ক্ষমতা বড় আজব জিনিস। আজ যে প্রবল ক্ষমতাধর, কাল সে পথের ভিখারী হয়ে যেতে পারে। রাতারাতি হিরো থেকে জিরোতে পরিণত হতে পারে। এ জন্য সীমা মেনে চলতে হয়, মাত্রাজ্ঞান থাকতে হয়। তা না হলে নক্ষত্রেরও পতন ঘটে। যারা হিসাব-কিতাব মেনে চলেন, তারা তেমন কোনো সমস্যায় পড়েন না। কিন্তু বেহিসাবি হলে অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়তে হয়।
Advertisement
গাজীপুরে মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের কথা মনে করেই এই সামান্য ভূমিক। বড় প্রভাব ও প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিলেন তিনি! ক্ষমতা-দাপট-অর্থ-বিত্ত সব কিছুই ছিল ঈর্ষণীয়। ফলে কাউকে পরোয়া বা তোয়াক্কা না করার প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তার। কিন্তু কথা আছে না, অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে! জাহাঙ্গীর আলমও কারো কারো আশ্রয়প্রশ্রয় পেয়ে লকলক করে বেড়ে উঠতে গিয়ে পা-পিছলে পপাত ধরণীতল। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছিলেন জাহাঙ্গীর আলম।
হয়তো আড়ালে-আবডালেই করেছিলেন। তবে ভুলে গিয়েছিলেন ফাঁদ পাতা আছে ভুবন জুড়ে। বঙ্গবন্ধ সম্পর্কে তার বেসামাল ওই মন্তব্য কে বা কারা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যস, ধরা খেলেন জাহাঙ্গীর। পাপ তো অনেকেই করে। কিন্তু পাপের চিহ্ন রাখে কয়জন? জাহাঙ্গীর আলমের ভুলটা এখানেই। তার ‘পাপ’ ভিডিও হওয়ায় এবং তা প্রচার হওয়ায় তিনি ফেঁসে গিয়েছেন। হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। ধরা না পড়লে হয়তো তেমন কিছুই ঘটত না। তিনি আরও উপরে উঠতে পারতেন। যেমন অনেকেই উঠেছেন। হিসাব-কিতাব করে যারা চলছেন, তারা বহাল তবিয়তেই আছেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। দেশে এখন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দলের তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। আওয়ামী লীগের দাপটের কাছে অন্য সব দল প্রায় অস্তিত্বহীন। টিকে থাকার জন্য সুবিধাবাদীগোষ্ঠী অন্তরে যাই থাক, মুখে আওয়ামী লীগের গুণগান করেন। আওয়ামী লীগের পরিচয় ধারণ করেন। এর মধ্যে ‘সীমালঙ্ঘন’ করে অনেকেই ধরা খেয়েছেন। ২০১৮-এর নির্বাচনের পর টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনের পরই আওয়ামী লীগ ঘটা করে ঘরের ভেতর ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরু করে। আর এই ‘শুদ্ধি অভিযানে’ দলের বিভিন্ন স্তরের অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন এবং তাদের বিপুল বিত্ত-বৈভবের সন্ধান পাওয়া যায়। ‘শুদ্ধি অভিযানে’ যারা ‘বলি’ হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন, সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী, যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কাউসার মোল্লা, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ মারুফ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী আরমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক সাঈদ, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিমা নূর পাপিয়া, ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীমসহ অনেক নেতাকর্মী। এসব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার পর ভাবা হয়েছিল, দলের অন্যরা সমঝে চলবেন। ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, বেফাঁস মন্তব্য ইত্যাদি বন্ধ করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেরকম কিছুই হয়নি। অনেকে সাবধানী হয়েছেন মাত্র। অনেকে ঠিকই ঘুষ-দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-শৃঙ্খলাভঙ্গ-দাপট দেখানো ইত্যাদি নিঃশঙ্ক চিত্তে চালিয়ে যাচ্ছেন।
Advertisement
তবে মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগে গত ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একই সঙ্গে তার দলের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়।
বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে জাহাঙ্গীর যে মন্তব্য করেছেন, সেটাও দলকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল। দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও তিনি কার্যত রেহাই দেননি। বলেছেন, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে হয়তো ভুল বোঝানো হয়েছে বা ভুল মেসেজ দেওয়া হয়েছে। উনি সঠিকটা জানলে হয়তো কোনো দিনই ব্যবস্থা নিতেন না'। এর অর্থ কি এটাই নয় যে, প্রধানমন্ত্রীকেও ভুল বোঝানো যায় এবং তিনি সঠিকটা না জেনেই সিদ্ধান্ত নেন?
নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর চোখে ভালো প্রমাণ করার জন্য গত দুই মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বড় বড় বিজ্ঞাপন ছেপেছেন বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায়। কত টাকা ব্যয় করেছেন এই দুই মাসে তা বের করা দরকার। জাহাঙ্গীর আলম লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গেও প্রতারণা করে নিজের পক্ষে একটি লেখা লিখিয়ে দৈনিক ইত্তেফাকে ছাপার ব্যবস্থা করেছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গাফফার চৌধুরী বিষয়টি জেনে ইত্তেফাকে প্রতিবাদও পাঠিয়েছেন। কত টাকা ব্যয় করে, কাদের সহযোগিতায় জাহাঙ্গীর এত বড় প্রতারণা করেছেন, তাও অনুসন্ধান করা দরকার।
টাকার জোরে সব নিজের কব্জায় নেওয়ার দুঃসাহস একদিনে অর্জন করা যায় না। জাহাঙ্গীর সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখানোর মতো বেপরোয়া হয়ে উঠলেন কীভাবে তারও পোস্টমর্টেম হওয়া জরুরি। দল থেকে বহিষ্কারের পর জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদ থেকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের কারণ হিসেবে প্রজ্ঞাপনে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ভুয়া দরপত্র, নির্দিষ্ট কোম্পানিকে দর দেওয়ার অনুরোধসংক্রান্ত (আরএফকিউ) দরপত্রে অনিয়ম, বিভিন্ন পদে অযৌক্তিক লোকবল নিয়োগ, বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে ভুয়া বিল–ভাউচারের মাধ্যমে ও একই কাজ বিভিন্ন প্রকল্পে দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, প্রতিবছর হাটবাজার ইজারার টাকা যথাযথভাবে নির্ধারিত খাতে জমা না রাখাসহ নানাবিধ অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এ ছাড়া ভূমি দখল ও ক্ষতিপূরণ ছাড়া রাস্তা প্রশস্তকরণসংক্রান্ত অভিযোগও রয়েছে।
Advertisement
যে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এখন এত অভিযোগ, তাকেই কিন্তু এতদিন আওয়ামী লীগ ‘হিরো’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তাকে ‘আধুনিক ও পরিকল্পিত গাজীপুর গড়ে তোলার কারিগর’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অথচ জাহাঙ্গীর আলম ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে দলীয় নেতা আজমতউল্লাহ খানের বিরোধিতা করেছিলেন। জাহাঙ্গীর এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধাচরণ সেই পরাজয়ের কারণ হিসেবে তখন জেলা আওয়ামী লীগ মূল্যায়ন করেছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও সে কথা অজানা নয় । কিন্তু এর জন্য জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ইনি বরং তাকে সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তার বিরুদ্ধে এখন আরও অনেক গুরুতর অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
তিনি অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন, দলের মধ্যে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেছেন, প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাদের উপেক্ষা ও ‘একঘরে’ করেছেন, জামায়াত-বিএনপি-হেফাজত নেতাদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে নিজের প্রভাব বাড়িয়েছেন, স্বার্থ হাসিল করেছেন, দলের মধ্যে তার বিরোধিতাকারীদের খুন পর্যন্ত করিয়েছেন– এমন এন্তার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অথচ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তির ভিডিও ভাইরাল হওয়ার আগ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করেনি। বরং তাকে মহান ও অপরিহার্য নেতা আখ্যায়িত করে মাথায় তুলে নেচেছেন। যারা এক দশক ধরে জাহাঙ্গীর আলমকে আশ্রয়-প্রশ্রয়-সমর্থন দিয়ে এমন বেপরোয়া হতে সাহায্য করেছেন, তাদের বিচার কে করবে? অন্যায়কারীই কি কেবল শাস্তি পাবার যোগ্য? তার দোসর ও সহায়তাকারীরা রেহাই পেয়েই পাবে? কোন যুক্তিতে?
কেউ কেউ বলছেন, জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অ্যাকশন দুর্নীতিবাজ, বেপরোয়া, বেফাঁস মন্তব্যকারীদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আসলেই কি তাই? এতে কি আদৌ কেউ সতর্ক হয়? আওয়ামী লীগে কি জাহাঙ্গীর আলম একজনই? আসলে একজন বা দুজন জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করে, মামলা দিয়ে, জেলে ঢুকিয়ে পরিস্থিতি বদলানো যাবে না। এ থেকে কেউ শিক্ষাও নেবে না। বরং তারা আরও সতর্ক হবে। ঘুষ-দুর্নীতি, অবৈধভাবে টাকা বানানো, ক্ষমতার দাপট দেখানো౼ সব অপকর্মই তারা করবে। যদি সত্যি সত্যি পরিবর্তন চাওয়া হয় তাহলে দলের মধ্যে আদর্শিক রাজনীতির চর্চা বাড়াতে হবে।
আওয়ামী লীগ এখন যেন অসংখ্য জাহাঙ্গীর আলম সৃষ্টির যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এটা বদলাতে হবে। দলে নীতি-আদর্শ বিবর্জিত দুর্নীতিবাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। দলের নেতৃত্বে এমন ব্যক্তিদের আনতে হবে যারা কোনোভাবেই দুর্নীতি ও অবৈধভাবে টাকা বানানোর সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। যারা প্রকৃত অর্থেই দলের নীতি-আদর্শ-শৃঙ্খলা মেনে চলবে, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে রাখবে। যারা প্রকৃত অর্থেই জনকল্যাণে কাজ করবে। ধান্দাবাজ, টাউট, বাটপার, আদর্শহীন ব্যক্তিরা যেন দলের প্রাথমিক সদস্য হতে না পারে সে ব্যাপারে আন্তরিক উদ্যোগ থাকতে হবে।
এমন পরিবর্তন কি আদৌ করার চেষ্টা আওয়ামী লীগ করবে?
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা।
এইচআর/এমএস