বিশেষ প্রতিবেদন

শ্বশুরের দেওয়া ৪০ হাজার থেকে ২০ লাখ টাকার মালিক রাণী

হাফিজা আক্তার রাণী। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার একজন সফল উদ্যোক্তা। ময়মনসিংহ সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ছোটবেলা থেকে নতুন কিছু করার আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বড় হওয়া রানী কখনো সরকারি চাকরির পেছনে ছোটেননি। বরং কীভাবে অবহেলিত নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করা যায় সে চিন্তাই করেছেন সবসময়।

Advertisement

এক পর্যায়ে উদ্যমী এ নারী শ্বশুরের দেওয়া ৪০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এখন তিনি ২০ লাখ টাকার মালিক। এ সফল উদ্যোক্তার নিজের পাঁচটি শো রুম রয়েছে। এর মধ্যে একটি মুক্তাগাছায়, বাকিগুলো ময়মনসিংহ শহরে। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি বেকার নারীদের কীভাবে স্বাবলম্বী করা যায়, সে বিষয়ে কর্মমগ্ন তিনি। হাতের কাছে যেসব কাঁচামাল আছে তা ব্যবহার করে কীভাবে আয় করা যায়, এ নিয়েও বেকার নারীদের নানামুখী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন রাণী। শাড়ি, থ্রি-পিস, মশারি, কাপড়ের জুতা, সুপারির খোল দিয়ে তৈরি বাটি, গরুর শিং দিয়ে তৈরি কলমদানি, ফেলে দেওয়া পেপার থেকে নোট বুক, পাটের নানা পণ্য বিক্রি করেন তিনি। এছাড়া হারবাল তেল, মেয়েদের প্রসাধনী, বাঁশ দিয়ে তৈরি গৃহস্থালি সরঞ্জামও বিক্রি করেন রাণী। তার উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নেন ময়মনসিংহের নার্গিস জামান নামের আরেক নারী। এখন সেই নারী নিজের হাতে তৈরি নকশা ব্লাউজ বিক্রি করে মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করেন। এভাবে রাণীর সংস্পর্শে আরও অনেক নারী স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পথ খুঁজে পেয়েছেন।

নার্গিস জামান জাগো নিউজকে বলেন, একসময় হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম। কোনো টাকা-পয়সার দরকার হলে স্বামীকে বলতেও ভয় পেতাম। এখন নিজে আয় করি। সংসারের খরচ করার ক্ষেত্রেও স্বামীকে সহায়তা করি। এর সবকিছুর অবদান রাণী আপার। তাকে দেখেই নিজ থেকে কিছু করার স্বপ্ন জাগে। নার্গিস জামানের মতো কয়েক শতাধিক বেকার নারীকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছেন রাণী। ফেলে দেওয়া রিসোর্স কাজে লাগিয়ে পরিবেশবান্ধব নানা পণ্য তৈরি করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। পাটের তৈরি নানা ধরনের কাপড় বিক্রি করছেন। আছে পাটের ওড়না, জিন্স প্যান্ট, পর্দা, পাঞ্জাবি, সালোয়ার কামিজ, বেডসিট, কম্বল। এছাড়া বাঁশ-বেতের রিকশা, বেতের গরুর গাড়ি, বেতের নৌকা, বালতি, ঝুড়ি, ফুলদানি, বেতের ট্রে, ভ্যানগাড়ি, বাঁশের ট্রে, বেত পুড়া (সের), চালুন, মোড়া, কুলা, ডোল ও ম্যাগাজিন বিভিন্ন রকমের আসবাবপত্র তৈরিতে বাঁশ ও বেতের রকমারি ব্যবহার করছেন তিনি।

বেকার নারীদের তৈরি পাটের টেবিল মেট, পাপোশ এবং তাঁতের তৈরি লেডিস ভেনেটি, ট্রাভেল হ্যান্ড পার্টস, মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, আইপ্যাড ছাড়াও সব ধরনের পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়াও থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, শার্ট, নকশি কাঁথা, বেট শিট, লেডিস এবং জেন্টস ফতুয়া, মেক্সি, শতরঞ্জি, পাপোশ ওয়ালমেট পণ্যও বিক্রি হচ্ছে। শুধু দেশের বাজারেই নয়, রাণীর তৈরি পণ্য এখন চীন ও ইউরোপেও যাচ্ছে।

Advertisement

এ বিষয়ে হাফিজা আক্তার রাণী জাগো নিউজকে বলেন, আমি একজন উদ্যোক্তা, ছাত্রজীবন থেকেই স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করছি। শখের বশেই ৪০ হাজার টাকা নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন অনার্সে পড়ি। এরপর ইংরেজি পড়ানোর একটা প্রতিষ্ঠান করি। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করি। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ২০১৩-১৪ সালের দিকে কাজটা শুরু করি। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করি ২০১৬ সালে।

তিনি বলেন, সমবায় অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। প্রশিক্ষণ শেষ করে একটা শো রুম করি। পরে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে স্বাবলম্বী নামে একটা প্রশিক্ষণ নেই। ২০১৭ সালে ভারতের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে যাই। সেখানে ফ্রান্সের এক সাংবাদিকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি আমাকে পাট নিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। সেই থেকে পাট নিয়ে কাজের শুরু। শুধুমাত্র পাটের ওপরেই একটা শো রুম করেছি।

এ নারী উদ্যোক্তা আরও বলেন, আমি লেডি স্টার নামে একটা ওয়েবসাইট করি। পাট নিয়ে বহুমুখী কাজ শুরু করি। কোভিড-১৯ এর শুরুতে ‘আমরা পারি’ নামের একটা সুপার শপ করি। এ নামে আরও চারটা শো রুম আছে। মুক্তাগাছায় আমাদের প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬০ জন গ্রামীণ নারী কাজ করছেন। ৪০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এখন ২০ লাখ টাকার মালিক হয়েছি। ১০০ জন নারীকে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম।

পরবর্তী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে হাফিজা আক্তার বলেন, এখন আমার ইচ্ছে ময়মনসিংহের ১৩টি উপজেলায় শো রুম করার। আরও একটা পাঁচতলা ভবন করবো ময়মনসিংহে, যেখান থেকে সব কাজ পরিচালনা করবো। এতে হাজারো নারীর কর্মসংস্থান হবে। আমরা সবসময় পরিবেশবান্ধব উপায়ে কাজ করি। ফেলে দেওয়া পরিবেশের ক্ষতিকর নানা পণ্য সংগ্রহ করে অনেক নারী আজকে স্বাবলম্বী। অবহেলিত নারীদের বেকারত্ব থেকে মুক্তি দেওয়াই আমার লক্ষ্য।

Advertisement

এমওএস/এমকেআর/এমএস