মতামত

মুরাদের ফোনালাপ এবং সিনেমা পাড়ার ঘোর তমসা

সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন লোকজন হলে গিয়ে ছবি দেখার আহ্বান জানায়, সাধারণত আমি সে ছবি দেখতে যাই না। সিনেমা চলবে তার গুণে, সিনেমা শিল্প টিকে থাকবে তার নির্মাতা-কলাকৌশলীদের উন্নত পারফরম্যান্সের মধ্য দিয়ে। দর্শক সিনেমা শিল্পকে রক্ষার ঠেকায় হলে সিনেমা দেখতে যায় না, যাবেও না। সর্বশেষ ২০১৮ সালে সিনেমা হলে গিয়ে আমি ‘স্বপ্নজাল’ নামের একটি বাংলা সিনেমা দেখেছি।

Advertisement

‘মনপুরা’ খ্যাত গিয়াস উদ্দিন সেলিম বানিয়েছেন বলে দেখতে গিয়েছিলাম। হালে সমালোচিত পরীমনির অভিনয়ও প্রথমবারের মতো দেখা হয়েছে। তার আগের বছর আমার ছেলেকে নিয়ে দেখেছিলাম পুলিশ বাহিনীর অর্থায়নে নির্মিত ‘ঢাকা এ্যাটাক’। পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ অনেক বড় বড় পুলিশ কর্তাও দর্শক হয়েছিলেন সেদিন। আমি মোটামুটি উপভোগ করেছিলাম। বিনোদন সিনেমার মাল মসলা ছিল এতে। আরেফিন শুভ, এবিএম সুমন, তাসকিন রহমানও ভালো অভিনয় করেছিলেন।

ছবিতে মাহিয়া মাহিও সাংবাদিক চরিত্রে খারাপ করেননি যদিও পুলিশ চরিত্র নিয়ে পরিচালক যতটা সচেতন ছিলেন সাংবাদিক চরিত্র নিয়ে একটুও ছিলেন না। অনেক ভুলভাল ছিল রিপোর্টার মাহিয়ার চরিত্রে। ঢাকা এ্যাটাক টিমের আরেকটি ছবি ‘মিশন এক্সট্রিম’ মুক্তি পেয়েছে গত ৩ ডিসেম্বর। নির্মাতা গোষ্ঠী এটিকে বলতে চাচ্ছে- কপ থ্রিলার। আরেফিন শুভর সঙ্গে এবার নতুন নায়িকা জান্নাতুল ঐশী। মিশন এক্সট্রিমের পুলিশ অফিসার চরিত্রের জন্য শুভ সিক্স প্যাক বানিয়েছেন যেটা ঢাকার সিনেমায় নায়কদের করতে দেখা যায় না।

আমার খুব আগ্রহ ছিল এটা দেখবো। কিন্তু কিছু লোকের হলে গিয়ে সিনেমা দেখুন স্লোগানে সেই আগ্রহে ভাটা পড়েছে। বিরক্ত হয়েছি আরেফিন শুভর সস্তা প্রচারণায়ও। ছবির ক্যাম্পেইনে তিনি বঙ্গবন্ধু লেখা টুপি পরে আছেন অথচ তার অভিনীত ‘বঙ্গবন্ধু’ ছবির প্রচার এখনো শুরু হয়নি। তিনি দর্শকদের উদ্দেশ্যে ক্যামেরায় বলেছেন, ‘যদি আপনি বাংলাদেশী হোন, আপনার যদি সেভেন্টি-ওয়ান এর প্রতি কোনো রকমের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং তাদের সেই ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে, আপনি যদি বাংলা ভাষায় কথা বলেন, আপনার যদি ফিফটি-টু এর প্রতি কোনো রকমের অনুরাগ থাকে, সেই সেক্রিফাইজের জন্য আপনার বুকের ভিতর যদি কষ্ট থাকে এবং আপনি যদি একজন বাংলাদেশি হন এবং গর্ববোধ করেন, তাহলে আপনি মিশন এক্সট্রিম দেখবেন।’

Advertisement

সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম অনেকে ৭১, ৫২ কে ইংরেজিতে বলায় তার সমালোচনা করছেন। আমার কাছে এগুলো খুবই স্থূল সমালোচনা মনে হয়। বরং আমার কাছে আপত্তিজনক মনে হয়েছে বাংলাদেশি হওয়ার প্রমাণ দেওয়ার জন্য তার ছবি দেখার বিষয়টি। এটি একটি পুলিশি এ্যাকশনের ছবি। আগের ছবিও তাই ছিল। বড় জোর তিনি বলতে পারেন এটা দেশপ্রেমের ছবি, দর্শক যেন দেখতে যায়। কিন্তু বাঙালি কিংবা বাংলাদেশি প্রমাণের জন্য তার ছবি দেখতে হবে কেন?

আমি খুব আশংকায় আছি যে এ ধরনের অভিনেতাদের দিয়ে শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় ‘বঙ্গবন্ধু’ সিনেমাটি ডিজাস্টার কিছু হয় কি না। চরিত্র অনুযায়ী কাস্টিং আমার পছন্দ হয়নি। মনে মনে ভেবেছিলাম বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বানানো ছবিটি রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’বা জামিল দেহলভীর ‘জিন্নাহ’র মতো কিছু হবে, যেখানে ভারতের জাতির পিতা গান্ধীর চরিত্রে ছিলেন বেন কিংসলে এবং পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহর চরিত্র রূপদান করেছেন আরেক বিখ্যাত অভিনেতা ক্রিস্টোফার লি।

আরেফিন শুভকে নিয়ে কিছু কথা বলবো যখন ভাবছি তখন ফাঁস হলো ঢাকার সিনেমার আরেক নায়ক ইমনের সঙ্গে সদ্য বিদায়ী তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের ফোনকল, যেখানে চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা মাহিয়া মাহিকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এমন বিশ্রি কথা-বার্তা বলেছেন ডা. মুরাদ। পুরোটা শোনার পর মুরাদ হাসানকে যেমন ক্ষমতার দম্ভে ভরা ধর্ষকামী, সাইকোপ্যাথ মনে হয়েছে তেমনি ইমনকে মনে হয়েছে পিম্প। আমি ভাবতে পারি না একজন নায়ক-নায়িকাকে একজন প্রতিমন্ত্রী এ ভাষায় কথা বলতে পারে। যারা দর্শকের স্বপ্নের তারকা তারা এতো সস্তা, এতো ব্যক্তিত্বহীন!

