আমি নিজে পড়তে পারিনি। কিন্তু আমার খুব প্রিয় কলেজ নটরডেম। কুমিল্লার সন্তান আমি পড়েছি ভিক্টোরিয়া কলেজে, ঢাকায় আসার কথা তখনও ভাবিনি। চেয়েছিলাম আমি না পারলেও আমার সন্তান কলেজে পড়ুক। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় টিকলেও প্রসূন তার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট যোসেফ ছাড়তে চায়নি।
Advertisement
শুধু আমার নয়, নটরডেম অনেকেরই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান। নাঈম হাসানও তেমনই একজন। ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেও পরে সুযোগ পেয়ে নটরডেম কলেজে চলে যায় নাঈম। প্রতিদিন কেরানীগঞ্জ থেকে আরামগবাগে আসতো নিজের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান নটরডেমে নিজের ও পরিবারের স্বপ্নপূরণের আকাঙ্খায়। নাঈমের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে বিচারক হবে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। তার স্বপ্ন পিষ্ট হয়ে গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাকায়। বছর তিনেক আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনেও রাজপথে ছিল নাঈম। নিজের রক্ত দিয়ে সেই আন্দোলনকে আবার রাজপথে ফিরিয়ে আনলো নাঈম।
বাংলাদেশে একটা প্রবণতা আছে। কিছু একটা ঘটলে বারবার সেটা ঘটতে থাকে। কোথাও একটা ধর্ষণের খবর আসলে পরপর কয়েকদিন কয়েকদিন পত্রিকায় একই ধরনের খবর ছাপা হতে থাকে। আর সড়ক দুর্ঘটনা তো প্রতিদিনের খবর। করোনায় তবু মাঝে মধ্যে মৃত্যু শূন্যতে নেমে আসে। কিন্তু বা্ংলাদেশে মৃত্যুহীন সড়কের দিন বোধহয় নেই। বুধবার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় কলেজছাত্র মারা গেল, উত্তর সিটি করপোরেশনই বা বসে থাকবে কেন। পরদিনই বসুন্ধরা মার্কেটের সামনে উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চাপা দেয় মোটর সাইকেলে থাকা সংবাদকর্মী আহসান কবির খান। দুটি শিশু সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যত আর একটি পরিবারের স্বপ্নকে পেছনে রেখে চলে গেল প্রথম আলোতে আমার সাবেক সহকর্মী আহসান কবির খান।
ঢাকায়, ঢাকার বাইরে প্রতিদিনই রাস্তার কালো পিচ লাল হয় মানুষের রক্তে। কত স্বপ্ন ঝরে যায় আমরা তার সব খবরও রাখি না। যার যায় শুধু সেই জানে। পরপর দুদিন সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির এসন হন্তারক হয়ে ওঠা অবশ্যই আতঙ্কের। তবে পরে যেই সংবাদ দেখলাম, তাতে সেই আতঙ্ক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। দুটি গাড়িতে চালাচ্ছিলেন লাইসেন্সবিহীন চালক। দুই সিটি করপোরেশনের সব ময়লার গাড়ি চালকরা চালাবেন, এখন দেখছি, এসন আশা করাটাই দুরাশা। উত্তর সিটিতে ময়লার গাড়ি আছে ১৬৫টি, চালক আছে ৮২ জন। দক্ষিণ সিটির অবস্থা আরো ভয়াবহ; এখানে ময়লার গাড়ি আছে ৩১৭টি, চালক আছেন মাত্র ৮৬ জন। বাকি গাড়িগুলো চালান মশককর্মী, নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী আর বহিরাগতরা। তারমানে আর যাই হোক, ময়লার গাড়ি থেকে একশো হাত দূরে থাকবেন। ময়লার গাড়ি যেন আজরাইলরা চালায়।
Advertisement
৪ নভেম্বর ডিজেলের দাম বাড়ার পরদিন থেকে পরিবহন মালিকরা যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এরপর কখনো মালিক, কখনো শ্রমিক, কখনো শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজপথে অরাজকতা চলছেই। ডিজেলের ২৩ ভাগ মূল্যবৃদ্ধিকে ইস্যু করে মালিকরা ২৭ ভাগ ভাড়া বাড়িয়েই সন্তুষ্ট হয়নি। আদায় করা হচ্ছে, তারচেয়ে অনেকে বেশি। ভাড়া অনেক বাড়লে চাপ পরে শিক্ষার্থীদের ওপর। যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার প্রচলন আছে। আমি