শেখ ফজলুল হক মণি (১৯৩৯-১৯৭৫) এমনই এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যিনি নেতৃত্ব গুণাবলি, রাজনৈতিক দৃঢ়তা, মননশীল প্রতিভা দিয়ে স্বমহিমায় ভাস্কর। তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ, সৃজনশীল যুব সংগঠক, তেজোদীপ্ত সাংবাদিক ও লেখক। এক কথায় বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী।
Advertisement
শেখ ফজলুল হক মণি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি সমাজ ও রাষ্ট্র বদলের অঙ্গীকারে মতাদর্শিক আদর্শ নিয়ে আওয়ামী রাজনীতিতে শোষণ-বৈষম্যমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি সংযোজনে অবদান রাখেন।
প্রাচীন গ্রীকদর্শনে জ্ঞানের আদি গুরু সক্রেটিসের শিষ্য ছিলেন প্লেটো। গুরু সক্রেটিসের চিন্তা, চেতনা ও দর্শনকে বাস্তবে রূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন প্লেটো। ঠিক তেমনি বাঙালি জাতির মহান শিক্ষক ও দার্শনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা, চেতনা, কর্ম, জীবনদর্শন ও রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠেন শেখ মণি।
বঙ্গবন্ধুর আপন ভাগ্নে শেখ মণি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী একনিষ্ঠ ধারক ও বাহক। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও রাষ্ট্রদর্শনের মূলে ছিল- বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। শেখ ফজলুল হক মণি’র জীবনদর্শন ও রাষ্ট্রদর্শনের মূলেও এই ৪টি মৌলিক নীতি বা আদর্শ ছিলো।
Advertisement
তার শোষণমুক্ত, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত চেতনা, ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে মানবতার জয়গান এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে সাহস ও অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি,স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের কঠিন ধাপগুলোর কিছু ব্যাখ্যা এই বইতে পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের ২০২, ২০৯, ২১০, ২১৩, ২২৩, ২৩৫, ২৪০, ২৮১, ২৪৮, এবং ২৬৩ নং পৃষ্ঠায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ছাত্র নেতৃত্ব দিতে গিয়ে, স্বাধিকার আন্দোলন সংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণে শেখ মণিকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়তে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কারাভোগ করতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ধারাবাহিকভাবে কারাজীবনের কথা তুলে ধরা হয় সেখানে দুটি খাতা ছিলো। প্রথম খাতাটা ১৯৬৬ সালে লেখা আর দ্বিতীয় খাতাটা ১৯৬৭ সালে। দ্বিতীয় খাতায় কারাগারের জীবনযাপন, ব্যক্তিগত ভাবনা, পারিবারিক কথা ছাড়াও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক কথাই এ খাতায় লিখেছেন।
কারাবাসের নির্মম জীবনকথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন: “ন্যাপের হালিম, ভাগ্নে মণি পুরানা হাজত থেকে তারা এসেছে। এক জেলে থাকি আমার ভাগ্নে আমার সাথে দেখা করতে পারে না। কি বিচার!” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ.২০২)। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বেগম মুজিব, শেখ রেহেনা ও শেখ রাসেল জেল গেটে জন্মদিনের কেক আর ফুল নিয়ে যায়।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু বলেন, “রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সাথে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২১০)।
শেখ ফজলুল হক মণি ’র রাজনৈতিক দর্শন বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক জীবনের যে অনন্য বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে তা হলো অসীম সাহসিকতা ও দেশপ্রেম। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ দেখতে পাই ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের কাছ থেকে সনদ নেওয়ার অস্বীকৃতি জানান তিনি।
সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। অসীম সাহস আর দেশপ্রেম না থাকলে এ ধরনের আন্দোলন সম্ভব নয়। শেখ মণি ১৯৬০-১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, ষাটের দশকে সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি সাহসী নেতৃত্ব দেন।
১৯৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমান কমিশনের বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুথান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে কর্মসূচী প্রণয়ন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স তথা মুজিব বাহিনী গঠন, সর্বোপরি বাঙালির প্রত্যেকটি স্বাধিকার আন্দোলন সংগ্রামে শেখ মণি তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।
শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্ভাসিত বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শেখ মণি একাধারে ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক, প্রাবন্ধিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক।