মুরাদ হাসানের কথাবার্তায় আমার অসভ্য, বিকৃত হাসির খুনি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও মনে পড়েছে। কারণ তার আগের দিন তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে মুরাদ শ্রবণ অযোগ্য ভাষায় আক্রমণ করার ভিডিও দেখেছি। তা মাথায় রয়ে গেছে। মুরাদ হাসান শুধু জাইমাকে নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের, খালেদা জিয়াকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছেন। অমার্জিত ভাষায় আক্রমণ করেছেন ডা. জাফরুল্লাহকে। আমার জানা মতে বাংলাদেশ সরকারের কোনো মন্ত্রী এ যাবতকালে এমন অসভ্য, অমার্জিত ভাষায় কথা বলেননি। অন্য কোনো দেশ হলে তাকে এতোক্ষণে জেলে দেখতাম।

Advertisement

তার নোংরা ভাষা, তার নোংরা আচরণ, তার এই রাজনৈতিক কালচার আওয়ামী লীগের জন্য লজ্জার। আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীরও বিরোধী দল নোংরা ভাষায় আক্রমণ করে। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া বিএনপি নেতা আলালের প্রধানমন্ত্রীকে অশ্লীল, অমার্জিত, নোংরা ইঙ্গিত করে দেওয়া ভাষণের ভিডিও আমার চোখে পড়েছে। আমার ধারণা তিনি আইনের আওতায় আসবেন সহসা। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির কাছে মানুষ উন্নত কালচার আশা করে না কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপির পথে হাঁটবে মানুষ এটা নিতে পারে না; তাহলে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগ উন্নত কীভাবে?

মুরাদের ফাঁস হওয়া ফোনালাপে নায়ক নায়িকাকে শুধু অসহায় ভাববো? তাদের কথায় তো তা মনে হচ্ছে না। অন্তত ইমনের কথায় তো মনে হচ্ছে তিনি এই দায়িত্বে অভ্যস্ত। মাহির কথার মধ্যে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছিল। তিনি যে মন্ত্রীর ফোন ধরেন না, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন সেটা আলাপে প্রকাশ পেলেও এ ধরনের ডাকে অভ্যস্ত সেটা স্পষ্ট। আবার কেউ বলবেন তার অসহায়ত্বও ফুটে উঠৈছে। একজন নায়িকাকে 'আমি এখন পুলিশ, ডিবি, এসবি, এনএসআই, ডিজিএফআই পাঠাচ্ছি, তোরে বাইন্ধা নিয়ে আসবে', 'তোরে আমি ….. '- এমন ভাষায় কথা বলার পরও তার প্রতিবাদ না করে নীরব থাকার মধ্যে অসহায়ত্ব ধরা পড়ে।

বাংলা সিনেমার নায়িকাদের কী এমন দশা আজ? সিনেমায় টিকে থাকতে হলে ‘সিনেমা মন্ত্রী’ ডাকলে তার ইচ্ছার পুতুল হতে হবে? নায়করা মন্ত্রীর নায়িকা জোগানদাতা? একজন শীর্ষ নায়িকা হয়ে এ ধরনের অশ্লীলতা মাহি সহ্য করবেন কেন? কেন ফোনটা রাখতে পারতেছেন না তিনি? শুধু কি সরকারি বাহিনী দিয়ে তুলে আনার হুমকির ভয় নাকি তিনিও কোথায় না কোথাও এসব ব্যক্তির আশীর্বাদ প্রত্যাশা করেন? তাই ভাইয়া ভাইয়া করে গেছেন।

মুরাদের বিদায়ের পর শোনা যাচ্ছে তিনি শাকিব খান, মৌসুমীকে নিয়েও বাজে কথা বলেছেন। এক পরিচালক দেখলাম অভিযোগ করছেন তার সিনেমার মহরত অনুষ্ঠানে গিয়ে উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন মুরাদ। আমি বলি, আপনারা তখন কোথায় ছিলেন? তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেননি কেন? নাকি ভেবে নিয়েছেন এটা নিত্য ঘটবে আপনাদের সঙ্গে। তাহলে চলচ্চিত্রের মর্যাদাকে নিচে নামিয়ে আনায় আপনারাও কম দোষী না।

সিনেমার শীর্ষ লোকরা প্রতিবাদ করতে না পারলে প্রতিবাদ করবে কে? মুরাদের কি সাহস ছিল কোনো শীর্ষ সাংবাদিককে এই ভাষায় কথা বলার? তার কর্তৃত্বের জায়গায় তো সংবাদ মাধ্যমও রয়েছে, শুধু সিনেমা নয়। এক মুরাদ চলে গেলে আপনারা আপদমুক্ত হয়ে গেছেন ভাবার তো কারণ নেই তাহলে। কারণ আপনাদের সরিষার মধ্যে ভূত লুকিয়ে আছে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। anisalamgir@gmail.com

এইচআর/এএসএম