নিজেও ছাত্র জীবনে স্বল্প দূরত্বে হাফ ভাড়ায় চলাচল করেছি। কিন্তু মালিক-শ্রমিকরা এখন এটা মানতে চাইছেন না। দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে, কিন্তু সরকার মালিকদের কিছুতেব মানাতে পারছেন না। মালিকরা চাপ দিয়ে, ব্ল্যাকমেইল করে ন্যায্য-অন্যায্য সব দাবিই আদায় করে নেয় সরকারের কাছ থেকে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের একটি যৌক্তিক দাবি ও প্রচলিত অধিকার মালিকদের মানাতে পারছে না। এমনিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে সরকার দারুণ শক্তিশালী। কিন্তু পরিবহন মালিকদের সামনে এলেই তারা আপসকামী।
হাফ ভাড়ার দাবিতে শিক্ষার্থীরা যখন রাজপথে তখনই নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুতে আন্দোলনৈ নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। হাফ ভাড়ার সাথে যুক্ত হয় নিরাপদ সড়কে দাবিও। নিরাপদ সড়কের দাবি অবশ্য নতুন কিছু নয়। নিরাপদ সড়কের আকাঙ্খা সবসময়ই ছিল এবং আছে। সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে প্রায় ২৭ বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তার নিরলস আন্দোলন মাঝে মধ্যেই উত্তাল হয়ে ওঠে কোনো না কোনো ঘটনায়।
২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের মৃত্যূর পর দেশজুড়ে নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের সংঘর্ষে দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়ার মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশজুড়ে শিক্ষার্থী অভাবনীয় এক আন্দোলন গড়ে তোলে। সরকার নানান আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাশে ফেরালেও সড়ক নিরাপদ হয়নি, বাস্তবায়িত হয়নি কোনো অঙ্গীকারই। সরকার চেষ্টা করেনি, তা বলবো না। কঠোর আইন প্রণযনের নানা চেষ্টা হয়েছে, আইন পাশও হয়েছে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনে তা কার্যকর করা যায়নি।
সরকার আসলে দাবির যৌক্তিকতা নয়, আন্দোলনের তীব্রতার কাছে হার মানে। যখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তীব্র হয়, তখন তাদের দাবি মানার আশ্বাস দেয়। পরে আবার হার মানে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ মাস্তানির কাছে। সরকারও জানে, সহপাঠীর মৃত্যু শোক প্রশমিত হলে বুঝিয়ে শুনিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্লাশে ফিরিয়ে নেয়া যাবে। এখন এটা পরিষ্কার আন্দোলন-টান্দোলন যাই করুন, সড়ক অনিরাপদই থাকবে। মৃত্যুর মিছিল আরো লম্বা হবে।
Advertisement
নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র দায়ী চালকের বিচার এবং নাঈমের নামে একটি ফুটওভার ব্র্রিজ করা হবে। তারপরই ফেসবুকে দেখলাম একটি ব্যঙ্গাত্মক স্ট্যাটাস, ‘ঢাকায় নিজের নামে ফুটওভার ব্রিজ চাইলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যেতে হবে।’ তবে এই স্ট্যাটাসটি পূর্ণাঙ্গ নয়। এটা সত্যি হলে ঢাকায় শুধু ফুটওভার ব্রিজই থাকবে, রাস্তা থাকবে না। নিজের নামে ফুটওভার ব্রিজ চাইলে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেই হবে না; তাকে শিক্ষার্থী হতে হবে এবং তার মৃত্যুর পর তীব্র আন্দোলন হতে হবে। নাঈম নটরডেম কলেজের ছাত্র ছিলেন বলেই তার সহপাঠীরা রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছেন। কিন্তু পরদিন যে একই কায়দায় আহসান কবির খান মারা গেলেন, তা নিয়ে আন্দোলন করারও কেউ নেই। তাই ফুটওভার ব্রিজ বা ক্ষতিপূরণ কিছুই পাবে না তার পরিবার। মৃত্যুর লম্বা মিছিলে আরো একটি সংখ্যামাত্র আহসান কবির খান।২৭ নভেম্বর, ২০২১
লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/জিকেএস