শীতে প্রকৃতি শুষ্ক হয়ে পড়ে। এই সময়টা অনেকে উপভোগ করলেও শিশুদের বাড়তি কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় শীতকালীন বিভিন্ন রোগে খুব সহজেই তারা আক্রান্ত হয়।
Advertisement
শীতে শিশুদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন নবজাতক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মো. সাঈদুল হক।
তিনি মনোয়ারা শিকদার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম-
জাগো নিউজ: শীতে শিশুরা কোন কোন রোগে বেশি আক্রান্ত হয়?
Advertisement
ডা. সাঈদুল হক: শীতকালে শিশুরা শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। সেটা হতে পারে সর্দি-কাশি, জ্বর, ব্রংকিউলাইটিস থেকে শুরু করে নিউমোনিয়া বা অ্যাজমার মতো জটিল সমস্যা। কান বা গলার সমস্যা, টনসিল ফুলে যাওয়া, মাম্পস ইত্যাদিও শীতকালে বেড়ে যায়।
শীতে ৬ মাসের কম বয়সের শিশুরা রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়াতে বেশি আক্রান্ত হয়। এসময় শীতে ত্বকে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। খোস-পাঁচড়া বা স্ক্যাবিস রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে।
যারা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বসবাস করে, তাদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়াও ছত্রাকজনিত চর্মরোগের সমস্যাও দেখা দেয়।
জাগো নিউজ: শীতকালে এসব রোগ কেন বেশি দেখা দেয়?
Advertisement
ডা. সাঈদুল হক: এ সময় শ্বাসতন্ত্র সম্পর্কিত রোগগুলো বেশি দেখা দেয়।কারণ বাতাসে ধুলাবালির পরিমাণ বেশি থাকে। চারপাশে ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণু প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়।
শীতে শিশুদের ঠান্ডা থেকে সুরক্ষিত না রাখলে সর্দি-কাশি ও গলা ব্যাথার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময় রাস্তার পাশের খাবারেও অনেক জীবাণু থাকে। এগুলো খেলে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়।
জাগো নিউজ: এসব রোগের লক্ষণ ও প্রতিকারেরর উপায় কি?
ডা. সাঈদুল হক: শ্বাসতন্ত্রের বেশি গুরুতর রোগ হচ্ছে নিউমোনিয়া। নিউমোনিয়ায় আক্রান্তের লক্ষণ হচ্ছে সর্দি কাশির পাশাপাশি উচ্চ তাপমাত্রায় জ্বর থাকা। এসময় শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেশি থাকে। বাইরে থেকে শিশুর শ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।
নিউমোনিয়া সাধারণত ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে বেশি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এক্স-রে ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অ্যান্টিবায়োটিকসহ অন্যান্য চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও এসময় শিশুরা ব্রংকিউলাইটিসে বেশি আক্রান্ত হয়। এই রোগের লক্ষণে কাশি ও শ্বাসকষ্টের আলামত থাকতে পারে।
নিউমোনিয়া থেকে এই রোগের তীব্রতা খানিক কম থাকে। অ্যাজমা শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহের কারণে হয়। শীতে বাতাসের মধ্যে থাকা ধুলাবালি শ্বাসনালিতে ঢুকে প্রদাহের সৃষ্টি করে।
তখন শ্বাসনালি স্বাভাবিকের তুলনায় চিকন হওয়া ও শ্লেষ্মা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য সমস্যা হয়। ফলে শিশুদের নিশ্বাসের সময় আওয়াজ হয়, কাশি ও শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়।
জাগো নিউজ: শীতে শিশুদের রোগ-বালাই থেকে নিরাপদ রাখতে করনীয় কি?
ডা. সাঈদুল হক: প্রথমে নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিশুর রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও ঠান্ডা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। শীতে বাচ্চার হাত পায়ে মোজা ও কান টুপি পরিয়ে রাখতে হবে, বিশেষ করে যখন ঘরের বাইরে যাবে। দু-বছর বয়সের বেশি সব শিশুকেই নিয়মিত মাস্ক পড়াতে হবে, যাতে ধুলাবালি থেকে বাঁচানো যায়।
শিশুদেরকে অসুস্থ রোগীর সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা জরুরি। বড়দের মতো নিয়মিত শিশুদেরও ঘন ঘন হাত ধোয়ার অভ্যাস করাতে হবে। বারবার যেন তারা নাকে ও মুখে হাত না দেয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভিটামিন-সি (লেবু, মাল্টা, কমলার রস) জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে।
শিশুদের নিয়মিত টিকাদান নিশ্চিত করতে হবে। ভিটামিন-এ ক্যাম্পেইনের সময় ভিটামিন-এ খাওয়াতে হবে। এগুলো শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। শিশুদের শরীরে সরিষার তেল ব্যবহার না করাই ভালো।
এতে শিশুর ত্বকের ক্ষতি হয় ও ঠান্ডা লাগার প্রবণতা বেড়ে যায়। শীতে একদিন পরপর গোসল করানো যায় তবে নিয়মিত গা মুছে দেওয়াটা জরুরি। ধুলাবালি থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে হবে। শিশুর সামনে ধূমপান না করা ও মাটির চুলার ধোঁয়া যাতে শ্বাসের সঙ্গে না ঢুকে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
জাগো নিউজ: শীতে নবজাতকদের যত্ন কেমন হবে?
ডা. সাঈদুল হক: শীতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে নবজাতকরা। কারণ তাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অপরিপক্ক। নবজাতকের চামড়া খুব পাতলা থাকায় শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারেনা।
এসময় নবজাতকদের ঠিকমতো ঠান্ডা থেকে দূরে না রাখতে পারলে নিউমোনিয়া, জ্বর ও অন্যান্য জটিল সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নবজাতকের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই।
জন্মের পর থেকে ৬ মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। তাছাড়া নবজাতকের সংস্পর্শে আসলে হাত স্যানিটাইজ করতে হবে। মায়ের ঠান্ডার সমস্যা থাকলে মাস্ক পরিধান করে নবজাতকের সংস্পর্শে আসতে হবে।
জাগো নিউজ: তীব্র শীতে শিশুর ত্বক সুরক্ষিত রাখতে করণীয় কী?
ডা. সাঈদুল হক: শীতে সাধারণত শিশুদের ত্বক যেমন- হাত ও পা ফেটে যায়। এজন্য ভ্যাসলিন ও বাজারে শিশুদের জন্য তৈরি লোশন ও অলিভ ওয়েল ব্যবহার করতে হবে।
শীতে শুষ্ক ত্বকে ডার্মাটাইসিস ও অন্যান্য সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া শীতে ত্বকে খোস-পাঁচড়ার সমস্যা বেশি দেখা দেয়। এসব সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
জেএমএস/জেআইএম