ঝরনা আক্তার জয়া
Advertisement
বর্তমান বাজারে চাকরি যেন সোনার হরিণ। চোখে দেখা গেলেও ধরা দেয় না সবার হাতে। একটি ভালো কোম্পানিতে মোটা অংকের স্যালারি পাওয়ার স্বপ্ন কমবেশি আমাদের সবার মাঝেই রয়েছে। তবে স্রোতের বিপরীতেও চলেন কিছু মানুষ। তাদেরই একজন হলেন আলামিন প্রান্ত।
জীবনের প্রথম চাকরি একটি স্বনামধন্য মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে। পেতেন ভালো স্যালারি। কিন্তু কিছু দিন চাকরি করার পর তার মনে হলো চাকরি তার জন্য না। তিনি অনুভব করলেন তার নিজের অনেক কিছুই করার আছে। ৯-৫ টার গণ্ডির ভেতর থেকে তা করা সম্ভব না। বিদেশে যাওয়ারও সুযোগ ছিলো তার।
তবে বাংলার মানুষকে সেবা করার নিয়ত করেছেন,পাড়ি জমাননি ভীনদেশে। সোনার হরিণ ছেড়ে (চাকরি) নিলেন উদ্যোক্তা হওয়ার ঝুঁকি। কারণ তিনি মনে করেন ঝুঁকি থেকেই অনেক সম্ভাবনার রাস্তা বের হয়ে আসবে। হবে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান।
Advertisement
পাশাপাশি হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এ সব চিন্তা করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিকিউর জব ছেড়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন মানুষের সেবায়। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন তরুণ এই উদ্যোক্তা।
টেলিমেডিসিন কোম্পানি ‘বেস্ট এইড’ এর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন আলামিন প্রান্ত। তরুণ এই উদ্যোক্তার জন্ম ঢাকার গুলশানে। নিজের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজেকে ডিফাইন করতে গেলে প্রথমেই যে টাইটেলটা মাথায় আসে তা হলো, শান্তিপ্রিয়। সুখ কিংবা শান্তি অথবা আরাম এই বিষয়গুলোর সঙ্গে কখনো কম্প্রোমাইজ করেননি তিনি।
খুবই সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম নিয়েও মাথার ছায়া বাবার কারণে অভাব খুব একটা কাছে ঘেষতে পারেনি। কিন্তু নিজের চারপাশের অভাবী মানুষদের যতবার দেখেছি ততবারই নিজের অজান্তেই মনের ভেতর মানুষের জন্য কাজ করার অদম্য ইচ্ছাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
আমার বাবা-মা আমাকে সর্বদাই মানুষের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন ও অনেকভাবে সাহায্যও করেছেন। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম ত্রাণ বিতরণ করতে ঢাকার বাইরে যাই। এভাবেই আমার বেড়ে উঠা।
Advertisement
মাধ্যমিকের গন্ডি পাড় করেন বনানী বিদ্যানিকেতন থেকে। উচ্চমাধ্যমিক মাইলস্টোন কলেজ। স্কুল কলেজ শেষ করে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম নিয়ে পড়াশোনা করেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গ্রামীন ফোনের প্রোমোশনাল বিজ্ঞাপনও করেছেন।
ছোট থেকেই বিভিন্ন সমাজকল্যাণ কাজে অংশগ্রহণ করেছেন প্রান্ত। ডিবেট ফর হিউম্যানিটিতে ছিলেন দুই বছর। এটি বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিতার্কিক সংগঠন। নিজেদের অর্থায়নে বাড্ডাতে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য পাঠাগার ও করেছিলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে স্মার্টফোন এর অভ্যুত্থান ঘটে আমাদের ই হাত ধরে। প্রায় এক যুগ ধরে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম মডিফিকেশন এ কাজ করছেন তিনি। বাংলাদেশ ছাড়া আরও ৯ টি দেশে তার ছাত্র ছিলো। যাদের কাস্টম রম তৈরি শিখাতেন। এছাড়াও নিয়মিত রক্ত দেন তিনি। এখন পর্যন্ত ৩১ বার রক্ত দিয়েছেন। রক্ত নিয়ে কাজ করছেন প্রায় ১ যুগ ধরে। ইচ্ছা আছে ১০০ বার রক্ত দান করার।
বিতর্ক ম্যাগাজিন দ্রোহের সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। ছিলেন কালের কন্ঠ পত্রিকাতেও। এরপর মোবাইল ব্রান্ড শাওমির " শাওমি কমিউনিটি বাংলাদেশ" এর মডারেটর হিসেবে কাজ করেন দুই বছর। বর্তমানে বেস্ট এইডের সহকারী পরিচালক হয়ে কাজ করছেন তিনি। 'বেস্ট এইড' গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আইডিয়া প্রোজেক্টের পোর্টফোলিও স্টার্ট আপ।
