মতামত

বাংলাদেশের পঞ্চাশে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা

বাঙালি জাতির ইতিহাস সুদীর্ঘ। আমি ইতিহাসবেত্তা নই। আমার ইতিহাসজ্ঞানের গভীরতা সঙ্গত কারণেই খুব বেশি গভীর না। আমি যদি চর্যাপদ থেকেও শুরু করি তাতেও এই দৈর্ঘ্য গিয়ে ঠেকে হাজার বছরে। অথচ এই হাজার বছরের লম্বা সময়টিতে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ইতিহাসে অনুপস্থিত। বরং ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় বাঙালি বরাবরই পরাধীন কিংবা শাসনাধীন ছিল। অনেকে দ্বিমত করবেন, বলবেন পাল রাজবংশের কথা। পালদের সময় বাঙালি আর বাঙালিয়ানার বিকাশের একটা অনুকূল আবহ তৈরি হয়েছিল নিঃসন্দেহে, কিন্তু ইতিহাসই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে পালরাও বাঙালি ছিলেন না। যেমন বাঙালি ছিলেন না পারস্যের বংশোদ্ভূত বাংলার তথাকথিত শেষ, স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাও। সিরাজ না বুঝতেন, না লিখতেন, না বলতেন বাংলায়। মেহেরপুরে মুজিবনগর সংলগ্ন পলাশীর আম বাগানে সিরাজের বাহিনীর যেদিন লর্ড ক্লাইভের মুষ্টিমেয় সেনার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ, সেদিনও যদি আশপাশের গ্রামের কৃষকরা তাদের কাস্তে-কোদাল হাতে সিরাজ বাহিনীর ত্রাণে এগিয়ে আসতেন, তাহলেও বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ইতিহাস অন্যভাবে লেখার প্রয়োজন পড়তে পারতো। কার্যত তা হয়নি, সিরাজের পাশে সেদিন এসে দাঁড়ায়নি কেউ-ই। কারন বাঙালি কৃষক ভেবেছে, পারস্যের নবাব যেয়ে আসছে বৃটিশ বণিকের শাসন, তাতে তার ভাগ্যের অদল-বদলতো হবে সামান্যই, অতএব এতে তার কি?

Advertisement

একবারও ভেবে দেখেছেন কি বৃটিশ-ভারতীয় সেনা বাহিনীতে গুর্খা, পাঞ্জাব, রাজপুত ইত্যাদি কত রেজিমেন্টইতো ছিল, তাহলে কোথায় গেল বাঙালী রেজিমেন্ট। যাদের জানা নেই, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই যে, নিজ সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতার পরও সিরাজের বাহিনীকে হারাতে ক্লাইভের বাহিনীর নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড় হয়েছিল। এ সময় এগিয়ে আসে সেখানে মোতায়েন বৃটিশ বাহিনীর বাঙালি রেজিমেন্টের সেনারা, যারা পরিচিত ছিল লাল পল্টন হিসেবে। তাদের হাতেই চূড়ান্ত পতন হয় সিরাজের বাহিনীর। শুনে কি মনে হচ্ছে বাঙালি বিশ্বাসঘাতকের জাতি। তাহলে আরো জেনে রাখুন, এর ঠিক একশ বছর পর সিপাহী বিপ্লবের সূচনা বৃটিশ-ভারতীয় বাহিনীর বাঙালি লাল পল্টনের সেনাদের হাতেই, যে সিপাহী বিপ্লবে টলে গিয়েছিল উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন। ততদিনে অবশ্য লাল পল্টন একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনীতে রূপ নিয়েছিল। তাদের ছিল চুয়াত্তরটি নিয়মিত পদাতিক ব্যাটেলিয়ান আর নিজস্ব গোলন্দাজ বাহিনীও। প্রথম আফগান যুদ্ধে লাল পল্টনের বাঙালি সেনাদের সাহসিকতা বিট্রিশ বাহিনীতে রূপকথায় পরিণত হয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহে বিদ্রোহী বাঙালি সিপাহীদের মধ্যে যারা জীবিত গ্রেফতার হয়েছিলেন বৃটিশরা তাদের অনেককেই ল্যাম্পপোষ্টে ফাসিতে ঝুলিয়েছিল। তাদের লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন যাতে কেউ আর বাঙালিদের মত অমন দুঃসাহস না দেখায়। সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার পর বিলুপ্ত করা হয়েছিল বৃটিশ বাহিনীর বাঙালি লাল পল্টন।

