একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে এ রায় প্রকাশ পায়। রায় ঘোষণার প্রায় এক বছর তিন মাস পরে সাঈদীর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হলো। এর আগে রায়ে মোট ৬১৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেন সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিরা। রায়টি বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে ৫ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আপিল বিভাগের বিশেষ বেঞ্চে এই রায় ঘোষণা করা হয়। বেঞ্চের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন বিচারপতি (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা, বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মতে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের করা দুটি আপিল আংশিক মঞ্জুর করে এই রায় দেয়া হয়। রায় ঘাষণার দিন সকাল ১০টা ৫ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। চার মিনিটের মধ্যে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন রায় পাঠ শেষ করেন। রায়ে ১০, ১৬ ও ১৯ নম্বর অভিযোগে সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আপিল বিভাগ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ৬, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়। একই সঙ্গে ৮ নম্বর অভিযোগের অংশবিশেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে সাঈদীকে খালাস এবং এ অভিযোগের অংশবিশেষে তাকে ১২ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেয় হয়। এছাড়াও সংখ্যাগরিষ্ঠ মতে ৭ নম্বর অভিযোগে তাকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়।এর আগে ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল সাঈদীর মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের শুনানি শেষে রায় (সিএভি) রাখেন আপিল বিভাগ। এর আগে মৃত্যুদণ্ডের রায়ে আনা আপিল আবেদনের ওপর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ মোট ৫০ কার্যদিবস শুনানি করেন।মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর দ্বিতীয় মামলায় আপিলের রায় ছিল এটি। সাঈদীর পক্ষে আপিলে শুনানিতে যুক্তি পেশ করেন অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহাবুব হোসেন ও এসএম শাহজাহান। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি উপস্থাপন করেন শেষ করেন। তাকে সহযোগিতা করেন অতিরিক্ত অ্যার্টনি জেনারেল ও ট্রাইব্যুনালের সমন্বয়ক এমকে রহমান, ট্রাইব্যুনালে এ মামলার প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের বিষয়ে গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট এএসএম শাহজাহান যুক্তি উপস্থাপন করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এরপর শুরু হয় উভয়পক্ষের যুক্তি খণ্ডন পর্ব যা ১৬ এপ্রিল শেষ হয়।২০১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন করেছিল ট্রাইব্যুনাল। এরমধ্যে ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং ১২টিতে তাকে খালাস দেয়া হয়। প্রমাণিত ৮টি অভিযোগ হচ্ছে ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১৪, ১৬ এবং ১৯। এর মধ্যে ৮ এবং ১০ নং অভিযোগে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ইব্রাহিম কুট্টি হত্যা ও বিশাবালী হত্যার অভিযোগ। দুইটি অভিযোগে সর্বোচ্চ সাজা হওয়ায় প্রমাণিত অপর ছয় অভিযোগে সাজা প্রয়োজন নেই বলে ট্রাইব্যুনাল রায়ে উল্লেখ করে। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত ৮ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ৭১’ সালের ৮ মে বেলা ৩টায় সাঈদীর নেতৃত্বে তার সহযোগীরা পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় সদর থানার চিতলিয়া গ্রামের মানিক পসারির বাড়িতে হানা দিয়ে তার ভাই মফিজ উদ্দিন পসারী এবং ইব্রাহিম কুট্টিসহ দুই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে পাঁচটি বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে পাড়েরহাট সেনা ক্যাম্পে নেয়ার পথে সাঈদীর প্ররোচণায় ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে লাশ স্থানীয় একটি ব্রিজের কাছে ফেলে দেয়া হয়। মফিজ পসারীকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়।অভিযোগ-১০ এ বলা হয়েছে, ৭১’ এর ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার হানা দিয়ে ২৫টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব বাড়ির মালিকেরা হলেন- চিত্তরঞ্জন তালুকদার, হরেণ ঠাকুর, অনিল মণ্ডল, বিশাবালী, সুকাবালি, সতিশ বালা প্রমুখ। সাঈদীর ইন্ধনে তার সহযোগীরা বিশাবালীকে তার বাড়ীর নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করে।এ রায়ের বিরুদ্ধে ২৮ মার্চ সাঈদী ও রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক দু’টি আপিল দাখিল করে। যে সব অভিযোগ থেকে সাঈদীকে খালাস দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল সে অভিযোগগুলোতে আপিলে দণ্ডের আর্জি জানায় রাষ্ট্রপক্ষ।এফএইচ/এআরএস/আরআইপি
Advertisement