টেলিমেডিসিন সেবা কোম্পানি 'বেস্ট এইড' ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এটি ১৮ জনের টিম। রয়েছে একশো জনের ও বেশি ডক্টর ও এজেন্ট। ইন্টার্ন এম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন ৭০ জন।বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে বেস্ট এইড এর যাত্রা তার ভিত্তি প্রস্তর তৈরি হয়ে গেছে । যেতে হবে বহুদূর। আমার বাংলার মানুষ চিকিৎসা অভাবে মরবে না এই আমাদের লক্ষ্য । এই লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছে 'বেস্ট এইড'।
বেস্ট এইডের শুরুর গল্প জানতে চাইলে প্রান্ত বলেন , মীর হাসিব মাহমুদ (সি.ই.ও) আমার খুব কাছের বন্ধু। আমাদের বেড়ে উঠা একসঙ্গেই। বেস্ট এইডের জন্ম একটি ছোট্ট ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমাদের এক বন্ধু কক্সবাজার গিয়েছে কিছুদিনের জন্য। একদিন হঠাৎ মাঝ রাতে কল দিয়ে বলেন তার বাবার শরীর হঠাৎ করেই খারাপ লাগছে। তারা যেখানে আছে তার আশেপাশে কোনো দোকান নেই। যাতায়াতের জন্য কোনো বাহন ও নেই। সে আমাকে কল করায় আমি আমার ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করিয়ে দেই এবং ইমারজেন্সি ওষুধ পাঠানোর ব্যবস্থা করি। সে যাত্রায় বেঁচে যান আমার বন্ধুর বাবা।
ঢাকায় ফিরে আসার পর তাকে আবার ও নতুন করে কিছু টেস্ট করানো হয়। কারণ তার কাছে কক্সবাজার এ করানো টেস্টগুলোর রিপোর্ট ছিলো না। আর এসব ভাবনা থেকেই বেস্ট এইড। যেখানে ডাক্তার দেখানোর জন্য যেতে হবে না কোনো হাসপাতালে। ঘরে বসে ভিডিও কলে স্পেশালিস্ট ডাক্তার দিবেন চিকিৎসা সেবা। আমরা ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড তৈরি করছি যাতে করে একজন মানুষ এর সকল রোগের রেকর্ড থাকবে এবং পরবর্তীতে তিনি যখন চিকিৎসা নিতে যাবেন ডাক্তার তার আগের রেকর্ড দেখে তার রোগের বিশ্লেষণ করতে পারবেন। এর ফলে একই টেস্ট বার বার করানোর ঝামেলা এড়ানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে টেকনোলজি এখন ও অনেকটা আরাধ্য বিষয়। এখনো ৭০% মানুষ বেসিক ফিচার ফোন ব্যবহার করে। যার ফলে শুরুর দিকটা একটু কঠিনই ছিলো তাদের জন্য। সেবা পৌঁছানোটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিলো শুরুর দিকে। এছাড়া অনলাইনে ডাক্তার কীভাবে দেখবে এটা মানুষকে বোঝানোও একটু কষ্টসাধ্য ছিলো। কোভিড মহামারির কারণে অনলাইন ক্লাসের মতো অনলাইন ডক্টর কনসালট্যান্সি ও এখন মানুষ জানে। প্রতিদিন একশো জনের ও বেশি মানুষ সেবা গ্রহণ করেন 'বেস্ট এইড' থেকে।
কোম্পানিটির মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের যে সকল স্থানে চিকিৎসা সেবা পৌঁছায় না তাদের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া। এরইমধ্যে কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, সাতক্ষীরা, রংপুরে কাজ শুরু করেছেন তারা। খুব দ্রুত ভাসানচরে মায়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত জনতাকে সেবার আওতায় ও নিয়ে আসবে। এছাড়াও বাইক অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করা হয়েছে। যার মাধ্যমে মানুষ খুব দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারবে। বেস্ট এইড কে বাংলাদেশের প্রথম সম্পূর্ণ ডিজিটাল হাসপাতাল তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে 'বেস্ট এইড' টিম।
উদ্যোক্তা জীবন নাকি কর্পোরেট জীবন কোনটি বেশি উপভোগ করছেন জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই উদ্যোক্তা জীবন। কারণ জীবন মানেই চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় এবং নিজেকেই সেটার উত্তর খুঁজে বের করতে হয়। প্রতিনিইয়তই কিছু না কিছু শিখছি। গুণীজনদের সঙ্গে কাজ করছি। বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করতে পারছি এই প্রাপ্তি আমার বড় প্রাপ্তি।
নতুনদের জন্য তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হতে হলে প্রথমেই নিজেকে ধৈর্যশীলদের একজন বানাতে হবে। ডিসিশন-মেকিং এ পারফেক্ট হতে হবে এবং দিনশেষে রিস্ক-ফ্যাক্টরগুলো খুব ভালোভাবে এনালাইসিস করে বাস্তবায়ন করার মতো সৎ সাহস ভেতরে পোষণ করতে হবে।
প্রচুর পড়তে হবে। ইচ্ছা হলেই যে কোনো কিছু করা যাবে না। প্রতিটা কাজের ফলাফল আগেই হিসেব করা জানতে হবে। কেস স্টাডি করতে হবে প্রচুর। তাহলে সফলতা আসবেই। সব সমস্যা তোমার সমাধান করার দরকার নেই যে কোনো একটি সমস্যা এর পূর্নাঙ্গ সমাধান করো তোমার জীবনের সফলতা ঐখানেই।
কেএসকে/জেআইএম