অর্থাৎ বাঙালির দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। সিরাজ বাঙালি ছিলেন না বলেই তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল বাঙালি সেনারা, আর যখন বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্ন এসেছে তখন অকাতরে প্রাণ দিতে সবার আগে থেকেছে এই বাঙালিরাই। আর শুধু পাল বা সিরাজুদ্দৌলার কথাই বলছি কেন? এদেশ শাসন করেনি কে? আরব, আফগান আর এমনকি আফ্রিকার হাবশি কৃতদাস - কে নেই লম্বা এই তালিকায়? এই বাস্তবতায় কোথায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান?

আমার আমাদের কথায়-বক্তৃতায় প্রায়শঃই বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে সম্বোধন করি। কেউ হয়তো বুঝে, আবার কেউ হয়তো বা না বুঝেও। জনপ্রিয় বৃটিশ প্রচার মাধ্যম বিবিসির জরিপে উঠে এসেছিল শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম। যদি সে কারনে আমরা তাকে এমন সম্বোধনে সম্বোধিত করি, তাহলে তাকে শুধুমাত্র খর্বকায়ই করা হয়। বঙ্গবন্ধু এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যার কোন অস্তিত্ব এ জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে ছিল না। শুধু তাই না, এমন স্বপ্ন এমনকি তার জমানাতেও বাঙালি স্বপ্নেও দেখেনি। বাঙালিতো মজেছিল ভারত ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টির স্বপ্নে। পাকিস্তান আন্দোলনের গতি পূর্বে যতটা বেগবান ছিল, তার ছিটেফোটাও ছিল না পশ্চিমে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাই আজকের পাকিস্তানের পাঞ্জাবিদের অ্যামেচার টাইপ ‘পাকিস্তান আন্দোলনের’ প্রতি বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘হাত মে বিড়ি, মু মে পান - লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’!

Advertisement

বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির অসারতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি খুব দ্রুতই বুঝেছিলেন যে পাকিস্তান আসলে বাঙালির জন্য পরাধীনতারই নামান্তর মাত্র, অনেকটা সিরাজ থেকে লর্ড ক্লাইভে উত্তরণের মত। এতে বাঙালির প্রকৃত মুক্তি কোন সময়ই আসবে না। তিনি এ জাতিকে ধাপে ধাপে প্রস্তুত করেছিলেন প্রকৃত মুক্তির জন্য। তিনি তাদের সামনে একটি স্বপ্ন উপস্থাপন করেছেন, তারপর ধীরে ধীরে তাদের সে স্বপ্নটি দেখতে শিখিয়েছেন এবং এক সময় স্বপ্নটিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নটির নাম ছিল ‘বাংলাদেশ’। তবে কাজটি যে মোটেও সহজ বা সহসা ছিল না তাতো বলাই বাহুল্য। বঙ্গবন্ধু জেলে বসে যেদিন আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ন সম্পাদক নির্বাচিত হন, তখন তার উপলব্ধি ছিল যে এই দলটির নামের সাথে মুসলিম শব্দটি জুড়ে দিতে না হলে তিনি অনেক বেশি সুখি হতেন, কিন্তু সেটাই ছিল সেদিনের বাস্তবতা। আওয়ামী লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে বঙ্গবন্ধুকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় দশটি বছর, ৫৫’য় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল পর্যন্ত। ভুলে গেলে চলবে না আওয়ামী লীগের পরপর প্রথম দুজন সভাপতিই ছিলেন প্রগতিশীল মাওলানা। আজ যারা মনে করেন যে আওয়ামী লীগ তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তারা কি আজ কোন ‘মাওলানাকে’, তা তিনি যতই প্রগতিশীল হন না কেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে দেখার কথা স্বপ্নেও ভাবেন?

