দেশজুড়ে

‘প্রত্যেক নাগরিক যেন পতাকার মান ধরে রাখতে পারে’

বীর প্রতীক সুবেদার মেজর (অব.) সাইদুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ইপিআর) চুয়াডাঙ্গায় যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় অবস্থান করেন যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টারে। স্বাধীনতা ঘোষণার আগে ২৩ মার্চ যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে তিনিই প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন। ৮নং সেক্টরের ফার্স্ট বেঙ্গলের ডি কোম্পানির ১১নং প্লাটুনের মেজর হাফিজের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। পরে ১১নং সেক্টরে মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সিলেটের কানাইঘাটে যুদ্ধে অংশ নেন। তার উল্লেখযোগ্য অপারেশনের মধ্যে যশোর চাঁচড়ার মোড় অপারেশন, নড়াইল অপারেশন, কামারখালী ঘাট অপারেশন, ফরিদপুরের বোয়ালমারী অপারেশন, সাতক্ষীরার ভোমরা অপারেশন ও সিলেট অপারেশন অন্যতম। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় অপারেশন জামালপুরের ধানিয়া কামালপুরে। এ যুদ্ধে ৮২ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং পেটে গুলি লেগে সাইদুর রহমান মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে আসামের গোহাটিতে এক মাস চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আবার যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার সাইদুর রহমানের বিশেষ সাক্ষাৎকার।

Advertisement

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রতিনিধি-সালাউদ্দীন কাজল

জাগো নিউজ: শুনেছি ছোটবেলায় আপনি খুব ডানপিটে এবং প্রতিবাদী ছিলেন?

সাইদুর রহমান: দুই বোনের পর আমার জন্ম। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে হিসেবে খুব আদরের ছিলাম। বেশি আদরের কারণে ডানপিটে এবং প্রতিবাদী ছিলাম। কোনো অন্যায় দেখলে সহ্য হতো না। সেটার প্রতিবাদ করতাম।

Advertisement

জাগো নিউজ: কখন যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন?

সাইদুর রহমান: যখন অষ্টম শ্রেণি পাস করি তখন বয়স ছিল ২০ বছর। ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার, জুলুম, বৈষম্য খুব নাড়া দিত। তখন পরিকল্পনা নিলাম কোনো একটা বাহিনীতে যোগ দিয়ে এর প্রতিবাদ করতে হবে। সে পরিকল্পনা থেকেই ১৯৬৯ সালের ২৭ মার্চ ইপিআরে যোগ দিই। চাকরিতে যোগদানের পর ছয় মাস ট্রেনিং শেষে আমার প্রথম পোস্টিং হয় খুলনায়, ৫ উইংয়ে। এরপর আমাকে পোস্টিং দেওয়া হয় বেনাপোল সি কোম্পানিতে। এর পরই শুরু হয় পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন। এটি মনকে বিশেষভাবে নাড়া দেয়। পরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর সিদ্ধান্ত নিই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। ২৩ মার্চ সকাল ৮টায় আমি যশোর ইপিআর হেডকোয়ার্টারে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি।

জাগো নিউজ: যুদ্ধে যাওয়ার শুরুর দিকে আপনার মনোভাব কেমন ছিল? বা কারও দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়েছিলেন কি না?

সাইদুর রহমান: ২৫ মার্চ যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তখনই পাঞ্জাবিরা টহল শুরু করলো। বাঙালি মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেক্টর গার্ডের সামনে দিয়ে যশোরে। তখন বাঙালি মেয়েরা আমাদের বলছিলো ইপিআর ভাইয়েরা আমাদের বাঁচান। ওই সময় আমার ডিউটি ছিল। আমি বাঙালি মেয়েদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করি। ওই সময় থেকে আমার মনে একটা জেদ চেপে ধরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আর ছাড় দেওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই যে কোনো মূল্যে ওদের এদেশ থেকে হঠাতে হবে।

Advertisement

জাগো নিউজ: তখনকার প্রতিটি মুহূর্তই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। এমন কোনো ঘটনা আছে যা আপনার মনকে আজও শিহরিত করে?

