মতামত

নিয়ে চীনের সেতু, বলার আছে হেতু

৯৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটারের দেশ চীনের ভূমিরূপ বৈচিত্র্যময়। দেশটিতে আছে মরুভূমি, তৃণভূমি, মালভূমি; আছে বিস্তীর্ণ অরণ্য ও পর্বতমালা। চীনের অনুর্বর উত্তরাংশে অরণ্য স্টেপ তৃণভূমি এবং গোবি ও তাকলামাকান মরুভূমি যেমন আছে, তেমনি এর আর্দ্র দক্ষিণাংশে আছে উপক্রান্তীয় অরণ্যসমূহ। চীনে আছে ছোট-বড় দেড় হাজারের বেশি নদ-নদী। বিশ্বের তৃতীয় দীর্ঘতম নদী ইয়াংজি (৬৩০০ কিলোমিটার) ও ষষ্ঠ দীর্ঘতম ‘হলুদ নদী’ (৫৪৬৪ কিলোমিটার) চীনের বুকে প্রবাহিত। চীনের আছে অনেক জলাভূমি ও হ্রদ। এহেন বৈচিত্র্যময় চীনে সড়কপথ (৫১ লাখ কিলোমিটার) ও দ্রুতগতির রেলপথের (৩৮ হাজার কিলোমিটার) বিশাল নেটওয়ার্ক থাকার একটি অনিবার্য অর্থ হচ্ছে: এদেশে আছে অসংখ্য ছোট-বড় সেতু। এসব সেতু চীনের যোগাযোগ-ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ।

Advertisement

ইয়াংজি নদীর পলিমাটি হাজার হাজার বছর ধরে চীনের ভূমিকে উর্বর করে এসেছে। আবার, অতীতে এই নদী ছিল চীনা মানুষের যাতায়াতের পথে একটি বড় প্রাকৃতিক বাধা। নদী পারাপার ছিল কঠিন ও আয়াসসাধ্য কাজ। তাই প্রাচীনকালেই এই নদীর উপর সেতু নির্মাণ করার আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল চীনা মানুষের মনে। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। এমনকি, আধুনিক যুগে এসেও, ইয়াংজি নদীর মধ্য ও নিম্ন অববাহিকায় সেতু নির্মাণ করা যথেষ্ট কঠিন কাজ ছিল। কারণ, এই নদী অনেক গভীর ও প্রশস্ত। বিংশ শতাব্দির প্রথম পাঁচ দশকে চার বার ইয়াংজি নদীর উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেসব প্রচেষ্টা সফল হয়নি। কারণ, এমন বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রযুক্তি তখন চীনা জাতির ছিল না।

চীনা জাতি ইয়াংজি নদীর উপর সেতু নির্মাণে সক্ষম হয় নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর, তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে। উহান ইয়াংজি সেতু (Wuhan Yangtze River Bridge) এই নদীর উপর নির্মিত প্রথম সেতু। নয়াচীনে এটি ছিল একটি মাইলফলক-প্রকল্প। এর পর চীনারা নির্মাণ করে নানচিং ইয়াংজি সেতু। এটি নির্মাণে চীনারা তাদের সকল শক্তি ও সম্পদ কাজে লাগায়। এই সেতু চীনাদের গর্ব। কারণ, এর নকশা ও কাঁচামাল ছিল চীনের নিজস্ব এবং এর নির্মাণকাজেও চীনারা অন্য কোনো দেশের সাহায্য গ্রহণ করেনি।

ইয়াংজি নদীর উপর নির্মিত প্রথম দুটি সেতুতে সড়কপথ ও রেলপথ সংযুক্ত ছিল। এই দুটি সেতু চীনাদের মনে ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। অবশ্য, তত্কালে বিভিন্ন দেশে যেসব বড় বড় সেতু ততদিনে নির্মিত হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোর তুলনায় চীনা সেতুগুলোর স্প্যান বা বিস্তার ছিল যথেষ্ট কম।

Advertisement

বিংশ শতাব্দির শেষ দশকে এসে চীন সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্জন করে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এসময় তাঁরা চিয়াংসু প্রদেশে চিয়াংইন ইয়াংজি সেতু (Jiangyin Yangtze River Bridge) এবং হংকংয়ে সিং মা সেতু (Tsing Ma Bridge) নির্মাণে সক্ষম হয়। এই দুটি ঝুলন্ত (suspension) সেতুরই স্প্যান বা বিস্তার এক হাজার মিটারের বেশি। বিশ্বের শীর্ষ দশটি ঝুলন্ত সেতুর তালিকায় এ দুটি সেতুর স্থান যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম। এখানে উল্লেখ করার মতো তথ্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথম সহস্রাধিক মিটার স্প্যান বা বিস্তারসমৃদ্ধ সেতুটি নির্মাণ করেছিল প্রায় সত্তুর বছর আগেই। সেই সেতুটির নাম জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ।