বঙ্গবন্ধু যে শুধু বাঙালি জাতির জন্য জাতির ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাই-ই নয়, তিনি এমন একটি রাষ্ট্রের দর্শন দিয়েছিলেন যা শুধু আমাদের অঞ্চলে বা ইতিহাসেই নয়, গোটা পৃথিবীতেই বিরল। অন্তত বাংলাদেশ ছাড়া দ্বিতীয় আর কোন ‘জাতি রাষ্ট্রের’ কথা আমার জানা নেই, যে দেশে শুধু ধর্ম ছাড়া শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি মানুষের ভাষা, আচার, পোশাক, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, খাবার ইত্যাদি সবকিছুই এক এবং অভিন্ন। শুধু তাই না বঙ্গবন্ধু এই রাষ্ট্রটির নাম থেকে শুরু করে জাতিয় সঙ্গীত পর্যন্ত সব কিছুই নিজে নির্ধারন করে দিয়েছিলেন। ৬৬’তে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সানজিদা খাতুনকে বলেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা... ...’ গাইতে। সানজিদা খাতুন যখন জানতে চেয়েছিলেন এই বিশেষ রবীন্দ্র সঙ্গীতটিই কেন, বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি এটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বানাবেন। একইভাবে ঐ কাছাকাছি সময়ই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্মরনে একটি সভায় সদ্য কারামুক্ত বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে যেহেতু পাকিস্তানীরা এই ভূখন্ড থেকে বাংলার নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চাইছে, বাংলা কোন মতে টিকে আছে শুধু ‘বঙ্গোপসাগরে’, কাজেই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে এর নাম তিনি রাখবেন ‘বাংলা দেশ’, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর কখনো বাংলা আর বাঙালীর নাম মুছে ফেলার দুঃসাহস না দেখায়।

৭১’র ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সামরিক কমান্ডের কাছে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানী সেনার আত্মসমর্পণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বৃহত্তম আত্মসমর্পণ। একই সাথে এটি পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম বৃহৎ আত্মসমর্পণ । পাশাপাশি প্রকাশ্যে এমন নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের উদাহরণও পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। তবে এসব কিছুর চেয়েও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এটি ছিল ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ গালে সজোরে চপেটাঘাত। মুসলমানের জন্য এক দেশ আর হিন্দুর জন্য আলাদা এই যে অদ্ভুতুরে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’, যার উপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তান, তা যে কতটা অসার আর ব্যর্থ, বাংলাদেশ নামক অসাম্প্রদায়িক, জাতি রাষ্ট্রটির আবির্ভাব ছিল তার সবচাইতে বড় প্রমাণ। আর এর মধ্যে দিয়েই সুসম্পন্ন হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ‘প্রথম বিপ্লব’।

তার এই সফল বিপ্লবের জন্য বঙ্গবন্ধুকে শুধু যে পাকিস্তানীদেরই রোষানালে পড়তে হয়েছিল তাই না, বরং তিনি আরো বেশি রোষের শিকার হয়েছিলেন তাদের দেশি-বেদেশি অনুসারী এবং সমর্থকদের। আজ যারা কথায় কথায় বলেন বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ তারা ভুলে যান যে বঙ্গবন্ধুই আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি শোষক আর শোষিতের মাঝে দ্বিধা-বিভক্ত পৃথিবীতে শোষিতের পক্ষে। শুধু তাই নয়, তিনি মার্কিন রক্তচক্ষু আর নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কিউবায় পাট রপ্তানির দুঃসাহসও দেখিয়েছিলেন।