সাইদুর রহমান: প্রথমে ইপিআর সেক্টরে কর্মরত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ শুরু করি এবং প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিই। আমরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ি। আমি ছিলাম ছয় পাউন্ডারগান (ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র) ইউনিটের সদস্য। ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় সাঁজোয়া যানে পাকিস্তানি সেনারা চাঁচড়ায় আসছিল। তখন আক্রমণ চালাই। আমাদের গোলার আঘাতে দুটি গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস ও কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পরে আমি ও আমার সহযোদ্ধারা এফইউপিতে পৌঁছে অ্যাসল্ট ফরমেশন তৈরির আগেই শুরু হয় গোলাবর্ষণ। সেই গোলার কিছু অংশ আমাদের ওপর পড়তে থাকে।

অন্যদিকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এতে আমাদের মধ্যে একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলার ধানিয়া কামালপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাই। এ সময় আমার অধিনায়ক ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শহীদ হন। এতে আমাদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। নেতৃত্বশূন্যতায় কেউ কেউ পিছু হটতে থাকেন। কিন্তু আমিসহ কয়েকজন যোদ্ধা পিছু হটিনি। তখন রাগে পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে একটা ব্রাশ ফায়ার করলাম। এতে ৭-৮ জন পাঞ্জাবি মারা যায়।

আমরা বীরত্ব ও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকি। সুরক্ষিত বাংকার থেকে পাকিস্তানি সেনারা বৃষ্টির মতো গুলি করছিল। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। পরে সেখানে শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। দেখতে দেখতে জায়গাটায় লাশের স্তূপ জমে। এক সময় আমার পেটে গুলি লাগলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। ওই সময় আমার সহযোদ্ধাদের অনেকের গায়েই গুলি লাগে। কি একটা বীভৎস কাহিনী। কেউ বলছে মাগো পানি খাবো, কেউ বলছে আমাকে নিয়ে যা-আমি বাঁচবো। আমি নেকাব্বর নামের একজনকে বললাম, তুই আমার বাড়ির কাছের লোক। তুই আমাকে নিয়ে যা, আমি বাঁচবো। ও আমাকে নিয়ে গেল না। পরে সিপাহি মাহমুদুল্লাহ আমাকে টানতে টানতে নিয়ে এলো। সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে ভারতের আসামের গোহাটি সামরিক হাসপাতালে আমার চিকিৎসা করা হয়। এক মাস চিকিৎসা শেষে ফিরে এসে আবার পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করি।

জাগো নিউজ: আপনি যেখানে দায়িত্ব পালন করতেন বিজয়ের প্রাক্কালে সেখানকার অবস্থা কেমন ছিল?

সাইদুর রহমান: ১৩ ডিসেম্বর আমরা সিলেটের এমসি কলেজে এলাম। এমসি কলেজে যখন উঠি তখন সকাল। পাঞ্জাবিরা চা খাচ্ছিল আর রোদ পোহাচ্ছিল। সিপাহি ফজর আলী তাদের বুড়ো আঙুল দেখালো। এ সময় একটা গুলি ওর মাথায় লাগে। তাকে বাঁচাতে পারলাম না। এরপর ওরা আমাদের অ্যাটাক করলো। টু-ইঞ্চি মর্টার দিয়ে বোমা ফেললো। এতে অনেক লোক মারা গেল আমাদের। তাদের লাশও আমরা আনতে পারিনি। এরপরতো ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা পেলাম। ওরা স্যারেন্ডার করলো।

জাগো নিউজ: বিজয়ের ৫০ বছর পর দেশকে নিয়ে কিছু বলেন।

সাইদুর রহমান: এ দেশ স্বাধীন করতে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন। অনেক ত্যাগের পর একটা সুন্দর পতাকা পেয়েছি। দেশের প্রতিটা নাগরিক যেন পতাকার মান ধরে রাখতে পারে। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে মানুষ বাস করুক। দেশের প্রতিটা নাগরিক যেনো মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সচেতন হয় এবং জানতে পারে যে কি করে দেশটা স্বাধীন হলো। এক হাতে জীবন আরেক হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছি। কেউ যদি দেশকে না ভালোবাসে, দেশের মাটিকে যদি ভালো না বাসে সে বেহেশত পাবে না। খুবই কষ্ট লাগে যারা দেশের স্বাধীনতা চায়নি, যারা সেদিন দেশবিরোধী ছিল, যারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাহায্য করেছে তাদের গাড়িতেই জাতীয় পতাকা উড়েছে। ভবিষ্যতে যেনো এ ধরনের দুঃসাহস আর কেউ দেখাতে না পারে সে ব্যাপারে আমাদের সবার সজাগ থাকতে হবে।

জাগো নিউজ: ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?

সাইদুর রহমান: তরুণ প্রজন্ম দেশ সম্পর্কে জানতে পারে, দেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া সোনার বাংলা বিনির্মাণে তারা যেনো আত্মনিয়োগ করে।

সালাউদ্দীন কাজল/এএইচ/জেআইএম