ফুটবল ইতিহাসে এমন খুব একটা দেখা যায় না। পেলের যুগ হয়ে থেকেছে কেবল পেলেরই যুগ। গারিঞ্চা, ববি মুর, ইউসেবিওর মতো মহাতারকারাও তাঁর ঔজ্জ্বল্যের পাশে ছিলেন প্রদীপের মতো। ঠিক তেমনিভাবে জিকো, সক্রেটিস, মিশেল প্লাতিনিরা ঢাকা ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামক মহীরুহের ছায়াতলে। সত্যি বলতে, এই প্রথমবারের মতো বিশ্ব ফুটবল প্রত্যক্ষ করছে এমন সমকালীন দ্বৈরথ। গ্রহের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারের দাবি নিয়ে প্রতি সপ্তাহান্তে লড়াইয়ে নামছেন লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।এমনিতেই স্প্যানিশ দুই ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার বৈরিতার ইতিহাস সুবিদিত। তার ওপর যোগ হয়েছে, শ্রেষ্ঠত্বের বেদিতে আসীন হওয়া নিয়ে চারবার আর তিনবারের ফিফা বর্ষসেরা মেসি-রোনালদোর খণ্ডযুদ্ধ। এমনি এমনি তো আর এবারের `এল ক্লাসিকো`র নামকরণ `মেগা এল ক্লাসিকো` হয়নি!এমনিতে দুজনের খেলার ধরণ কিন্তু পুরোপুরি আলাদা, একেবারে মেরু দূরত্বের। আর মাঠের ফুটবলে? মেসি জাদুকর, রোনালদো যন্ত্র। মেসি ড্রিবলার, রোনালদো স্প্রিন্টার। মেসির মূল ক্ষমতা ড্রিবলিং। কল্পনাশক্তির বিচ্ছুরণ তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে। প্রতিপক্ষকে হতবুদ্ধি করে বেরিয়ে যাওয়া, সতীর্থকে চোরা পাস দেওয়া কিংবা আপাত-অকারণ দৌড়ের মধ্যেও শিল্পের অবধারিত উপস্থিতি। ফুটবল গালিচাকে শিল্পীর ক্যানভাস বানিয়ে ছবি এঁকে যান তিনি অবিরাম। মেসি-দর্শন মানে তাই ফুটবলের বিশুদ্ধতম পর্ব দর্শন।তবে এ শিল্পে টিল্পে খুব একটা আগ্রহ নেই রোনালদোর। গতির ঝড়ে বুনো উদ্দামতায় তিনি জয় করে নিতে চান সব। যেকোনো মূল্যে গোল তার চাই। চাই দলের জয়। চাই যুগশ্রেষ্ঠত্ব। সব দুমড়ে-মুচড়ে কেবলই সাফল্যপিয়াসী রোনালদো। তাই তো নিজের পেনাল্টি মিসে মুহ্যমান হয়ে থাকেন, ফিরতি বলে যে সতীর্থ গোল দিয়েছেন তাতে তাঁর থোড়াই কেয়ার।
Advertisement
ছোটখাটো গড়ন, লাজুক চলন-বলন আর দুষ্টুমিভরা চোখজোড়া নিয়ে মেসি যেন পাশের বাড়ির ছেলে। তাকে ভালো না বেসে উপায় কি! আর রোনালদো? ফিল্মস্টারের মতো দূর আকাশের তারা। মেসির বিনয়ের ছিঁটেফোঁটাও তাঁর মধ্যে নেই, আছে নিরংকুশ পৌরুষের স্পষ্ট ঔদ্ধত্য। তার জন্য সমর্থকদের যতটা ভালোবাসা, এর চেয়ে ঢের বেশি সমীহ। এ দ্বৈরথ নিয়ে আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকর খুব একটা ভাবেন বলে মনে হয় না। অন্তত সংবাদমাধ্যমে এর কোনো বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি।
রোনালদো ঠিক উল্টো। সুযোগ পেলেই দাবি করে বসেন, তিনি সেরা। `বতর্মান বিশ্বের ১, ২ ৩ নম্বর সেরা ফুটবলারের নাম রোনালদো` তার এই কথা তো ঢুকে গেছে ফুটবলের বাণী চিরন্তনে। আর শুধু মেসিকেই যে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন না, সর্বকালের সেরা হওয়ার আকাঙ্ক্ষার ঘোষণায়ই তার প্রমাণ।
এদিকে শত পীড়াপীড়িতেও মেসির মুখ দিয়ে অমন কথা কখনো বেরোবে না। স্বয়ং ডিয়েগো ম্যারাডোনা তাঁকে নিজের ওপরে বসাতে চাইলে উত্তরসূরি তা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন, `আমি যত ভালোই খেলি না কেন, ডিয়েগোর কাছাকাছি কখনো যেতে পারব না। কখনোই না।`ইতিহাসে তারা কোথায় জায়গা পাবেন, সেটি কেবল জানে সময়। ফুটবলপ্রেমীরা সেসব বিচারে না গিয়ে প্রাণ ভরে উপভোগ করুক এ দ্বৈরথ।
Advertisement