Advertisement

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানকে মনে করতো তাদের রক্ষাকবচ। পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম সেনাবাহিনীটির বাংলার কাদা-মাটি-জলে অমন নাকানী-চুবানী তাদের কাছে ছিল সঙ্গত কারনেই অগ্রহনযোগ্য। আজ হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন যে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশীদের ভারতীয় হিসেবে হজ পালন করতে হতো। তৎকালীন সৌদী বাদশাহর সাথে এক সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু বাদশাহর কাছে বাংলাদেশীদের হজ্জে যাওয়ার অনুমতির বিষয়টি উপস্থাপন করলে বাদশাহ তাকে বলেছিলেন এজন্য বাংলাদেশের নামটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ থেকে পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’ করতে হবে। উত্তরে বঙ্গবন্ধু তাকে স্মরণ করে দিয়েছিলেন যে বাদশাহর দেশের নামে ইসলামের নাম গন্ধটিও নেই, বরং দেশটির নাম বাদশাহর পারিবারিক উপাধীকেই ধারণ করছে। একইভাবে ইসলামাবাদের মধ্যস্থতায় পিকিং-ওয়াশিংটনের ‘পিংপং ডিপ্লোমেসি’ মুখ থুবরে পরেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল ভারতের কাছে আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীনের পরাজয়। যে কারণে গণচীন বাংলাদেশের জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ ঠেকাতে নিরাপত্তা পরিষদে ইতিহাসে প্রথমবারের মত তার ‘ভেটো’ ক্ষমতাটি প্রয়োগ করেছিল। এই যে বৃহৎ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো, এরা প্রত্যেকেই ছিল বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ বিরোধী এবং এদের প্রত্যেকেই জড়িত ছিল ৭৫’র ১৫ আগষ্টের প্রেক্ষাপট রচনায় আর ১৫ আগষ্ট বাস্তবায়নে। এ কারণেই এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিয়ে এদের প্রত্যেকের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার হিড়িক পড়েছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহদাৎবরণের পর।

১৫ আগস্টের পর থেকে টানা একুশটি বছর আর তার পর পাঁচ বছর বাদ দিয়ে আবারো সাত বছর বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন ছিল বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি। কাজেই সঙ্গত কারণেই আমাদের এ সময়টার ইতিহাস শুধুই পিছনে ছুটে চলার। ৭২’এ বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৯৩ ডলার। বঙ্গবন্ধু মাত্র তিন বছরে এটিকে বাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মাথাপিছু ২৭৩ ডলারে। আর বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়ার সময় ১৯৭৭ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১২৮ ডলারে। বাংলাদেশিদের ঐ ২৭৩ ডলারের মাথাপিছু গড় আয় ছুতে অপেক্ষা করতে হয় ১৯৮৮ পর্যন্ত তেরটি বছর আর ৭৫’এ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের যে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি, তাকে ছুতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুদশকেরও বেশি সময়, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করা পর্যন্ত।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় বিপ্লব সহসা আসে না। বিপ্লব সৃষ্টির জন্য লাগে দীর্ঘ প্রেক্ষাপট এবং অতঃপর একটি ঘাত-প্রতিঘাতপূর্ণ টালমাটাল সময় পেরিয়ে আসে বিপ্লবের সাফল্য। ২৪ বছরে পাকিস্তানী পরাধীনতা আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সফল ‘প্রথম বিপ্লব’ বাংলাদেশইতো এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ। আজ আমরা যারা কখনো কাউয়া তো কখনো ক্যাসিনোকান্ড, আর কখনো সিরিজ বোমা তো কখনো হালের আফগানিস্তানে তালেবান উত্থান কিংবা ঘরের ভেতর ‘গোদের উপর বিষ ফোড়া’ হয়ে রোহিঙ্গাদের জেকে বসায় বাংলাদেশের ভবিতব্য ভেবে ভ্রুকুঞ্চিত করি, তাদের মনে রাখতে হবে আমরা আসলে ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ প্রস্তুতি পর্বের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এই প্রস্তুতি পর্বটি এতটা দীর্ঘ হতোনা যদিনা সেদিন আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারাতাম। এই ক’দিন আগেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন বঙ্গবন্ধুকে অকালে না হারাতে হলে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার দশ বছরের মধ্যেই উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করতো।

