আমাদের পারিবারিক একজন বন্ধুর ছেলে অটিস্টিক ছিলেন। বয়সে ছিলেন আমার চেয়ে কিছুটা বড়। চাচা ছিলেন খুবই আমুদে। ছোটবেলায় মাঝে সাঝেই তার বাসায় দাওয়াত হতো। জমিয়ে আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়ার সেই পারিবারিক সুখস্মৃতিগুলো এখনো আমার কাছে জ্বলজ্বলে। অবাক লাগতো যে পরিবারটি তাদের এই বিশেষ সদস্যটি নিয়ে এতটুকুও ‘লজ্জিত’ ছিলেন না।
Advertisement
লজ্জিত শব্দটা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করা। সে সময় বাংলাদেশে পরিবারের এই বিশেষ সদস্যরা সমাজের কাছে ছিলেন পরিবারের জন্য লজ্জার। পারতপক্ষে কেউ তাদের এই বিশেষ সদস্যদের সামনে আনতে চাইতেন না। শিক্ষা আর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সাথে তাদের একীভূত করা উদ্যোগ তো ছিল প্রশ্নাতীত। নিজ পরিবারের বিশেষ এই সদস্যটি আর দশজনের সামনে সমানভাবে উপস্থাপন করা আর তাকে নিয়ে সবার সাথে সবার মতো করে ওই বৈরী পৃথিবীতে বেচে থাকার ওই প্রয়াসটুকুর জন্যই এই পরিবারটিকে আমি কখনো ভুলি না।
দুই.মাস খানেক আগেই আমরা কোরবানির ঈদ উদযাপন করলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে চমৎকার একটি ঈদ কার্ড উপহার পেয়েছি। পেয়েছি তার আগের ঈদেও আর আগের বছরগুলোতেও। প্রতিবারই কার্ডগুলোতে হাতে আঁকা কিছু চমৎকার ছবি মুদ্রিত থাকে। কখনো ঈদ উদযাপন তো কখনো গ্রাম বাংলার দৃশ্যপট, বিষয়বস্তুর বিভিন্নতা থাকে প্রতিবারই। এই কার্ডগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, প্রতিটি কার্ডে অটিস্টিক শিশুদের আঁকা ছবি ব্যবহার করা হয়। এতটাই বদলে গেছে আজকের বাংলাদেশ যে এক সময় এ সমাজ যাকে পরিবারের ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিত লজ্জার বলে, তা-ই আজ রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট।
তিন.বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ব্লকটিতে আমার হেপাটোলজি ডিপার্টমেন্ট, তার সামনেই দেশের একমাত্র অটিজম ইনস্টিটিউটটি। আশা যাওয়ার পথে এখানে আসা বিশেষ শিশুদের সাথে মাঝে মধ্যেই দেখা হয়। পিতা-মাতারা গর্বিত ভঙ্গিমায় তাদের অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে আসছেন-যাচ্ছেন, কোথাও কোনো জড়তা নেই, লজ্জার তো প্রশ্নই ওঠে না। আশেপাশের পথ চলতি মানুষেরও তাদের প্রতি কোনো তীর্যক ভ্রুকুটি নেই। ঠিক যেমনটি একটি আধুনিক, উদারমনা সমাজে প্রত্যাশিত। সত্যি বলতে কি আমরা আজ এতটাই উদার হতে শিখেছি যে প্যারা-অলিম্পিকে আমাদের বিশেষ সন্তানদের প্রতিটি সাফল্যে আমরা বারবার উদ্বেলিত হই।
Advertisement
চার.এ বিশেষ জায়গাটিতে বাংলাদেশের যে আমূল পরিবর্তন আর এক্ষেত্রে উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমাদের যে সহসা ইউটার্ন তা কিন্তু খুব বেশি দিনের ইতিহাস নয়, বড়জোর একটি যুগের। এই অসম্ভবটি যে মানুষটি সম্ভব করেছেন তিনি যে নিশ্চই অসামান্য, তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না। এই অসামান্য মানুষটির পূর্বপুরুষরাও অনেক অসাধ্যকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন। তার মাতামহ এর রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা ও জনক আর তার মায়ের হাত ধরেই পিছন দিকে ছুটতে থাকা বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো আর তারপর বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হওয়ার রূপকথার বাস্তবায়ন। অমন দুজন অসাোন্য মানুষের উত্তরসূরির কাছে যেমনটি প্রত্যাশিত তিনি তাই-ই করে দেখিয়েছেন।
আজ তার জন্মদিন। অমন পরিবারের এমন গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্যের জন্মদিনে লিখতে বসলে স্তুতিবাক্যের ফুলঝুরি ছুটবে তেমনটাই প্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে তার অবশ্য কোনো প্রয়োজনই নেই। যেমন প্রয়োজন নেই বিশেষ এই পরিবারটির অন্যান্য গুণী সদস্যদের বেলায়ও। কারণ তারা প্রত্যেকেই নিজ গুণেই গুণান্বিত। আজ যার জন্মদিন তাকে তার নিজ কর্মগুণের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘হু এক্সিলেন্স’ পদকে ভূষিত করেছে আর মনোনীত করেছে সংস্থাটির মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ প্যানেলটির একজন সন্মানিত সদস্য হিসেবেও।
শুভ জন্মদিন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল- সমতার ভিত্তিতে সবাইকে নিয়ে সামনে এগোনোর যে অনন্য দৃষ্টান্ত আপনি স্থাপন করেছেন তার জন্য নিজ গুণেই আপনি অমরত্বের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন।
লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ওসদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
Advertisement
এইচআর/জিকেএস