১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারি তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকাতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি বিনোদন ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক সিনেমা’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তার সম্পাদনায় দৈনিক ইংরেজী পত্রিকা ‘বাংলাদেশ টাইমস’ প্রকাশিত হয়।
তৎকালীন সময়ে তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দি পিপলস’ও ‘দৈনিক বাংলার বাণী’তে নিয়মিত কলাম লিখতেন। কলামগুলোতে অত্যন্ত সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় তার নিজস্ব অভিমত, চিন্তা, চেতনা প্রকাশ করতেন। তিনি বাংলার বাণীতে ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ নামে কলাম লিখতেন। মৃত্যুপরবর্তী সময়ে তার লেখা কলামগুলোকে সংগ্রহ করে আগামী প্রকাশনী প্রকাশ করেছে ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ নামক গ্রন্থ, যাতে সম্পাদনা করেছেন ফকীর আবদুর রাজ্জাক ও বিমল কর।
সৃজনশীল লেখক শেখ মনি রচিত গল্পের সংকলন ‘বৃত্ত’ ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তার লেখা উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিতা’ পাঠক সমাদৃত। ১৯৭২ সালে ‘গীতারায়’ নামক গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যা ২০২০ সালে তৃতীয় মুদ্রণ বের হয়েছে। ‘গীতারায়’ গল্পগ্রন্থে মোট ৬টি গল্প আছে। গল্পগুলোর শিরোনাম হচ্ছে- বৃত্ত, ব্যর্থ, জাত, অবাঞ্ছিতা, হোঁচট এবং গীতারায়।
শেখ মণি’র জীবনদর্শনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিলো প্রখর দূরদর্শিতাসম্পন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। (১৯৩৯-১৯৭৫) মাত্র ৩৫ বছর বয়সের জীবনে তার চিন্তা চেতনার প্রখরতা ছিলো খুবই গভীর ও দার্শনিকতাপূর্ণ। তিনি বলেন- “রাজনৈতিক যুদ্ধে আমাদের পরাজিত করতে পারে এমন শক্তি বাংলাদেশে সহজেই জন্মাবে না। কিন্তু আমাদের সমাজনীতি, অর্থনীতি যদি ব্যর্থ হয়ে যায় তাহলে রাজনীতিটাই টিকবে না”।
কলামিস্ট শেখ মণি অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন লেখক ছিলেন। তিনি তার লেখায় সদ্য স্বাধীন দেশে যে আংশকা ও সংকটগুলো বিশ্লেষণ করেছিলেন। পচাত্তর পরবর্তী সময়ে অনেক বিষয়ের প্রতিফলন ঘটেছে। যার কারণে তার লেখাগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৪টি মূলনীতিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অস্থির যুবসমাজকে সৃজনশীল ও মননশীল চর্চায় আত্মনিয়োগের মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষার সম্প্রসারণ, অসাম্প্রদায়িক ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি যুবলীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ দেশে যুবরাজনীতির নবদিগন্তের সূচনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক শেখ মণি বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের সব শ্রেণি ও পেশার যুবকদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদেরকে রাজনৈতিক শিষ্টাচারে প্রশিক্ষিত করেন। বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে যুবসমাজকে আত্মনিয়োগ করিয়ে এ দেশের যুবসমাজের আইকনে পরিণত হন তিনি, হয়ে ওঠেন যুবরাজনীতির অনুপ্রেরণার উৎস।
শেষ করবো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি উক্তি দিয়ে- “আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে।” সত্যিই তিনি নিজেকে ভুলতে দেননি তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে। ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু থাকে কিন্তু যথার্থ কর্ম, চিন্তা, দর্শন ও আদর্শের মৃত্যু নেই।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরজ্ঞীব, তার আদর্শ ও চেতনা অবিনশ্বর। বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশে ছাত্র-যুবক-তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করে অসাম্প্রদায়িক আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ নির্মাণের দায়িত্ব দেন শেখ মণিকে।
ইতিহাসের পরিক্রমায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে বঙ্গবন্ধু তনয়া, মানবতার জননী, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে শেখ ফজলুল হক মণির জ্যেষ্ঠ পুত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক, মননশীল পরিমার্জিত যুবসংগঠক শেখ ফজলে শামস্ পরশকে যুবলীগের দায়িত্ব প্রদান করেন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলার যুব রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মণির দেখানো স্বপ্নকে ধারণ করে মেধা ও তারুণ্যদ্বীপ্ত, প্রতিশ্রুতিশীল, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও সাবেক ছাত্র সংগঠকদের সমন্বয়ে এক অনন্য যুবলীগ এগিয়ে যাচ্ছে।
৪ ডিসেম্বর তরুণ প্রজন্মের অন্তহীন প্রেরণার উৎস, যুব আন্দোলনের পথিকৃৎ, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সারথি শেখ ফজলুল হক মণি র জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা।
রূপকল্প ২০৪১ উন্নত বাংলাদেশ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী দক্ষ যুবসমাজ গঠনের মাধ্যমে জাতির পিতার অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তুলবো- শেখ ফজলুল হক মণি’র জন্মবার্ষিকীতে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
জেএমএস/এমএস