শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে তলিয়ে গেছে ঢাকার দুই সিটির ময়লা ব্যবস্থাপনা ও ময়লার গাড়ির ডাকাতি কাণ্ডকারখানা। ময়লার গাড়ি চাপায় পরপর কয়েকটি প্রাণনাশের ঘটনায় সামনে এসেছিল বিষয়টি। সিটির দুই করপোরেশনে একটু নড়াচড়া শুরু হয়। সেই সঙ্গে অপকর্মের স্বীকারোক্তিসহ কিছু ওয়াদাও ঘুরছিল। নানা ঘটনা ও ইস্যুতে বাঁক ঘুরে গেছে। ময়লা ও ময়লার গাড়ি নিয়ে যা চলছিল তাই চলছে নির্ভয়ে। হাফ ভাড়ার আন্দোলনের সুযোগে হাঁফ ছেড়ে রীতিমতো পৌষ মাস তাদের।
Advertisement
অল্প সময়ের ব্যবধানে নটর ডেমের শিক্ষার্থী নাঈম বা সংবাদকর্মী আহসানের মৃত্যু না হলে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলোর বেপরোয়া কাণ্ড হয়তো আলোচনায়ই আসতো না। অনেকের জানাও হতো না কী বিশ্রি-হাস্যকর-অমানবিক ব্যবস্থাপনায় চলছে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িগুলো। এসব ময়লার গাড়ি চাপায় আদম সন্তানের প্রাণনাশের হানির তালিকা ছোট নয়। গত ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মারা যায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় জানা যায় পেশাদার কোনো ড্রাইভার গাড়িটি চালাননি। ওই সময় গাড়িটির স্টিয়ারিংয়ে ছিলেন সুইপার রাসেল।
তবে হারুন নামের একজন ড্রাইভার অ্যানলিস্ট আছেন গাড়িটিতে। তিনি খেয়েদেয়ে বিজি থাকেন অন্য কাজে। পরদিন ২৫ নভেম্বর পান্থপথে ঢাকা উত্তরের যে ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় সংবাদকর্মী আহসান কবীর খান নিহত হন সেখানেও প্রায় একই কায়কারবার। এর আগে গত মার্চে ডিএসসিসির একই ধরনের গাড়ির চাপায় মর্মান্তিক মৃত্যু হয় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন অপারেটর মোহাম্মদ খালিদের। পরের মাসে যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা এলাকায় মারা যান রিকশাচালক মোস্তফা। গত ৩ মে শাহজাহানপুরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চাপায় মারা যান বাংলাদেশ ব্যাংকের কেয়ারটেকার স্বপন আহামেদ দীপু।
পিয়ন, সুইপার দিয়ে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চালানোর কাণ্ডকারখানা অনেক দিনের। দৈনিক মজুরিতে নামকাওয়াস্তের কিছু ড্রাইভারও পোষা হয়। এরা মোটেই দক্ষ বা পেশাদার ড্রাইভার নন। অথচ কেবল হালকা বা মাঝারি নয়, ভারী গাড়িও চালানো হচ্ছে তাদের দিয়ে। অনেকের কোনো বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্সও নেই। তাদের নিয়মিত বেতনও নেই। প্রতিদিন তেল চুরি, ময়লার পরিমাণ ও ট্রিপের হিসাবে নয়-ছয়ে ভালো আয় তাদের। কারও কারও লাইসেন্স থাকলেও তারা গাড়ি চালান না। অন্যজনকে ময়লা টানার ভার দিয়ে তারা নিজেরা ব্যস্ত নানান কাজে। সেখানেও টাকা ভাগ-বাটোয়ারার ক্রিয়াকর্ম।
Advertisement
সানান্যতম দায়, নিয়মনীতির অবশিষ্টও নেই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি ব্যবস্থাপনায়। চলে আসছে এভাবেই। ঘটনাচক্রে এবার বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। মেয়রসহ নগর কর্তৃপক্ষ ঘাতক চালকের বিচার ও এ খাতে শৃঙ্খলা আনার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি এতো সহজ? আসল সমস্যা জিইয়ে রেখে কীভাবে সম্ভব এর সমাধান?
অবৈধ ড্রাইভার বা সুইপার-পিয়ন দিয়ে গাড়ি চালানোর মতো অপকর্ম যেখানে অবলীলায় চলছে সেখানে কী বিহিত বা বিচার হতে পারে? সিটি করপোরেশন এ দায় এড়াতে পারে? বরং এ সংক্রান্ত উপরি কামাই-রোজগারে সিটি করপোরেশনের অনেকে জড়িত। পরিবহনের তেল চুরির অংকও কম নয়। ময়লা সংক্রান্ত এই রোজগারের ভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও পান। এরা বিচারের বাইরে থাকবেন?
মযলার গাড়ি ও ড্রাইভার সংকট লুকানোর বিষয় নয়। পাশাপাশি সংস্থা দুটির ৮০ ভাগ যানবাহনের ফিটনেস সনদও নেই। এক হিসাবে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব গাড়ি রয়েছে ৫৯১টি। বিপরীতে ড্রাইভার ২২৫ জন। এর মধ্যে ভারী যানবাহন রয়েছে ৩৩৭টি। এগুলোর জন্য ড্রাইভার ১১০ জন। এর মধ্যে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ২৬ জন। বাকিগুলো চালানোর ভার সিটি করপোরেশনের সুইপার, পিয়ন ও মশককর্মীদের হাতে। ঢাকা উত্তর সিটিতেও একই দশা। তাদের বর্জ্যবাহী ভারী যানবাহন রয়েছে ১৩৭টি। বিপরীতে ড্রাইভার মাত্র ৪১ জন। তাদের ২৫ জনই দৈনিক মজুরিভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। ঢাকার দুই সিটিতে এই কিছিমের ড্রাইভারদের ক্ষমতা ব্যাপক। বেশ দাপটশালী তারা। দুটি সংগঠন রয়েছে তাদের। ড্রাইভার্স ইউনিয়ন নামে সংগঠন দুটিরই বিশাল কমিটি। তাদের নেতারা কবে যে গাড়ি চালিয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। প্রভাব খাটিয়ে ভাড়াটে চালক দিয়েই নিজের নামের গাড়িগুলো চালান তারা। সামগ্রিক এই বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার অনিবার্যতায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। সেই সঙ্গে রাজধানীর বাসা-বাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ নিয়ে কোটি টাকার ধরিবাজি বাণিজ্যও পোক্ত হচ্ছে। যেসব ছিন্নমূল মানুষ ব্যক্তিগতভাবে ময়লা সংগ্রহ করে জীবন চালাতো তাদের খেদিয়ে বাণিজ্যটা চলে গেছে পাড়া-মহল্লার ক্ষমতাবান-প্রভাবশালীদের কব্জায়। ময়লার গাড়ি চালানোর মতো ময়লা সংগ্রহেও আরেক অরাজকতা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
Advertisement
এইচআর/এমএস