ডা. সেলিনা সুলতানা
Advertisement
৩ ডিসেম্বর, ৩০ তম আন্তর্জাতিক ও ২৩ তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হল এমন একটি দিন, যেখানে প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে, প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তিদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জনসচেতনতা তৈরি করতে, প্রতিবন্ধকতা বুঝতে চেষ্টা করতে, সমাজে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে এ দিবসটি পালন করা হয়। তাদের কৃতিত্ব ও অবদান উদযাপন করাই এর লক্ষ্য।
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস, জাতিসংঘ পালিত দিবস, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়। প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তির জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার এটিই একটি সুযোগ। প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তিও যে স্কুল, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী, ব্যবসা বা সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, বিভিন্ন উপায়ে যুক্ত হতে পারেন ও সমাজে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রচার করতে পারেন তার জন্য এই দিনটি। প্রতি বছর জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস পালনের জন্য একটি থিম ঘোষণা করে।
বার্ষিক থিমটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য শারীরিক, মানসিক প্রযুক্তিগত এবং মনোভাবগত বাধাগুলো অপসারণ করে সমাজে কীভাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রচেষ্টা করতে পারে তার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এটি ১৯৯২ সাল থেকে শুরু হয়েছে যখন সাধারণ পরিষদ ৩ ডিসেম্বরকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছিল। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ২০২১-এর থিম হল ‘কোভিড-১৯-পরবর্তী একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অ্যাক্সেসযোগ্য এবং টেকসই বিশ্বে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণ’।
Advertisement
প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সচেতনতার প্রসার ঘটাতে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মর্যাদা সমুন্নতকরণ, অধিকার সুরক্ষা ও উন্নতি সাধন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছরের মতো এবারও এ দিবসটি পালন করা হবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে। এ দিবসটি উদযাপন করতে এবার প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে উত্সাহিত করতে বলা হয়েছে। সবার সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকেও ইতিহাস এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করতে বলা হয়েছে। তাদের করা কাজগুলো আরো অন্তর্ভুক্ত এবং অ্যাক্সেসযোগ্য হতে পারে এমন উপায়গুলো সম্পর্কে চিন্তা করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
অনেক সময় শিশুরা স্কুলে কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। যেসব শিশুরা ইনক্লুসিভ শিক্ষাব্যবস্থায় অধ্যায়নরত, তাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বা গাড়িতে উঠতে কষ্ট হয়। তখন তাদের সাহায্যকারীর প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে ঠিকমতো সচেতনতা বাড়াতে পারলে শিশুদের সহপাঠীরাও সমমর্মিতা দেখাবে ও তাদেরকে সাহায্য করবে। সহপাঠী ও সহকর্মীদের সাথে মজার কার্যকলাপ, শিক্ষামূলক প্রশ্নোত্তর ও গল্প করাও সম্ভব বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বা ব্যক্তিদের। সহপাঠীরা ভালোবেসে ব্যাগ বহন করতে সাহায্য করবে এবং সবসময় পাশে থাকবে। শিক্ষকরাও তাদের চাহিদা মত বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ করে ও কাজ শুরু করবে। শিশুকে পরামর্শ সেবা, স্বাস্থ্য এবং সদয় সহায়তা প্রদান করবে। স্পিচ থেরাপি সেশন, কথা বলতে, পড়াশোনায় দক্ষতা অর্জনে শিক্ষক ও সহপাঠীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যদি তারা পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে। যাদের অডিও, ভিজ্যুয়াল সমস্যা থাকে, তাদের উন্নতির জন্য চেষ্টা করা হয়, মোটর অক্ষমতায় ভুগছে যেসব শিশু, তাদের হাঁটার সহায়তার জন্য ডিভাইস থাকে, তাদেরকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করা হয়।
তাদের কার্যকলাপের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করলে তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মনে রাখা প্রয়োজন প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত শিশুরা তাদের বৃদ্ধিতে সব সময়ই চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে চায় এবং হাল ছেড়ে দিতে চায় না। তাই আমাদেরকে উৎসাহের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে সবসময়। অন্যদিকে গণপরিবহন ব্যবস্থা এখনো প্রতিবন্ধী শিশু বা ব্যক্তিবান্ধব নয়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈষম্য, যার জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেখানে সবার গ্রহণযোগ্যতা থাকবে।
সবারই সচেতন হওয়ার সময় হয়েছে এখন। প্রতিবন্ধী মানুষের স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো ১৯৯৯ সালে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। তারপর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রথম "বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী আইন" প্রবর্তন করা হয়। দেশে প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন- ২০১৩, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন- ২০১৩, বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন- ২০১৮ এবং প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা, ২০১৯ প্রণয়ন করেছে। এ সকল আইন ও বিধি-বিধানের আলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মৌলিক চাহিদাপূরণ, ক্ষমতায়ন এবং দেশের অন্যান্য জনগণের ন্যায় সমঅধিকার নিশ্চিতকরণে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।
Advertisement
প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, সম্পদ। এরাও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে পারে, তাই অবহেলা করা যাবে না। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, সেবা, চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সহায়ক উপকরণ পেলে প্রতিবন্ধীরাও সামাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম। প্রতিবন্ধীদের বিশেষ চাহিদাপূরণে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের সব পেশার মানুষকে আন্তরিক হতে হবে তাদের প্রতি। তবেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করা সম্ভব হবে।
লেখক : কনসালটেন্ট: নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এন্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ: ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল।
এইচআর/জিকেএস