একবিংশ শতাব্দির শুরু থেকেই সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে চীনে সূচিত হয় এক নতুন যুগের। এক দশকের প্রচেষ্টায় এ খাতে অর্জিত চীনের সাফল্য বিশ্বের নজর কাড়ে। চীন এসময় একের পর এক নির্মাণ করতে থাকে বিভিন্ন কাঠামোর সেতু, যেগুলো নির্মাণে অনেক নতুন প্রযুক্তিও ব্যবহার করা হয়। এসব সেতু নির্মিত হতে থাকে নদী, সাগর, হ্রদের উপরে। আবার কোনো কোনো সেতু বিভিন্ন গিরিসংকটকে, বিভিন্ন সংকীর্ণ খাতকে সংযুক্ত করে।

২০০৮ সালে চীনা প্রকৌশলীরা নির্মাণ করেন তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড ভঙ্গকারী চিয়াংসু সুথং ইয়াংজি সেতু (Jiangsu Sutong Yangtze River Bridge)। এটি লৌহরজ্জু দ্বারা ঝুলন্ত সেতু, যার মূল অংশের স্প্যান বা বিস্তার ১,০৮৮ মিটার। অবশ্য, এর আগে আরও দুটি বিশ্বমানের সেতু নির্মাণ করেন চীনা প্রকৌশলীরা: শাংহাই ইয়াংজি সেতু (Shanghai Yangtze River Bridge), যেটির মূল অংশের স্প্যান বা বিস্তার ৭৩০ মিটার এবং হুপেই আরতুং ইয়াংজি সেতু (Hubei Er’dong Yangtze River Bridge), যেটির মূল অংশের স্প্যান বা বিস্তার ৯২৬ মিটার। ছোংছিং ছাওথিয়ানমেন সেতু (Chongqing Chaotianmen Bridge) আনুষ্ঠানিকভাবে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল। সেতুটির কাঠামো সম্পূর্ণ স্টিলের তৈরি। এর বিস্তার ৫৫২ মিটার। তখন সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় তোরণাকৃতির সেতু (arch bridge) হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ দশটি ঝুলন্ত সেতুর পাঁচটিই চীনে অবস্থিত।

২০১০ সালে চীন বিশ্বে সমুদ্রের উপর দিয়ে দীর্ঘ সেতু নির্মাণের ট্রেন্ড চালু করে। সংস্কার ও উন্মুককরণনীতির ফলে চীনের উপকূলীয় এলাকাগুলো সবার আগে সমৃদ্ধ ও ধনী হয়। সমৃদ্ধি হাতছানি দেয় আরও সমৃদ্ধির। উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর প্রয়োজন হয় আরও সুবিধাজনক ও কার্যকর যাতায়াত-ব্যবস্থার; প্রয়োজন হয় আরও বড় বড় সেতু ও অবকাঠামোর। সমৃদ্ধ এ অঞ্চলগুলো ততোদিনে বড় সেতু ও অবকাঠামো নির্মাণে যথেষ্ট সক্ষমতাও অর্জন করে।

Advertisement

১৯৯২ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র চতুর্দশ জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবেদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়। পরিকল্পনায় শাংহাই মহানগরীর ফুতুং (Pudong) আরও উন্মুক্ত ও উন্নত করার কথা বলা হয়। এর উদ্দেশ্য, শাংহাইকে আন্তর্জাতিক আর্থিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা। এই কৌশলগত পরিকল্পনার আওতায়, শাংহাইয়ের স্থানীয় সরকার শহর, সেতু, ও বন্দর সমন্বয়ের একটি মহা-পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য শাংহাই বন্দর পর্যাপ্ত ছিল না; প্রয়োজন পড়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের। অবশেষে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য শাংহাইয়ের স্থানীয় সরকার বেছে নেয় বড় ইয়াংশান দ্বীপ (Big Yangshan Island) ও ছোট ইয়াংশান দ্বীপকে। দ্বীপদুটির অবস্থান শাংহাই থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে, চেচিয়াং প্রদেশের হাংচৌ উপসাগরে। ফলে এই প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরকে শাংহাইয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করতে প্রয়োজন হয় একটি সমুদ্র-সেতুর। এ প্রয়োজন পূরণেই চীনা প্রকৌশলীরা নির্মাণ করেন পূর্ব চীন সাগর সেতু (East China Sea Bridge)। এটি সাগরের উপর নির্মিত চীনের প্রথম সেতু।