বঙ্গবন্ধুকে তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ অসমাপ্ত রেখেই তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যবনিকা টানতে হয়েছিল। আজকের চলমান কোভিড প্যান্ডেমিকে আমাদের একদিকে যেমন ভোগান্তির শেষ নেই, তেমনি অন্যদিকে এটিও আমাদের সামনে একটি বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার উম্মোচন করেছে। একাত্তরে যেমন আমরা সুযোগ পেয়েছিলাম কে শত্রু আর মিত্রই বা কে বুঝে নেয়ার, মেলাতে পেরেছিলাম অনেক না মেলা অংক, এই করোনাকালও ঠিক তেমনি একটি যুদ্ধকাল যা আমাদের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে দেশ ও জাতিকে শুদ্ধতর করে ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় পৌঁছে দেয়ার আর ভবিষ্যতকে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ঠিকঠাক মত বিনির্মানের। কে বিকায় আর কে না আর কার গভীরতা যে কতখানি এসব কিছু এখন আমাদের সামনে অনেক বেশি স্বচ্ছ ও স্পষ্ট।

আমাদের সৌভাগ্য ৭১’এ আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাঙালির প্রথম ‘স্বাধীন ভূমিপুত্র’ শাসক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের সৌভাগ্য এবারও আমাদের নেতৃত্বে আছেন এই জাতির ইতিহাসে ‘দ্বিতীয় ভূমিপুত্র’ শাসক বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। একটু খেয়াল করে দেখুন এ দুজনের মধ্যবর্তী সময়ে যারা এদেশ শাসন করেছেন তাদের কারো শেকড়ই কিন্তু এই মাটিতে না। সঙ্গত কারণেই এই মাটির প্রতি তাদের আনুগত্যও ছিল ন্যূনতম।

বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধুর শাসনকালকে মিথ্যেভাবে উপস্থাপন করায় ৭৫’র পর থেকে অবারিত গোয়েবলসীয় প্রচারণা চলেছিল, তার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল বাকশাল। এমনকি আমরা যারা কোন কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছাড়াই ৯০’র দশকে ছাত্রলীগের প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম, আওয়ামী লীগ কোনদিনও ক্ষমতায় আসবে না এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই যারা সেসময় অনেকক্ষেত্রেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছাত্র রাজনীতি করেছি, এমনকি তারাও ‘বাকশাল’ প্রসঙ্গটা আসলেই কেমন যেন একটু ব্যাকফুটে চলে যেতাম। অবচেতনে আমাদের চেতনায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল বাকশাল হচ্ছে নিষিদ্ধ আর অশুদ্ধর প্রতিশব্দ বৈ অন্যকিছু না।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব হুট করে পাওয়া কোন কনসেপ্ট ছিল না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই রাষ্ট্র নায়ক যিনি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তার গণতন্ত্র ছিল আব্রাহাম লিংকনের ‘অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’থেকে ভিন্নতর। তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্রের’ কথা বলেছিলেন। একইভাবে তার ধর্মনিরপেক্ষতা লেনিন কিংবা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে একেবারেই আলাদা। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। তিনি ঘোষনা করেছিলেন, তিনি প্রথমে মানুষ, তারপর বাঙালি এবং তারপর মুসলমান। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ধর্ম ছিল সবখানেই, ছিলনা শুধু সংবিধানে আর রাজনীতিতে। একইভাবে সমাজতন্ত্রকেও বঙ্গবন্ধু সংজ্ঞায়িত করেছিলেন আমাদের মাটি আর মানুষের মত করে, যার নাম ‘মুজিববাদ’। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, ‘বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে সমাজতন্ত্র হয় না’। এ বিষয়ে তার ধারণা ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। তিনি বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে দেশের আবহাওয়া, বিরাজমান পরিস্থিতি, মানুষের মনোভাব, আর্থিক অবস্থা, কৃষ্টি ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়েই ধাপে ধাপে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে।

মুজিববাদ প্রসুত যে ‘বাকশাল’, তা কখনই একদলীয় শাসন ছিল না। বাকশালে সবাইকে আওয়ামী লীগের আত্মীকৃত করা হয় নি, বরং আওয়ামী লীগই বিলুপ্ত হয়েছিল বাকশালে। একটি জাতীয় চার মূলনীতি আর একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী সব অসাম্প্রদায়িক শক্তির কমন প্ল্যাটফর্ম ছিল বাকশাল। তবে যারা বাংলাদেশে বিশ্বাস করেনি তাদের কোন জায়গা বাকশালে ছিল না। বাকশালের বাংলাদেশে বাঙালির উদারতায় এদের এদেশে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার অধিকার হরণ করা হয় নি ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশই চায়নি সেসব কুলাঙ্গারকে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা আর ভবিতব্য নির্ধারনের জায়গা থেকে শত কিলোমিটার দূরে রাখাটা নিশ্চিত করেছিল বাকশাল।

বাকশালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয়নি। দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস আর বাংলাদেশ অবজারভারের মত চারটি শীর্ষ দৈনিকের ডিক্লারেশন বহাল ছিল। ঠিক একই ভাবে হরণ করা হয় নি মানুষের ভোটাধিকারও। বাকশাল ব্যবস্থায় যে নির্বাচন সেখানে রাষ্ট্রই স্বাধীনতার সপক্ষ প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারে ব্যবস্থা করতো। ছিল না টাকার খেলা, ছিল না প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজনও। নির্বাচনে যেই জিতুক না কেন, জিততো বাংলাদেশ, কারণ আর যাই হোক বাংলাদেশ বিরোধী কারো নির্বাচনে জেতাতো দূরে থাক, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারই সুযোগ ছিল না। আর এমনি নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহে একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকের কাছে ডাকসাইটে কেবিনেট মন্ত্রীর ভাইয়ের পরাজিত হওয়ার মতন ঘটনাও ঘটেছিল। প্রশাসনকে বাকশালের আওতায় একদম মাঠ পর্যায় পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত করা হয়েছিল। প্রতিটি থানায় গঠন করা হয়েছিল একটি করে থানা কাউন্সিল। এই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা ছিল সরকারি কর্মকর্তা কিংবা সংসদ সদস্য নন এমন রাজনৈতিক কর্মীদের। সদস্য হওয়ার কথা ছিল বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা আর সাথে বাকশালের প্রতিনিধিদের। সাথে থাকার কথা ছিল যুবক আর কৃষক প্রতিনিধিও। মহুকুমাগুলোকে জেলার মর্যাদায় উন্নীত করে একেকটি এডমেনিস্ট্রেটিভ ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল বাকশালে, যার প্রধান হওয়ার কথা ছিল একজন গভর্নরের। এসব জেলা এডমেনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের হাতে টেস্ট রিলিফ, লোন, সেচ প্রকল্প ইত্যাদি তদারকি ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিকল্পনা ছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই ৬১টির মধ্যে ৬০টি জেলায় গভর্ণর নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাদের জন্য ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

আজকের বাস্তবতায় বাকশাল বাস্তবায়ন করা যে সম্ভব না সেটি যেমন বাস্তব, তেমনি দ্বিতীয় বিপ্লবের আদর্শের উপর আগামী দিনের বাংলাদেশকে দাঁড় করাতে না পাড়লে যে ২০৪১’এর বাংলাদেশের ভিত্তিটা নড়বড়েই থেকে যাবে তা নিয়ে কোন সন্দেহের ন্যূনতম অবকাশ নেই। এর বড় প্রমাণ আমরা দেখেছি বছরের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটলে, যেখানে হাজার খানেক উগ্র সাদা মানুষ প্রায় মাটিতে নামিয়ে এনেছিল মার্কিনীদের গর্বের দু’শ বছরের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে। আগামীর বাংলাদেশটা গড়তে হবে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের আদলেই, যে বাংলাদেশটা হবে শুধুই অসাম্প্রদায়িক, বাঙালিত্বে বিশ্বাসী বাঙালিদের। আর যারা এর বাইরে তারাও থাকতে পারে তবে তারা এমনভাবে থাকবে যেন তারা কখনো ক্ষমতার মসনদে বসে বাংলাদেশের ঘড়ির কাটাকে আবারো পিছনে ঘুরিয়ে দেয়ার দুঃসাহস দেখানো তো দূরে থাক তেমন স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসও না পায়। গণতান্ত্রিক জার্মানিতে যদি হিটলারের অনুসারীদের আজও রাজনীতি করার অধিকার না থাকে তবে এটুকু বোধহয় খুব বেশি কিছু চাওয়া নয়।

লেখক : ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।

এইচআর/এমএস