মতামত

চীনের ‘ছোট তুষার’

আমি জীবনে প্রথম তুষার দেখেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগান রাজ্যের বৃহত্তম শহর পোর্টল্যান্ডে। সে ২০০৭ সালের কথা। আমাদের (মানে বাংলাদেশের ৫ সাংবাদিককে) নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মাউন্ট হুড (Mount Hood) দেখাতে। সেখানেই আমার প্রথম তুষারদর্শন। মাউন্ট হুডকে বলা হয় ‘তুষারাবৃত’ (snow-capped)। আমরা গিয়েছিলাম গরমে। তখনও মাউন্ট হুড তুষারের টুপি পরে ছিল। কিন্তু জমে-থাকা-তুষার দেখা আর সত্যিকারের তুষারপাত দেখার মধ্যে ফারাক বিস্তর। সেটা বুঝেছি চীনে এসে।

Advertisement

চীনে আমি প্রথম তুষারপাত দেখি ২০১২ সালের শেষের দিকে। খুব মনে আছে, শুভ্র-সুন্দর তুষার দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। সেই থেকে তুষার আমার প্রিয়। প্রতিবছর তুষারের জন্য আমি মনে মনে অপেক্ষা করি। চলতি বছর বেইজিংয়ে এখন পর্যন্ত একবারই তুষার পড়েছে; রীতিমতো তুষারঝড়! ছেলেকে নিয়ে বের হয়েছিলাম বাইরে; তবে অল্পসময়ের জন্য। ফটোসেশানশেষে দ্রুত ঘরে ফিরি। ঠাণ্ডায় বেশিক্ষণ বাইরে টেকা দায়। তবে, সেই অল্পসময়েই ছেলে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খানিকটা তুষার ছোড়াছুড়ি খেলে নিয়েছিল।

চীনে ‘ছোট তুষার’ ও ‘বড় তুষার’ বলে দুটো টার্ম আছে। চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে এ বছর ‘ছোট তুষার’ পড়ার কথা ২২ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সেই হিসেবে বলা চলে বেইজিংয়ে সময়ের আগেই আগমন ঘটেছিল ছোট তুষারের। তবে, ওই একদিনের জন্যই। আমি অপেক্ষায় আছি তুষারপাতের; ‘ছোট তুষারের’ পর ‘বড় তুষারের’।

চীনের চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদ (solar terms)-এ। প্রাচীন চীনে হলুদ নদীর অববাহিকায় এই ২৪ সৌরপদের উৎপত্তি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ২৪ সৌরপদ ‘চীনের পঞ্চম মহান আবিষ্কার’ (Fifth Great Invention of China) হিসেবে স্বীকৃত। ইউনেস্কোও একে মানবজাতির অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ২৪টি সৌরপদ বা সোলার টার্ম হচ্ছে: লি ছুন (বসন্তের শুরু), ইয়ুশুই (বৃষ্টির পানি), চিংচ্য (পোকামাকড়ের জাগরণ), ছুনফেন (বসন্ত বিষুব), ছিংমিং (তাজা সবুজ), কুইয়ু (শস্য-বৃষ্টি), লিসিয়া (গ্রীষ্মের শুরু), সিয়াওমান (কম পূর্ণতা), মাংচুং (ফসল বোনার সময়), সিয়াচি (উত্তরায়ন), সিয়াওশু (কম গরম), তাশু (বেশি গরম), লিছিয়ু (শরতের শুরু), ছুশু (গরমের শেষ), পাইলু (শুভ্র শিশির), ছিউফ্যন (শারদীয় বিষুব), হানলু (ঠাণ্ডা শিশির), শুয়াংচিয়াং (প্রথম হিমেল হাওয়া), লিতুং (শীতের শুরু), সিয়াওসুয়ে (ছোট তুষার), তাসুয়ে (বড় তুষার), তুংচি (দক্ষিণায়ন), সিয়াওহান (কম ঠাণ্ডা), তাহান (বেশি ঠাণ্ডা)।

Advertisement

প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে। বছরের কোন সৌরপদে আবহাওয়া কেমন থাকবে—তা নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়। সৌরপদ অনুসারে চীনারা তাদের খাওয়া-দাওয়ায়ও পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে পোশাক-আশাকে। এখন চলছে সৌরপদ সিয়াওসুয়ে বা ‘ছোট তুষার’। এটি চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার কুড়িতম সৌরপদ।

কুড়িতম সৌরপদে, যেমনটি আগেই বলেছি, তুষারপাত শুরু হয় বা হবার কথা। সাধারণত চীনের উত্তরাঞ্চলে এসময় তুষারপাত শুরু হয়, তাপমাত্রা দ্রুত কমতে শুরু করে। অবশ্য এই সৌরপদে খুব বেশি তুষারপাত হয় না। গাছ-গাছড়াসম্পর্কিত এক প্রাচীন চীনা গ্রন্থে লেখা হয়েছে: “…এসময় আবহাওয়া ঠাণ্ডা হবে, হালকা তুষারপাত হবে; তবে পৃথিবী একেবারে হিমায়িত হয়ে যাবে না।” বস্তুত, ‘ছোট তুষার’-এর সময় চীনের উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায়। আর হলুদ নদীর নিম্ন ও মধ্য অববাহিকায় এসময়ই প্রথম তুষার পড়ে। যেমনটা আগেই উল্লেখ করেছি, এসময় হালকা তুষার পড়ে এবং দিনের বেলা সে তুষার দ্রুত গলেও যায়।