চৌশান দ্বীপপুঞ্জ (Zhoushan Islands) হচ্ছে চীনের সবচেয়ে বড় দ্বীপপুঞ্জ। অনুন্নত সড়ক-যোগাযোব্যবস্থার কারণে এই দ্বীপগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন-প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৯৯ সালে, সরকার সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোর সঙ্গে পাঁচটি সমুদ্র-সেতুকে (cross-sea bridge) সংযুক্ত করার মাধ্যমে ‘মূলভূমির সঙ্গে দ্বীপপুঞ্জের সংযোগ’ বাস্তবায়নের প্রকল্প হাতে নেয়। এই পাঁচটি সেতু হচ্ছে: চিনথাং সেতু (Jintang Bridge), সিহৌমেন সেতু (Xihoumen Bridge), থাওইয়াওমেন সেতু (Taoyaomen Bridge), সিয়াংচিয়াওমেন সেতু (Xiangjiaomen Bridge), এবং ছেনকাং সেতু (Cengang Bridge)। এসব সেতুর মধ্যে চৌশান সিহৌমেন সেতুটি চালু হয় ২০০৯ সালে। এই সেতুর মূল অংশের স্প্যান বা বিস্তার ১৬৫০ মিটার। এটি তখন চীনের এক নম্বর ও বিশ্বের দুই নম্বর ঝুলন্ত সেতুর স্বীকৃতি পায় (তখন বিশ্বের এক নম্বর ঝুলন্ত সেতু ছিল জাপানে)। সিহৌমেন সেতুটি এর চমত্কার কাঠামো, নান্দনিক মূল্য, ও পরিবেশবান্ধবতার জন্য আন্তর্জাতিক সেতু সম্মেলন (আইবিসি)-র ‘গুস্তাভ লিন্ডেনথাল পুরস্কার (Gustav Lindenthal Prize) লাভ করে। পাঁচ বছর পর সেতুটি ‘অসাধারণ প্রকল্প’ হিসেবে এফআইডিআইসি (FIDIC)-র স্বীকৃতি লাভ করে। এই স্বীকৃতিকে ‘স্থাপত্যশিল্পের নোবেল’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

ছিয়ানথাং (Qiantang) নদীর জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ার-প্লাবন (tidal bore)-এর জন্য হাংচৌ উপসাগর (Hangzhou Bay) বিখ্যাত। এখানে পর্যটকদের আসা-যাওয়া সহজতর করতে নির্মাণ করা হয় হাংচৌ উপসাগর সেতু (Hangzhou Bay Bridge)। সেতুটি শাংহাইয়ের সঙ্গে নিংপোর সড়কপথে দূরত্ব এক শ কিলোমিটার কমিয়ে দেয়। ১১৮০ কোটি ইউয়ান ব্যয়ে নির্মিত ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ হাংচৌ উপসাগর সেতু ছিল তৎকালের দীর্ঘতম সমুদ্র-সেতু। সেতুটি চেচিয়াং প্রদেশের চৌশান, থাইচৌ, ও ওয়েনচৌ এলাকাকেও শাংহাইয়ের আরও কাছাকাছি এনে দেয়।

হাংচৌ উপসাগরের আবহাওয়া বরাবরই জটিল ও কঠিন। এর উপর সেতু নির্মাণ সহজ কাজ ছিল না। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে, বছরে কমবেশি মাত্র ১৮০ দিন সেতুর কাজ করা যেতো। হাংচৌ উপসাগরে পানির তোড় সেকেন্ডে পাঁচ মিটার। এখানে ঢেউয়ের উচ্চতা কখনও কখনও হয় ৭ মিটারের বেশি। ফলে, হাংচৌ উপসাগরে নির্মিত যে-কোনো সেতুর ওপর স্বাভাবিকভাবে পড়বে প্রচণ্ড চাপ। সাথে আছে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির নেতিবাচক দিক। হাংচৌ উপসাগর সেতু নির্মাণের সময় এমন অনেক সমস্যার কথা বিবেচনায় রাখতে হয়েছে এবং সেগুলোর যথাযথ সমাধান খুঁজে বের করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের। এই সেতুটি নির্মাণ করে চীনা প্রকৌশলীরা বুঝিয়ে দেন যে, তাঁরা সমুদ্রের উপর বিশালাকৃতির সেতু নির্মাণের প্রযুক্তি আয়ত্ব করেছেন।

২০১১ সালে নির্মিত হয় চিয়াওচৌ উপসাগর সমুদ্র-সেতু (Jiaozhou Bay Cross-sea Bridge)। এটি নির্মাণ করা হয় ছিংতাও শহরের যান চলাচল সহজতর করতে ও হুয়াংতাও দ্বীপের ছিয়ানওয়ান কনটেইনার পোর্ট-এ মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটার। ফলে, এটি তখন চীন ও বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র-সেতু হিসেবে স্বীকৃতি পায়; পেছনে পড়ে যায় হাংচৌ উপসাগর সমুদ্র-সেতু।

