাজ (১৯৭৪) ইত্যাদিও উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছোটগল্পগুলোয় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বহুমাত্রিক চিত্র উঠে এসেছে। একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার, নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসলীলা, অসংখ্য মানুষের দেশত্যাগ, দেশের মানুষের নিরাপত্তাহীনতা, মানবীয় সংকট ইত্যাদি বিষয় গল্পের উপাদান হয়ে এসেছে। এসব ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোয় বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কোনো কোনো গল্পে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে নতুন কিছু প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে।
বাংলা ছোটগল্পের জমিনে চিত্রায়িত হয়েছে নিজস্ব উপলব্ধি, আত্মোৎসর্গকারী জনগণের নির্লোভ মুখ। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠেছে সম্ভ্রম হারানো নারী হৃদয়। তাই গল্পগুলো আবেগসঞ্চারী বাক্যবিন্যাসে মূর্ত হয়ে ধরা দেয় পাঠক হৃদয়ে। গল্পকারদের শক্তিমত্তা, বুননশৈলীতে ভাস্বর হয় অসহায় জনগণের দীর্ঘশ্বাস। বিবৃত ঘটনারাশি পারস্পরিক সহমতের নিরিখে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি করে চেতনায়। তাই গল্পগুলো ঘটনা পরম্পরায় মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস হয়ে ওঠার দাবি রাখে। কেননা গল্পগুলো পাঠে উপকৃত হবে আগামী প্রজন্মও।
Advertisement
বলে রাখা ভালো, এর বাইরেও অনেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প লিখেছেন। এখনো লিখে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও লিখবেন। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প লিখেছেন তারা আমাদের কাছে অগ্রগণ্য হয়েই থাকবেন। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধের গল্প আমরা পেয়েছি। যুদ্ধপরবর্তী দেশের সমসাময়িক অবস্থা নিয়েও অনেক গল্প লেখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত হয়েছে তাতে। আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের গল্পের এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
লেখক: কথাশিল্পী
এসইউ/এএসএম