‘ছোট তুষার’ সৌরপদে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবাহিত হতে শুরু করে। তবে, ঠাণ্ডা অতো তীব্র নয় বলে, অনেকেই এসময় মাথায় শীতের টুপি বা গলায় মাফলারজাতীয় কিছু পরেন না (আমার মতো বাঙালির জন্য এ কথা প্রযোজ্য নয় যদিও)। আবার, অনেকেই টুপি ও মাফলার পরেনও বটে। এক চীনা প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘শরীরের সকল পথ এসে মিলিত হয়েছে মাথায়’। মাথাকে গরম রাখা তাই তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

কুড়িতম সৌরপদে চীনারা বিভিন্ন ধরনের স্যুপ খেতে পছন্দ করেন। ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করায় ততদিনে বাসাবাড়িতে হিটিং সিস্টেম চালু হয়ে যায়। তাই অনেকের নাক-মুখ শুকিয়ে যায়। আবার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিত্সাবিদ্যা অনুসারে, এ ধরনের কৃত্রিম গরমের কারণে শরীরে নানান সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে; হতে পারে মুখের আলসারের মতো রোগ। কিন্তু শীত থেকে বাঁচতে কৃত্রিম গরমের বিকল্পও তো নেই! তাহলে উপায়? উপায় একটাই: প্রচুর গরম স্যুপ খেতে হবে। চীনারা তাই এসময় বিভিন্ন ধরনের স্যুপ খায়, যেমন: বাধাকপি ও সিমের স্যুপ, পালং শাক ও সিমের স্যুপ, খাশির মাংসের স্যুপ, ইত্যাদি।

Advertisement

দক্ষিণ চীনের মানুষ ‘ছোট তুষার’-এর সময় এক ধরনের আঠালো ভাত দিয়ে তৈরি কেক বা পিঠা খায়। প্রাচীন আমলে এ ধরনের কেক পুজা-পার্বনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ ছিল। তখন চীনারা বিভিন্ন ধরনের দেবতার পুজা করতেন। এখন অবশ্য অধিকাংশ চীনা আর তা করেন না; দেবতায় তাদের বিশ্বাস নেই। যা হোক, আঠালো ভাতের কেক প্রাচীন আমলের চীনারা ষাঁড়-দেবতার পুজায় ব্যবহার করতেন।

‘ছোট তুষার’-এর সময় চীনারা মাংস সংরক্ষণ করেন। এসময় তামপাত্রা কমে যাওয়ায় সহজে মাংস সংরক্ষণ করা যায়। পরে এই মাংস বসন্ত উত্সবের সময় খাওয়া হয়। প্রাচীন কালে স্বাভাবিকভাবেই চীনে ফ্রিজার ছিল না। এখনকার মতো কৃত্রিম উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণ করা যেত না। তখন চীনারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপায়ে খাবার সংরক্ষণ করতেন। ‘ছোট তুষার’-এর সময় মাংস সংরক্ষণ তেমন একটা পদ্ধতি। কোনো কোনো চীনার কাছে সংরক্ষিত মাংসের স্বাদ তাজা মাংসের চাইতেও ভালো।

হাজার হাজার বছর ধরে চীনের নানচিং ও চিয়াংসু প্রদেশের মানুষ ‘ছোট তুষার’-এর সময় বিভিন্নভাবে আচার-সবজি তৈরি করে আসছে। বছরের কুড়িতম সৌরপদকে যেন এভাবেই তারা স্বাগত জানায়। নানচিং আচার-সবজির জন্য বিখ্যাত। প্রাচীনকালে পরিবহনব্যবস্থার সমস্যার কারণে নানচিংয়ে সবজি ছিল বাড়ন্ত ও দামি। বিশেষ করে শীতকালে তো সবজি পাওয়া যেতই না। তাই তখন নানচিংয়ের মানুষ শীতের শুরুতেই আচার-সবজি তৈরি করে রাখতো, যাতে ভীষণ শীতের সময়ও সবজির স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত না থাকেন।

শীতের সময় ঝাল ও মশলাদার খাবার খেয়ে শরীরটা গরম রাখার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ‘ছোট তুষার’-এর সময়ও একই কথা প্রযোজ্য। তবে, চীনা ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সাবিদ্যা অনুসারে, এসময় অতিরিক্ত ঝাল ও মশলাদার খাবার খাওয়া ঠিক নয়। অতিরিক্ত ঝাল ও মশলাদার খাবার এড়িয়ে চললে, মানুষের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা প্রাকৃতিকভাবেই বাড়বে। আর কে না জানে, প্রাকৃতিক সবকিছুই কৃত্রিম সবকিছুর চেয়ে ভালো!

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।alimulh@yahoo.com

এইচআর/এমএস