রেকর্ড গড়া ও ভাঙার এই ধারা চলতে থাকে। একসময় চীনা প্রকৌশলীরা তৈরি করেন হংকং-চুহাই-ম্যাকাও সেতু (Hong Kong-Zhuhai-Macao Bridge)। সেতুটি চীনের হংকং, চুহাই ও ম্যাকাও-কে সংযুক্ত করেছে। হংকংয়ের ভূমি ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ম্যাকাওয়ের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য হংকং ও চুহাইয়ের সঙ্গে এর সংযুক্তির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। চুহাই-ও হংকং ও ম্যাকাওয়ের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার তাগিদ অনুভব করছিল। এ প্রেক্ষাপটেই হংকং-চুহাই-ম্যাকাও সেতুর মতো সুপার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

হংকং-চুহাই-ম্যাকাও সেতু পাঁচটি বিমানবন্দর ও তিনটি বন্দরকে সংযুক্ত করেছে। এ সেতু-প্রকল্প কুয়াংতুং, হংকং ও ম্যাকাওকে নিয়ে ‘বৃহত্তর উপসাগর’ এলাকা গড়ে তুলতেও সাহায্য করেছে। নামে ‘সেতু’ হলেও, এটি ছিল একটি বিশাল প্রকল্প, যার তিনটি অংশ। অংশ তিনটি হচ্ছে: টানেলসমৃদ্ধ সমুদ্র-সেতু; হংকং, চুহাই ও ম্যাকাওয়ে তিনটি কৃত্রিম দ্বীপ-বন্দর; এবং এই তিনটি শহরে প্রয়োজনীয় সহায়ক-সড়ক। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৫৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে আছে ৬.৭ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ (সাবমেরিন টানেল)।

হংকং-চুহাই-ম্যাকাও সেতুর সাবমেরিন টানেলটি বিশ্বের দীর্ঘতম সাবমেরিন টানেল। এই টানেলকে ‘টিউব টানেল’-ও বলা যায়। বস্তুত, সমুদ্রের তলদেশে অসংখ্য কংক্রিটের তৈরি বিশালাকৃতির পাইপ একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া লাগিয়ে এই টানেল তৈরি করা হয়। একেকটা পাইপের আয়তন একেকটা টেনিস কোর্টের সমান হবে। একেকটা পাইপ ১৮০ মিটার লম্বা। একেকটা পাইপের ওজন প্রায় ৪০ হাজার টন করে। এহেন বিশালাকৃতির পাইপ একটার সঙ্গে আরেকটা জোড়া লাগানো চাট্টিখানি কথা নয়। ছয় লেনের সড়কসম্বলিত এসব পাইপ সমুদ্রের ৪০ মিটার গভীরে নিয়ে যাওয়াও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। পাইপগুলোকে তৈরিও করা হয়েছে এমনভাবে যে, এগুলো টিকে থাকবে অন্তত ১২০ বছর।

হংকং-চুহাই-ম্যাকাও সেতু নির্মাণ ছিল চীনের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেতুর যে-অংশটুকু সমুদ্রের উপরে আছে, সেটুকু নির্মাণ যেমন ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ; তেমনি সংশ্লিষ্ট তিনটি কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণও কম ঝক্কির কাজ ছিল না। তবে, সেতুর অংশ হিসেবে সাবমেরিন টানেল নির্মাণ বোধকরি সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। টানেল তৈরির সময় অনেক ঘটন-অঘটনের জন্ম হয়, যেগুলোর কোনো-কোনোটি ছিল সত্যিকার অর্থেই মাথা চক্কর দেওয়ার মতো। কিন্তু, শেষপর্যন্ত, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হয়।

আগেই বলেছি, চীনারা সেতু নির্মাণ করে আসছে প্রাচীন আমল থেকেই। প্রাচীন চীনে নির্মিত সেতুগুলোকে আধুনিক সেতুগুলোর আদিরূপ বলা যেতে পারে। প্রাচীন আমলে চীনে নির্মিত ধনুকাকৃতির পাথরের সেতুগুলো বিশ্ব-বিখ্যাত। তবে, চীনের আজকালকার প্রকৌশলীরা বিশাল সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁদের পূর্বসূরিদের পেছনে ফেলেছেন বেশ ভালো ব্যবধানেই। এখন ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগের আওতায়, চীনের সেতু-প্রযুক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে; চীন আরও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলতে এ খাতেও রাখছে অবদান।

চীনের সেতুর ওপর বিস্তারিত জানতে আগ্রহীরা অপেক্ষা করুন ‘নয়াচীনের সাফল্যের মুকুটে সাতটি পালক’ শীর্ষক বইটি খুব শিগগিরি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। –লেখকলেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com

এইচআর/জেআইএম